অবশ্য একথা ঠিক যে আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭১.৮ বছর। এরমধ্যে নারীদের ৭৩.১ বছর এবং পুরুষের ৭০.৬ বছর। ২০০৫-০৬ সালে গড় আয়ু ছিল ৬৫ বছর। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার মান ফিরবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন। কোনও মানুষ একবার এক-আধঘণ্টার জন্য সরকারি যেকোনও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা জেলা শহরের হাসপাতালগুলো ঘুরে এলেই যে চিত্র চোখে পড়বে সেটা ভয়াবহ। ফুটে উঠবে চিকিৎসকের জন্য রোগীদের দীর্ঘ লাইন, সেবা পেতে নানা ভোগান্তির দৃশ্য। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও শোচনীয়। সেখানে কিছু চিকিৎসা কেন্দ্র ও সরকারি হাসপাতাল আছে। কিন্তু চিকিৎসা নেই, নার্স নেই, নেই ওষুধপত্র। কিছু যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার নেই। গ্রামের হাসপাতালে নিযুক্ত ও বদলি হওয়া চিকিৎসকরা অনেকেই সেখানে থাকেন না। এছাড়াও চিকিৎসাসেবা নিয়ে যেন অভিযোগের শেষ নেই। সে কারণে প্রশ্ন থেকেই যায়, সেবার মান নিয়ে দিনে-দিনে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে তা কতটুকু ফেরানো সম্ভব? এরমধ্যে আমাদের গেলো বাজেট অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দও ততটা বেশি নয়। সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নতুন বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ২৩ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা।
চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে এই খাতের জন্য ২০ হাজার ১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফলে নতুন বাজেটে মোট ব্যয়ের ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে স্বাস্থ্যখাত। জিডিপির অনুপাতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো তাদের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কতটা বেশি।
এই খাতে বাংলাদেশের সাফল্য রয়েছে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর মাধ্যমে। তবে সেটা সম্ভব হয়েছে সস্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। স্বাস্থ্যখাতে নতুন যেসব সমস্যা রয়েছে তাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে ব্যাপক হারে। সবচেয়ে বড় কথা, এ খাতে সেবার মান নিশ্চিত কতটুকু করা গেলো সেটা নির্ভর করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও আন্তরিকতার ওপর। একই সঙ্গে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নতুনভাবে সে পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন ও সিন্ডিকেট বন্ধে তদারকি জোরদার করা হবে। দুর্নীতি দূর করতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হবে। টেন্ডার ছাড়া কোনও যন্ত্রপাতি কেনা হবে না। হাসপাতালে জনবলের উপস্থিতি, যন্ত্রপাতির সঠিক পরিচর্যা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং ওষুধের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। সাধারণ সেবাগ্রহীতারা মনে করেন, সরকার চাইলেই সব পারে। শুধু প্রয়োজন আন্তরিক প্রচেষ্টা। বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন প্রায় ষাট শতাংশ রোগী। তাই মান অনুসারে চিকিৎসকের ফি নির্ধারণ, রোগ নির্ণয় পরীক্ষা, শয্যা ভাড়াসহ সবকিছুর খরচ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ প্রয়োজন। এই খাতে দেখা যায় দুর্নীতি বা অনিয়মের প্রশ্নে কিছু কিছু চিকিৎসক কেমন যেন একাট্টা। একটু উনিশ-বিশ হলেই ধর্মঘট ডেকে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়। এসব যেন না হয় সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে গুণগত মানের কোনও বিকল্প নেই।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসকের অপ্রতুলতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পদায়ন ও পদোন্নতি জটিলতা দূর করে জনবল বাড়ানো এবং গ্রামে চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করাই হবে সরকারের এই খাতের বড় চ্যালেঞ্জ, যদি তারা আন্তরিকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ইশতেহার বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। দৃষ্টি দিতে হবে বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতে সেবার মূল্য-লাগাম টানার দিকে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যখাতে বাড়াতে হবে বরাদ্দ। এই খাতে সারাদেশে যেসব মানুষ কর্মরত রয়েছেন তারা যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে থাকেন তাহলে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে চিকিৎসা সেবা পৌঁছানো দুরূহ হবে না। এই বিষয়ে যদি যথেষ্ট আইন নেই মনে করা হয় তবে যথেষ্ট আইন তৈরির পাশাপাশি তা প্রয়োগেও কঠোর হতে হবে। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণেই পাশের দেশ ভারতে লাখ লাখ রোগী যাচ্ছেন প্রতিবছর। আমাদের টাকা চলে যাচ্ছে সে দেশে। আরও একটি বিষয় বারবার আলোচনায় আসে, আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ভালো হলে জনপ্রতিনিধিরা কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশ ছুটে যান। বাংলাদেশে যারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, তাদের অনেকেই চিকিৎসা নেওয়ার জন্য থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর বা অন্য দেশে যান। ব্যক্তিগতভাবে যাওয়াটা ঠেকাতে পারে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হলে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের টাকায় বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া হয় বলেই অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে। যদিও একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে চিকিৎসা সেবা নিতেই বেশি আগ্রহী। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানসহ মন্ত্রী, এমপিরা বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করেন যে জনগণের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে তারা ব্যর্থ। বাংলাদেশে রাষ্ট্র বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেন না বলেই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান নিম্নগামী। একই সঙ্গে এবারে সরকার এমন একটি নিয়ম করতে পারে, সংসদ সদস্যরা যেন তাদের নির্বাচনি এলাকার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেয়। নিদেনপক্ষে মাঝে মাঝে গিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার হালহকিকত দেখে আসেন। এতে যদি জনগণের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। সবশেষ কথা একটাই, চিকিৎসা সেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার ইশতেহার বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে এটা ভালো দিক। কিন্তু শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ে না রেখে সেটা দীর্ঘমেয়াদি সেবার ক্ষেত্রে যাতে প্রযোজ্য হয় সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। ঘোষণা যাতে শুধু ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে বা লোক দেখানো না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে, আর সবকিছুই সম্ভব আন্তরিকতা থাকলে এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। হাসিমুখে যদি সে সেবা না পায় তবে মানুষ যেমন ধুঁকতে থাকবে, সাথে সাথে ধুঁকবে দেশও। আর উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাতে হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাটাও একটা চ্যলেঞ্জ বৈকি!
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক