‘কাজের বেলায় কাজী কাজ ফুরালেই পাজি’

রেজানুর রহমানগরুর শিং নিয়ে গণভোট! তাও আবার সুইজারল্যান্ডে। ওদের কি ‘খেয়ে দেয়ে কোনও কাজ নাই?’ গরুর শিং থাকবে কিনা, এটাও কি ভোটের বিষয়? গরু একটি অবলা প্রাণী বলেই কি তার ওপর এই অমানবিক আচরণ? গরুর যদি শিংই না থাকে, তাহলে গরু আবার গরু হয় কীভাবে? শিংই তো গরুর আসল পরিচয়, গরুর আভিজাত্যের প্রতীক! কাজেই গরুর শিং থাকবে কিনা, মানুষ সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে?  হাম্বা ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দই গরুর মুখ থেকে বের হয় না। ধরা যাক ‘হাম্বা’ শব্দের বাইরেও গরুর মুখ থেকে হঠাৎ কিছু শব্দ বের হয়ে গেলো। প্রতিবাদের শব্দ! মানি না মানবো না। শিং থাকা না থাকা আমার জন্মগত অধিকার। এই অধিকার খর্ব করা চলবে না চলবে না।

না, এটা অবাস্তব চিন্তা। গরুর মুখ থেকে ‘হাম্বা’ ছাড়া আর কোনও শব্দ বের হওয়ার কোনও সুযোগ নেই, সম্ভাবনাও নেই। কাজেই গরুর শিং থাকা না থাকা নিয়ে সুইজারল্যান্ডের গণভোটে যে রায় হবে, গরুকে তা মেনে নিতে হবে। কর্তৃপক্ষের দাবি, গণভোটের রায় যদি গরুর শিং রাখার পক্ষে যায়, তাহলে দেশটির ৩০০ কোটি ফ্রাঁ’র কৃষি বাজেটের প্রায় ৩ কোটিই ভর্তুকি বাবদ ব্যয় হবে। যদি শেষপর্যন্ত তাই হয়, তাহলে গরুর কোনও লাভ হবে কি? হ্যাঁ, গরুর একটা লাভ হবে। গরুর শিং থাকবে। মজার ব্যাপার হলো সুইজারল্যান্ডে গরুর শিংয়ের পক্ষে যারা দাঁড়িয়েছেন, তারা যদি গণভোটে জিতে যান, তাহলে তারা বছরে গরু প্রতি ১৯০ সুইস ফ্রাঁ (১৯১ দশমিক ৬৫ মার্কিন ডলার) সরকারি ভর্তুকি পাবেন।

আচ্ছা ধরা যাক, আমাদের দেশে যদি গরুকে নিয়ে এই ধরনের একটা অভিযোগ ওঠে যে, গরু তার শিং দিয়ে মানুষকে গুঁতো দেয় কাজেই গরুর শিং রাখার কোনোই প্রয়োজন নেই। আর গরুর যদি শিং রাখতেই হয়, তাহলে গরু পালন বাবদ ঝুঁকিভাতা দিতে হবে। তাহলে আমার ধারণা, একজনও গরুর শিং না রাখার পক্ষে ভোট দেবেন না। সবাই চাইবেন, গরুর শিং থাকুক। শিং থাকলেই তো বাড়তি লাভ। ঝুঁকি ভাতা পাওয়া যাবে। যার একটা গরুর আছে, সে আরও দশটা গরু কিনবে। গরুতে গরুতে সয়লাব হয়ে যাবে গোটা দেশ! ডানে তাকালে গরু। বামে তাকালে গরু। সামনে-পেছনে সবখানেই গরু। এই যে এত গরুর সংখ্যা বাড়বে, তাতে কি গরুদের কোনও লাভ হবে?

না, গরুদের কোনও লাভ হবে না। বরং গরু যারা পালন করে তাদেরই লাভ হবে। তারা বেশি বেশি গরুর দুধ পাবেন। মন চাইলেই মোটা টাকায় যেকোনও গরুকেই বিক্রি করে দিতে পারবেন। গরু কিন্তু গরুই থেকে যাবে!

