যাই হোক, আমার দুরন্ত কৈশোরে গ্রাম ছেড়ে যখন চট্টগ্রাম শহরে এলাম, দেখতাম প্যারেড ময়দানে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মাহফিল। আশপাশের এলাকায় যান চলাচল সীমিত করে ফেলা হতো। সেই মাহফিল শেষে যেটি আলোচনার বিষয় ছিল এবং অনেক সংবাদপত্রে (সেই সময় কোনটি জামায়াতের বা উগ্রবাদী পত্রিকা বুঝতাম না) শিরোনাম হতো সাঈদীর মাহফিলে কতজন ধর্মান্তরিত হয়েছেন।
সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্টার সালমান তারেক শাকিল ওয়াজ মাহফিল নিয়ে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক রিপোর্ট করেছেন। সেগুলো পড়ে ওই সময়ের কথা আরও বেশি করে মনে পড়েছে। আমি ধর্মীয় জ্ঞানী নই বা এ বিষয়ে কোনও আলেমও নই, তাই ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বলছি না। কিন্তু রিপোর্টটিতে যে বিষয়টি বিশদভাবে উঠে আসতে পারতো- তা হলো, বর্তমানে ওয়াজ মাহফিলের নামে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর বিষয়ে। একই সঙ্গে আলোচনার সুবিধার্থে সেই রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলা মাওলানাদের কয়েকটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করবো। হাদিসের শিক্ষক মুফতি লুৎফর রহমান খান বলেছেন, ‘ওয়াজ নসিহত বা উপদেশ মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানবসমাজের উন্নতি ও সংশোধনের জন্য এটি অতুলনীয় পন্থা।’ আমারও মনে হয় ভালো কিছু শোনার জন্যই ধর্মীয় বক্তাদের আনা হতো। কিন্তু এখনকার কিছু কিছু ওয়াজ মাহফিল দেখলে সেটি মনে করার কোনও কারণ নেই। ঢাকায় বর্তমানে মিরপুরের যে এলাকায় থাকি সেখানেও একই অবস্থা।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদ জানান, ‘সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে থেকেই মাহফিলের অবয়ব পাল্টাতে থাকে। স্বাধীনতার পর মাহফিল ইসলামি ভাবগাম্ভীর্য থেকে বেরিয়ে আসে। আগে যারা ওয়াজ করতেন তাদের ইলম, আমল, ত্বাকওয়া সবই ছিল। তাদের কোনও ব্যবসায়িক চিন্তা ছিল না। নব্বই দশকের পর ওয়াজ মাহফিল বাণিজ্যনির্ভর হয়ে ওঠে। এখন এটি ব্যাপকতর আকার নিয়েছে।’
তার বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে মাওলানা শামসুল হকের কথায়। তিনি বলেন, ‘ওয়াজের বক্তাদের ফ্ল্যাট করতে বেশি সময় লাগে না। তিন দিনের বক্তাও ফ্ল্যাট কিনেছে ঢাকায়। একেক বক্তা ঢাকা শহরে কী ডাঁটে বাড়ি বানাইছে জানেন আপনারা?’ তরুণ লেখক মাওলানা সালাউদ্দিন জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘আমির হামজা, শরীয়তপুরী, তমুক জিহাদি এমন নামে ইউটিউবে ভাইরাল যেসব বক্তা আছেন, তাদের ওয়াজ কেউ ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য শোনে না। তাদের ওয়াজের মধ্যে কোনও দ্বীনি ফায়দা হবে বলে কেউ মনে করে না। তাদের ওয়াজ সবাই বিনোদনের জন্য শোনে।’
অতীতে ওয়াজের মধ্যে সামাজিক বিষয় উঠে আসতো। কিন্তু আমাদের যৌবনেও আমরা দেখেছি বক্তারা কীভাবে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে দর্শক শ্রোতার বাহবা আদায় করছেন। এখনো বাসার আশেপাশে বা ইউটিউবে যখন শুনি তখন দেখি অনেক বক্তা প্রথম কিছুক্ষণ মুসলিম জাহানের দুর্দশার কথা বলেন। বিভিন্ন দেশের প্রসঙ্গ টানেন। সে দেশের বিরুদ্ধে ‘হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা’ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে হুমকি দেন। আবার অনেকেই নারীদের অসম্মান করে বক্তব্য দেন। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো হয়তো কোনও গ্রামের মাওলানা গিয়েছেন ওয়াজ করতে, তিনি একই গ্রামের হিন্দু বা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মেয়েদের চলাফেরা নিয়ে নানা বর্ণনা দেবেন, গায়ের বসন-ভূষণ নিয়ে কথা বলেন এবং শেষে বলবেন এদের থেকে দূরে থাকতে। এগুলো যে কত বড় জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে, বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব বাড়িয়ে তোলে সেটি ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। আমার পরিচিত অনেককে দেখেছি, বাসা ভাড়া দিতে গিয়ে ধর্মভেদ, জীবন বাঁচানোর রক্ত নিতে গিয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামিটা জেঁকে বসেছে। এক শ্রেণির বক্তার বয়ানের প্রধান অংশই হয়ে ওঠে কবি চিত্রনায়ক ও গায়কদের নিয়ে বিষোদগার, যেটি সম্প্রতি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বা আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর দেখা গেছে। যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে, সংবাদপত্র বা বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়, তাদের মূলত এভাবেই অন্যদের সম্পর্কে কুৎসা রটিয়ে মোটিভেট করা হয়। এমন সব ছবি দেখানো হয় বা কথা বলা হয় যাতে একটা বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব তৈরি হয়। এখন কিছু কিছু বক্তার বক্তব্যে অপরাধ দর্শনের মৌলবাদকে উসকে দিচ্ছে।
একসময় যখন সারা দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল তখন সরকারের পক্ষ থেকে এমন একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বা নেওয়ার কথা উঠেছিল যে মসজিদের ইমাম বা মাওলানাদের ওয়াজের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ধারণা সৃষ্টি করবে। জাগরণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যারা এ ধরনের ওয়াজ করেন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া দরকার সবার আগে। কারণ এরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে বলেন, পহেলা বৈশাখের বিরুদ্ধে বলেন, বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বলেন এবং সবচেয়ে বেশি বলেন অন্য ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে। যেটি সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক মনোভাব।
সে কারণে সরকারের এদিকেও দৃষ্টি দেওয়ার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে যে জনগোষ্ঠী একটু অনগ্রসরমান তাদের মনে যদি একবার বিদ্বেষ তৈরি হয় সেটি ঘোচাতে বেশ সময় লাগে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে বলেছেন, এলাকায় এলাকায় ওয়াজ মাহফিলগুলোতে বক্তার বক্তব্যের দিকে কঠোর নজর রাখতে। কারণ অনেক বক্তাই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বলেন। যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন করে বক্তব্য দেন। ফেসবুকে এমন বক্তব্য যদি অপরাধ বলে গণ্য হয় তবে এ ধরনের উসকানিমূলক কাজও অপরাধের শামিল। আর অপরাধ বাড়ার আগেই থামাতে না পারলে সেটি আগামীতে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, সেটি সহজেই অনুমেয়।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক