তবে শুধু তাদের কাছে আশা করা ভুল হবে। কারণ, এই ড্রাইভাররা বেশিরভাগই আর মানুষ নেই, তাই তাদের মধ্যে মানবিক গুণও নেই। তাদের অমানুষ হয়ে যাওয়ার জন্য তারা যতটা দায়ী তারচেয়ে বেশি দায়ী অন্যরা, বিশেষ করে বাস মালিকরা। দেশে গণপরিবহনের সংখ্যার চেয়ে লাইসেন্সওয়ালা ড্রাইভারের সংখ্যা অনেক কম। সুতরাং আমরা বাস-মিনিবাসে যে ড্রাইভারদের দেখি তাদের অনেকেরই লাইসেন্স নেই, থাকলেও তা ভুয়া, অনেকে হেলপার থেকে ড্রাইভার, বেশিরভাগ ড্রাইভারের নিয়োগপত্র নেই, বিশ্রাম ছাড়া একটানা ১২/১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে হয়, চোখে যাতে ঘুম চলে না আসে সেজন্য তারা নানারকম নেশা করে। এগুলো আমার মনগড়া কথা নয়, মালিক-শ্রমিক, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বহুবার টকশো করতে গিয়ে তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য।
এই বিষয়গুলো ঠিক করতে পারেন বাস মালিকরা, পরিবহন শ্রমিক নেতারা, সরকার। একজন মন্ত্রীর কারণে পরিবহন শ্রমিক এবং সরকার এখন একপক্ষ। তিনি সেই মন্ত্রী যিনি বাসের চাকার নিচে দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর শুনেও হাসতে পারেন, অবলীলায় বলতে পারেন দুনিয়ার আর কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এত হৈ চৈ হয় না।
আর মালিকরা? দিন অথবা মাস শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকায় তারা ড্রাইভার-হেলপারদের কাছে বাস ইজারা দিয়েছেন। এই পরিমাণ টাকার বাইরে যা আয় হয় তা ড্রাইভার-হেলপাররা নেয়। তাই আয় বাড়াতে তারা বেপরোয়া ছোটে। পরিবহনের নাম জাবালে নূর। পবিত্র নগরী মক্কা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরের একটি পাহাড়ের নাম জাবালে নূর। এই পাহাড়ে অবস্থিত হেরা গুহায় ধ্যান করতে করতে নবুয়তপ্রাপ্ত হয়েছিলেন মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.)। এ রকম পবিত্র একটি নাম দিয়ে রাস্তায় বাস নামিয়ে মালিকরা কেমন ব্যবসা করছেন শুনবেন? যে দুটি বাস সেদিন যাত্রী তোলার পাল্লা দিতে গিয়ে শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীদের চাপা দিয়েছিল সেগুলোর কোনোটিরই বৈধ কাগজপত্র ছিল না।
রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ-আন্দোলনের বরাবর বিরোধী আমি। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দীর্ঘক্ষণ আটকে রেখে কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা যে প্রতিবাদ করছে তার বিরোধিতা করতে পারছি না। একশ্রেণিরা বাস মালিক, ড্রাইভার এবং মন্ত্রীর উন্মত্ত আচরণে সড়কে মৃত্যুর মিছিল যখন বাড়ছেই তখন এমন প্রতিবাদই তো করতে হবে, যাতে তাদের কানে পানি যায়। এই আন্দোলনে অনেকের কষ্ট হয়েছে, তবে বড় কোনও সমাধান পেতে এই কষ্ট সইবার বিকল্পও নেই।
ঢাকার একটি কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু নাড়া দিয়েছে এই শহর এবং বাইরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদেরও। তারাও নেমে এসেছে পথে। বিভিন্ন কলেজ কর্তৃপক্ষ আন্দোলনে না যেতে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মেসেজ পাঠালেও তাদের আটকানো যাচ্ছে না। আশাবাদী হওয়ার এটাও একটা কারণ যে এবার বোধহয় হবে।
পাদটীকা: এই লেখাটা লিখতে লিখতেই খবর পেলাম নৌমন্ত্রী শাজাহান খান শিক্ষার্থী মৃত্যুর হাসিমুখ মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, যা তার মতো লোকের কাছ থেকে অকল্পনীয় ছিল। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শিক্ষার্থীদের কলেজে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করে বলেছেন, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠক হয়েছে এবং সেখান থেকে এই ধরনের অরাজকতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই আরও বেশি করে মনে হচ্ছে যে এবার বোধহয় হবে।
লেখক: হেড অব নিউজ, মাছরাঙা টিভি