এবার যে কথাটি বলবো, সে জন্য প্রথমেই করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কাউকে ছোট করার জন্য অথবা কারও মনে আঘাত দেওয়ার জন্য আমার আজকের এ লেখা নয়। সুইজারল্যান্ডের গরু বিষয়ক খবর পড়ে কেন যেন মনটা খারপ হয়ে গেলো। গরুর শিং থাকবে কিনা, তাই নিয়ে গণভোট। গরুকে কি এ বিষয়ে একবারও জিজ্ঞেস করা হয়েছে, এই যে গরু তোমার শিং থাকবে কিনা, এই নিয়ে গণভোট হবে। তোমার মন্তব্য জানতে চাই। জবাবে ‘হাম্বা’ বলা ছাড়া গরুর কি কোনও ধরনের প্রতিক্রিয়া জানানোর বা দেখানোর সুযোগ আছে? না, তা নেই। গরুর অপরাধ কী? গরুর অপরাধ হলো সে শিং দিয়ে মানুষকে গুঁতো দেয়। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, যে রাখাল গরুকে খুব ভালোবাসে, গরু তাকে শিং দিয় গুঁতোয় না। বরং শিং দিয়ে রাখালকে আদর করে। তার মানে গরুর শত্রু হলো বদমাশ রাখাল। রাখাল ভালো তো গরুও ভালো। গুরুর শিং না থাকুক, ভালো রাখাল কখনোই তা চাইবে না।

সুইজারল্যান্ডের গরু বিষয়ক ঘটনার সঙ্গে দেশের কোটি কোটি বেকার তরুণ-তরুণীর অসহায় জীবনের কেমন যেন একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সারাদেশ এখন আনন্দ-উৎসবের আমেজে মুখর হয়ে উঠেছে। দেশের যে প্রান্তেই যাবেন, নিজের  দেখতে পাবেন সভা, সমাবেশসহ নির্বাচনি সব কর্মকাণ্ডে তরুণ-তরুণীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। কী সরকারি দল, কী বিরোধী দল, সবার কাছেই এখন তরুণ-তরুণীরাই ভরসার স্থল। আর তাই যে যেভাবে পারছে, তরুণ-তরুণীদের দলে ভেড়াচ্ছেন। নানা ধরনের আশ্বাস দিচ্ছেন। যদি ভোটে জিতে যাই তাহলে তোমার বা তোমাদের জন্য এই করবো, ওই করবো, কত ধরনের যে প্রতিশ্রুতি পাচ্ছে তরুণেরা, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। অতীতেও নির্বাচনের সময় তরুণ-তরুণীরা এভাবেই আশ্বাস পেয়েছিল। কিন্তু কোনও সরকারের আমলেই আশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসের তেমন মিল খুঁজে পায়নি। ফলে নির্বাচন আসে নির্বাচন যায়, তরুণদের জীবনমানের তেমন কোনও উন্নতি হয় না। আশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসের মিল খুঁজে না পাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে মেধাবী তরুণেরাও বিভ্রান্ত হয়। অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে। তখন নির্বাচনের সময় যে নেতা একদিন তাকে তার রাজনৈতিক সিঁড়িতে ওঠার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল, সেই নেতাই মুখ ফেরিয়ে নেন। যেন গরুর মতোই তার পরিণতি। তুমি ভাই গুঁতো দাও। তোমাকে এখন আর আমাকে দরকার নেই!

কিন্তু দরকার নেই বললেই কী হবে? এই যে সারাদেশে নির্বাচনি উৎসব চলছে, কে না জানে এই উৎসবের মূল শক্তি হয়ে উঠেছে তরুণ-তরুণীরাই! কত আশা কত স্বপ্ন—নেতা জিতলেই আমার ভবিষ্যৎ গড়তে পারবো। ‘নেতা তুমি এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে’, নেতারাই এবারও জিতবেন। কিন্তু সারাদেশে কোটি কোটি বেকার তরুণ-তরুণীর জীবন মানের আদৌ কি কোনও উন্নতি হবে? আইএলও’র একটি প্রতিবেদনের সূত্র অনুযায়ী দেশে তরুণ বেকারের হার গত ৭ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ তরুণদের জন্য দেশে কর্মসংস্থানের তেমন কোনও সুযোগ নেই। অথচ বলতে গেলে এবার তরুণদের ভোটেই নেতা-নেত্রীদের জয়-পরাজয় নির্ভর করবে। জানা মতে, এখন পর্যন্ত কোনও রাজনৈতিক দল অথবা রাজনৈতিক জোট তাদের নির্বাচনি অঙ্গীকারনামায় তরুণদের জীবনমানের উন্নতির ক্ষেত্রে সঠিক নির্দেশনামূলক কোনও ঘোষণা দেননি। যদিও এক্ষেত্রে সময় ফুরিয়ে যায়নি। আমরা আশা করতেই পারি, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি রাজনৈতিক দল অথবা জোট তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে তরুণদের জীবনমানের উন্নতির ব্যাপারে গুরুত্বসহ স্পষ্ট ঘোষণা দেবেন।

এক্ষেত্রে একটি পরিকল্পনার কথা তুলে ধরতে চাই। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সারাদেশের শ্রদ্ধাভাজন রাজনৈতিক নেতারা এই পরিকল্পনাটি গুরুত্বসহ নেবেন আশা করি। সারাদেশে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে নির্বাচন হবে। সারাদেশে ৩০০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। ধরা যাক, এই ৩০০ জন সংসদ সদস্যের প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকার এক হাজার মেধাবী তরুণ-তরুণীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবেন বলে অঙ্গীকার করলেন। নির্বাচনে জেতার পর তারা যদি প্রত্যেকেই এই অঙ্গীকার পালনের চেষ্টা করেন, তাহলে সারাদেশে ৩০ লাখ মেধাবী তরুণ-তরুণীর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন, প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় এক হাজার তরুণ-তরুণীর চাকরির ব্যবস্থা করা আদৌ কি সম্ভব? চাকরির সুযোগ কোথায়? সরকারি চাকরি তো নেই বললেই চলে। কথা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে সরকারি চাকরির প্রতি ভরসা না করেও নিজ নিজ এলাকায় মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সঠিক কর্মপরিকল্পনা। প্রত্যেক সাংসদের নেতৃত্বে তার নির্বাচনি এলাকার মেধাবী বেকার তরুণ-তরুণীদের জন্য একটি কর্ম পরিকল্পনা সাজানো যেতে পারে। গ্রাম, শহর সব জায়গায় বসেই এখন আইটি সেক্টরে মেধা খাটানো যায়। প্রত্যেক সাংসদের নেতৃত্বে তার এলাকায় এই সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এলাকার পরিত্যক্ত জলাশয় পরিষ্কার করে সমবায় পদ্ধতির ভিত্তিতে জোট বদ্ধ তরুণ-তরুণীদের জন্য হাঁস-মুরগি পালন, মাছ ও সবজি চাষের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। অনেক এলাকায় বিদেশি সবজি চাষ করে অনেক তরুণ-তরুণী স্বাবলম্বী হয়েছেন। ফুল চাষ করেও অনেক তরুণ-তরুণী সাফল্য দেখিয়েছেন। আধুনিক হোটেল ব্যবসা করেও অনেক সাফল্য দেখাচ্ছেন। প্রত্যেক সংসদীয় এলাকায় এধরনের নতুন নতুন কর্ম পদ্ধতির সঙ্গে তরুণ-তরুণীদের যুক্ত করা যেতে পারে।

একবার ভাবুন তো, প্রত্যেক সাংসদ যদি আন্তরিকভাবে এ ধরনের বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি সাজিয়ে তরুণ-তরুণীদের পাশে দাঁড়ান তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল হবে? এজন্য চাই সামান্য আন্তরিকতা। আশা করি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী  প্রত্যেক প্রার্থী এলাকার তরুণ-তরুণীদের জীবন-মানের উন্নতির ব্যাপারে নিজ নিজ পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। তাদের কাছে আমাদের এই প্রস্তাবনাও গুরুত্ব পাবে বলে আশা করি।

গুরুত্বের কথা যখন উঠলো তখন প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলি, দেশে যেকোনও নির্বাচন এলেই তরুণ-তরুণীরাই সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মিছিল সমাবেশে তো বটেই তাদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবেও ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না অনেক নেতা। প্রতিপক্ষকে হুমকি দেওয়ার ক্ষেত্রেও তরুণদেরই ব্যবহার করা হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম–‘কাজের বেলায় কাজি, কাজ ফুরালেই পাজি’।

আবারও সুইজারল্যান্ডের ওই গণভোটের কথা উল্লেখ করতে চাই। কোথায় গরু আর কোথায় মানুষ? কার সঙ্গে কার তুলনা? তবু তুলনা করতে চাই। যারা গরুর শিং থাকুক চাইছেন বোধ করি, তাদের আগ্রহ অন্য জায়গায়। গরুর শিং থাকলে ভর্তুকি পাওয়া যাবে। গরুর ভালো-মন্দ কোনও ব্যাপার নয়। তেমনি তরুণেরা সঙ্গে থাকলে ভোটে জেতা যাবে। ‘ভোটে তো আগে জিতি’—বোধ করি, এমনই মনোভাব ছড়িয়ে আছে ভোটের মাঠে! কিন্তু এটা কি সুখের কথা?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু কার্টুন দেখলাম। কোলাজ কার্টুন। প্রথম কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, একজন নেতা ভোটারের কাছে ভোট চাইতে এসেছেন। দ্বিতীয় কার্টুনে ওই নেতা ভোটারকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে ভোট চাইছেন। তৃতীয় কার্টুনে ভোট দিচ্ছেন ওই ভোটার। চতুর্থ কার্টুনে ভোট শেষে নেতা আর ফিরেও তাকাচ্ছেন না ভোটারের দিকে। বাহ, কী চমৎকার!

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।