X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়

রেজোয়ান হক
১৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:১৪আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:১৪

রিপোর্টারের নোটবুক: তারিখ ০৮/১১/১৯৯৮

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ। সাংবাদিকদের সকাল সকাল যেতে বলা হয়েছিল। সাড়ে ৮টার মধ্যে পৌঁছে যাই নাজিমউদ্দিন রোডে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনের লাল দালানে স্থাপিত বিশেষ এজলাসে। নথিপত্র নিয়ে আদালতের লোকজন আসেন পৌনে ৯টায়। আসামিদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সবার আগে ৯টায় আদালত কক্ষে ঢোকেন মহিউদ্দিনের স্ত্রী ফরিদা বেগম। ক্রমাগত দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন তিনি।

সাড়ে ৯টায় পৌঁছান রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক, ছেলে বিশেষ কৌঁসুলি আনিসুল হককে সঙ্গে নিয়ে। যারাই আসছিলেন তাদের সবাইকে মেটাল ডিটেক্টরের নিরাপত্তা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢুকতে হচ্ছিল, এ সময় প্রত্যেকের ছবিও তুলে রাখা হয়।

আইনজীবীসহ মামলার দুই পক্ষের লোকজন, সাংবাদিক,পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে ১০টার মধ্যেই আদালত কক্ষ পূর্ণ হয়ে যায়। ছিলেন মামলার বাদী, হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ মোহিতুল ইসলাম, যিনি ১৯৯৬ সালের দোসরা অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলাটি করেছিলেন।

এছাড়া আসামি ফারুকের মা, শাহরিয়ারের স্ত্রীও ছিলেন। দুজন বিদেশিকেও দেখলাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তারা মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা। সেকেন্ড সেক্রেটারি প্যাট্রিক রিমেন এবং থার্ড সেক্রেটারি ম্যাথিউ গিলেন। মার্কিনিদের এই আগ্রহের কারণ সবারই জানা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সে সময়কার মার্কিন প্রশাসনের সমর্থনের অভিযোগ থাকায় শুরু থেকেই মামলাটি তাদের গভীর পর্যবেক্ষণে ছিল।

বেলা ১২টা ৩৬ মিনিটে ৫ আসামিকে এনে কাঠগড়ায় তোলা হলে আদালতকক্ষে কিছুটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সবার চোখ তাদের দিকে। ফারুক, মহিউদ্দিন এবং ওহাব জোয়ার্দারকে বিমর্ষ দেখালেও তাহের উদ্দিন ঠাকুর ছিল ভাবলেশহীন আর শাহরিয়ার বেশ হাসিখুশি। একমাত্র তাকেই আদালতকক্ষে স্বজনদের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখা যায়। বাকি আসামিরাও অবশ্য আত্মীয়দের কেউ এসেছে কিনা তা খুঁজছিল। মোট ১৯ আসামির মধ্যে এই ৫ জনই তখন গ্রেফতার ছিল। জোহর নামাজের আজানের পর বেলা ১টা ৫ মিনিটে এজলাসে ওঠেন ঢাকার দায়রা জজ আদালতের বিচারক কাজী গোলাম রসুল। এতক্ষণ যারা অনুচ্চকণ্ঠে কথা বলছিলেন তারা একযোগে চুপ হয়ে গেলে আদালত কক্ষজুড়ে নীরবতা নামে। বিচারক প্রথমেই খোঁজ করেন দু’পক্ষের কারা কারা এসেছেন। রায় দেওয়া শুরুর আগে ভূমিকায় তিনি বলেন, বিচার এখানেই শেষ নয়। কেউ যদি মনে করেন বিচারে কোনও ভুল হয়েছে তাহলে তারা উচ্চ আদালতে যেতে পারেন।

এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর মাধ্যমে একটি গোয়েন্দা সংস্থা রায় দেওয়ার কার্যক্রমটি ভিডিও করার অনুমতি চাইলে নিজেকে বাদ দিয়ে ভিডিও করার অনুমতি দেন বিচারক।

১-১০ মিনিটে রায় ঘোষণা শুরু হয়। বিচারক বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলা। তবে আইনের চোখে এটি শুধুই একটি হত্যা মামলা। তৃতীয় কোনও পক্ষ এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা সেটি একটি ইস্যু ছিল। (আসামি শাহরিয়ারকে এ সময় বেশ আনন্দিত দেখায়)। তবে তা নাকচ করে আদালত বলেন ঘটনাটি পরিষ্কার। হত্যাকাণ্ডের মোটিভ প্রসঙ্গে আদালত বলেন, আসামিদের অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছিল। মন্ত্রিসভা থেকে মোশতাককে সরিয়ে দেওয়ার কথা হচ্ছিল। অস্ত্র উদ্ধার অভিযান নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের কারও কারও ঝামেলা দেখা দিয়েছিল। এ নিয়ে যে অসন্তোষ ছিল তারও সুযোগ নেওয়া হতে পারে। তবে এর বিরুদ্ধে যা করণীয় ছিল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সে দায়িত্ব পালন করেননি। যথেষ্ট সময় পেলেও তারা কোনও পদক্ষেপ নেননি। বঙ্গবন্ধুর ফোন পাবার পরও তার নিরাপত্তার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মাত্র দুটি রেজিমেন্টের অল্প কিছু জুনিয়র অফিসার এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরও তাদের নিরস্ত্র বা নিবৃত করার কোনও চেষ্টা সেনাবাহিনী করেনি। এই ব্যর্থতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য চিরস্থায়ী কলঙ্ক হয়ে থাকবে।

