কেন মাঠ দখলের এই লড়াই?

রেজানুর রহমানছবিতে একটি শিশু কাঁদছে। পায়জামা, পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি পরা শিশুটিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন সদস্য পরম মমতায় কান্নার কারণ জানতে চাইছেন। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ভীতসন্ত্রস্থ কয়েকজন পথচারী। পেছনে পায়জামা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরা কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও ৪ সদস্য। রাস্তায় এলোপাতাড়ি পড়ে আছে লাঠি আর ছোট-বড় অসংখ্য ইটের টুকরো। ছবিতে দেখা পরিবেশ ও পরিস্থিতিই জানান দিচ্ছে একটু আগে এই এলাকায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে।
এটা হলো, পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি। এবার একটি ভয়াবহ ভিডিও দৃশ্য বর্ণনা করি। গগনবিদারি ভয়ার্ত স্লোগান তুলে হাজার-হাজার টুপি পরা বিক্ষুব্ধ মানুষ ছুটে আসছে সামনের দিকে। তারা একটি দেয়াল ভেঙে ফেললো। তাদের দেখে বিপরীত দিক থেকে একই চেহারার আরও শত শত মানুষ বিক্ষুদ্ধ ভঙ্গিতে ছুটে এলো। কে পক্ষ, কে বিপক্ষ বোঝার উপায় নেই। কারণ সবার পরনেই পায়জামা আর পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। কাউকে আলাদা করারও সুযোগ নেই। অথচ পরস্পরের মধ্যে তুমুল লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। একে-অন্যকে বাঁশ দিয়ে পেটাচ্ছে। ইটপাটকেল ছুড়ছে। চেয়ার ছুড়ে মারছে। যেন এক কারবালার পরিস্থিতি!

এদিকে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তিটা দেখুন। কেউ কিছু জানে না অথচ রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড বসলো। ফলে একদিকে টঙ্গী ব্রিজ অন্যদিকে মহাখালী পর্যন্ত ব্যস্ত রাস্তায় যান চলাচল হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যস্ত সড়ক অচল হয়ে পড়ে থাকলো। অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে থাকা অসুস্থ রোগী কাতরাচ্ছে। আফিসগামী মানুষের চোখেমুখে অসহায়ত্বের ছায়া। দেশ-বিদেশের উড়োজাহাজ ধরবেন, এমনযাত্রী অসহায় আকুতি জানাচ্ছেন, আমি ফ্লাইটে উঠবো। প্লিজ রাস্তা ক্লিয়ার করুন। এলাকায় কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের একটাই উত্তর–আমাদের কিছুই করার নাই। ‘হুজুরেরা’ মারামারি করছেন। তাদের মারামারি না থামলে রাস্তা চালু করা যাবে না। প্লিজ, প্রিয় জনগণ আমাদের ক্ষমা করবেন।

এবার আসা যাক, কী এমন ঘটনা ঘটলো যে, হঠাৎ রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তা থমকে দাঁড়ালো। ‘হুজুরেরা’ বিশ্ব ইজতেমার মাঠে মারামারি করছেন আর তাই জনগণকে নিরাপত্তা দিতে পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। পাছে না ‘হুজুরেরা’ সাধারণ জনগণের ওপর চড়াও হয়। হুজুরদের সমস্যা কী? কী এমন ঘটলো যে, নিজেদের মধ্যে লড়াই করতে হবে? তাও আবার যেই-সেই লড়াই নয়। মরণপণ লড়াই। কেন? কোন আদর্শের লড়াই? নাকি স্বার্থের পরিপন্থী কোনও খেলা?

প্রচার মাধ্যমের খবর অনুযায়ী যা জানা গেছে, তা হলো, টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করেই মূলত ঘটনার সূত্রপাত। বাংলা ট্রিবিউনের খবর অনুযায়ী, ভারতের দিল্লি মারকাজের মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভির অনুাসরীরা ৩০ নভেম্বর থেকে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার মাঠে পাঁচ দিনের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান করার ঘোষণা দেন। তারা যেন ‘জোড়’ নামের এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান না করতে পারেন, সেজন্য কয়েকদিন আগে থেকেই সাদবিরোধী একটি অংশ টঙ্গীতে ইজতেমার মাঠ দখলে নেয়। বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের এনে টঙ্গী মাঠে জড়ো করা হয়। এদিকে, মাওলানা সাদের অনুসারীরা টঙ্গী ময়দানে ঢুকতে না পেরে শুক্রবার রাতেই আশেপাশের মসজিদে অবস্থান নিতে থাকেন। শনিবার ফজরের নামাজের পর সাদপন্থীরা টঙ্গীর ইজতেমা মাঠের দিকে যেতে থাকলে রাজধানীর বিমানবন্দর বাস্টস্যান্ড, উত্তরা কামারপাড়া, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বাধার মুখে পড়েন। ফলে উভয়পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জনগণের জান-মালের নিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গোটা এলাকায় যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

সহজ কথায় বলা যায়, পুলিশের কাজ করেছে পুলিশ। হুজুরেরাও তাদের কাজ করেছেন। এখানে জনগণ অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত ছিল? একথা সত্য, পুলিশ সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু হুজুরেরা কি সাধারণ মানুষের পক্ষে ছিলেন?