রায়ের আদেশে ১৯ আসামির মধ্যে দুজন- দফাদার মারফত এবং এলডি হাশেম মৃধার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের খালাস দেন আদালত। তাহের ঠাকুর এবং ওহাব জোয়ার্দারকে খালাস দেওয়া হয় ‘বেনিফিট অব ডাউটে’। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের ঠাকুর প্রসঙ্গে আদালত বলেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে এবং খুন হবার পর তার অনুসারীদের অনেকের আচরণ পাল্টে যায়। নেতাভিত্তিক রাজনীতিতে দেখা যায় নেতা আছেন তো সব আছে, আমিও আছি, নেতা নেই তো কিছুই নেই, আমিও নেই। তাহের ঠাকুর এ রকম একজন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি খুনিদের সঙ্গে রেডিও স্টেশনে ছিলেন এবং তার আরও কিছু কার্যকলাপ রহস্যজনক। তবে হত্যাকাণ্ডে তার সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে তাকে বেনিফিট অব ডাউটে খালাস দেওয়া হলো।

তবে ফারুক, রশিদ, ডালিম এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছে উল্লেখ করে তারাসহ বাকি ১৫ জনকে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন আদালত। এই পর্যায়ে আসামিদের প্রধান আইনজীবী খান সাইফুর রহমান দাঁড়িয়ে আদালতকে বলেন, তার কিছু বলার আছে। আদালত বলেন এ পর্যায়ে আর সুযোগ নেই। আসামি মহিউদ্দিন কাঠগড়া থেকেই চিৎকার করে বলে সে নির্দোষ। অন্যদিকে খালাস পাওয়া আসামি ওহাব জোয়ার্দার আদালতকে স্যালুট দেন। তবে খালাস পাওয়া আরেক আসামি তাহের ঠাকুরের মধ্যে কোনও ভাবান্তর দেখা গেলো না। মৃত্যুদণ্ডের মুখে থাকা শাহরিয়ারও ছিল স্বাভাবিক। তবে ফারুককে অস্থির আর মহিউদ্দিনকে ভীত দেখাচ্ছিল।

আসামিদের ১৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করলেও আদালত তখনও তাদের শাস্তি ঘোষণা করেননি। বিচারক বলছিলেন, হত্যাকাণ্ডের পর কেউ কেউ আত্মস্বীকৃত খুনি বলে দাম্ভিকতা দেখিয়েছে। তারা শুধু ব্যক্তিবিশেষ নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও ক্ষতি করেছে। তাই তাদের প্রতি সহানুভূতি বা অনুকম্পা দেখানোর কোনও সুযোগ নেই, তাদের তা পাবার যোগ্যতাও নেই।

সবাই তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কি শাস্তি হয় তা শুনতে। আদালত আদেশ দিলেন প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুর। তবে এটাও বললেন, প্রয়োজনে প্রচলিত পদ্ধতিতেও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যেতে পারে। ঘড়িতে তখন ২-২০ মিনিট।

এজলাস ছেড়ে বিচারক তার খাস কামরায় চলে যাবার পর আমরা সাংবাদিকরা দুই পক্ষের আইনজীবী, এমনকি আসামিদেরও প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করি। কিন্তু অল্প জায়গায় অনেক মানুষের ভিড়, ধাক্কাধাক্কি এবং হৈ-হুল্লোড়ের কারণে এ জন্য বেগ পেতে হয়। আমি ফারুককে টার্গেট করেছিলাম এবং সফলও হই। যদিও তার প্রতিক্রিয়া ছিল ধারণার বিপরীত। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করবে কিনা জানতে চাইলে অতীতে নানা সময় এই হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে দম্ভ দেখানো ফারুক রায়ের বিরুদ্ধেও মেজাজ দেখাবে বলে ধারণা করেছিলাম। কিন্তু আপিল করার মামুলি সিদ্ধান্তটি জানানোর সাহসও তখন তার ছিল না। সংক্ষেপে তার জবাব ছিল- ‘আমার উকিল বলতে পারবে’।

--------------------------------------------------------

( পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে একটি নোটবই পাই। খুলে দেখি সেটি ১৯৯৮ সালের এবং তাতে প্রথমেই রয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণার অ্যাসাইনমেন্টের নোট। দৈনিক জনকণ্ঠের রিপোর্টার হিসেবে ঐতিহাসিক এই ইভেন্টটি কাভার করেছিলাম। দুই যুগেরও বেশি সময় আগের সেদিনটি মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তার ভিত্তিতেই এ লেখা)।

 

লেখক: প্রধান সম্পাদক, মাছরাঙা টেলিভিশন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