বিশ্ব ইজতেমা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ধর্মীয় সমাবেশ। অনেকেই বলে থাকেন পবিত্র হজের পরই আমাদের দেশের এই ধর্মীয় সমাবেশকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা প্রতি বছর এই সমাবেশে যোগ দিতে আসেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই ঐতিহ্যগত দিক থেকেও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্বদানকারী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গও বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হন। অথচ বিশ্ব ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে যা ঘটে গেলো, তা কি মেনে নেওয়ার মতো কোনও ঘটনা? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জাদুকরি স্পর্শে এখন যে কোনও ঘটনা, বিশেষ করে নেতিবাচক খবর সারাবিশ্বে নিমিষেই ছড়িয়ে যায়। একবার ভাবুন তো, বিশ্ব ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে হুজুরদের দুই গ্রুপের মধ্যে এই যে মরণজয়ী লড়াইয়ের ভিডিও দৃশ্য গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে গেলো, এর ফলে দেশের ভাবমূর্তি কি বাড়বে? এছাড়া মরণজয়ী এই লড়াই কী বার্তা দিলো, তাও ভেবে দেখার বিষয়। আরেকটি প্রশ্ন বোধকরি বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। যতটুকু জানি জাতীয় নির্বাচনের আগে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার সব কার্যক্রম স্থগিত করেছিল সরকার। অথচ কোন ক্ষমতা বলে টঙ্গীর ঐতিহাসিক ময়দানে একটি পক্ষ জমায়েতের ডাক দিয়েছিল?

ছবির ওই শিশুটির প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। শিশুটি একটি কওমি মাদ্রাসার ছাত্র! জানা গেছে, শনিবার ‘হুজুরদের’ আন্দোলনে কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদেরও ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সরে জমিনে বিমানবন্দর, এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, সাদবিরোধীরা বিমানবন্দর সড়কের প্রতিটি বাস তল্লাশি করে। এর মধ্যে বেশিরভাগই গাজীপুর, টঙ্গী ও বিমানবন্দর এলাকার বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল। একটি সূত্রের মতে, বুধবার রাত থেকেই টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার মাঠে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে জড়ো করা হয়। এমনকি মাঠে তাদের উপস্থিতির হাজিরাও নেন শিক্ষকেরা। অনেক শিক্ষার্থী নাকি জানতোই না তাদের কেন মাঠে আনা হয়েছে।

প্রসঙ্গক্রমে একজন শিক্ষক নেতা বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীরা বরাবরই আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নেয়। ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সব আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের একটা ভূমিকা ছিল। তার মন্তব্য, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে পারলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে বাধা কোথায়?

যৌক্তিক প্রশ্ন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে পারলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন করার অধিকার রাখে। তবে তার আগে বুঝতে হবে, আন্দোলনটা কার জন্য? কোন স্বার্থে আন্দোলন। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের জড়িত থাকার কোনও যৌক্তিকতা আছে কিনা? মাঠ দখল করার জন্য মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ডেকে আনা হলো। তারা কি আদৌ জানে এই মাঠ দখল করে কী হবে? কার স্বার্থ উদ্ধার হবে?

আমাদের সমাজে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘হুজুর’ শব্দটি অনেক মর্যাদার, অনেক শ্রদ্ধার। ছোটবেলায় সম্মানিত এক হুজুরের কাছে শিক্ষা নিয়েছিলাম। তিনি বেঁচে নেই। কিন্তু আজও তার কথা মনে পড়লে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। ছোটবেলায় আমার প্রিয় ‘হুজুর’কে বলতে শুনেছি, বাবারে! কখনও নিজের ভেতর অহংবোধ তৈরি করবি না। আর ধর্মের ভাইকে কখনও কষ্ট দিবি না। তার বিরুদ্ধে কখনও দাঁড়াবি না।

বড় বেলায় এসে হুজুরের ওই কথার কেন যেন কোনও মানে খুঁজে পাচ্ছি না। বিশ্ব ইজতেমার মাঠে যে লড়াইটা দেখলাম, সেটা তো ধর্মের ভাইয়ের সঙ্গে ধর্মের ভাইয়েরই লড়াই। কেন? এর উত্তর কী?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো