বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন ২৬ বছরে দাঁড়িয়ে তখন তিনি তার সামনে পাচ্ছেন ভারতবর্ষের এই তিনজন রাজনীতিক- যাদের অবস্থান পৃথিবীজোড়া। আর এই ছাব্বিশ বছরের পর আর মাত্র ২২ বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেকে নিয়ে গেছেন আকাশজোড়া অবস্থানে। এই অবস্থানে পৌঁছাতে বঙ্গবন্ধু তার পূর্বসূরি এই বিশাল মাপের রাজনীতিকদের জীবন থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করেছেন বা গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি সেখান থেকে গ্রহণ করেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। যেমন, দেশবন্ধু রাজনীতিতে নেমে দেখলেন, তার নিজ প্রদেশে অর্থাৎ বেঙ্গলের রাজনীতির সবথেকে বড় সমস্যা হিন্দু-মুসলিম সমস্যা। নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলিম এক হলেও, ব্রিটিশের উসকানি, সামাজিক এবং আর্থিক বৈষম্য ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত একই নৃগোষ্ঠীকে দুটি মেরুতে নিয়ে গেছে। দেশবন্ধু প্রথমেই উপলব্ধি করলেন, ভারতবর্ষে রাজনৈতিক সুস্থিরতার জন্যে বেঙ্গলের হিন্দু মুসলিম উভয়ের যেমন একে অপরের আস্থা অর্জন প্রয়োজন তেমনি এ দুয়ের সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য দূর করে কথায় নয়, কাজের ভেতর দিয়ে একটি মিলন সৃষ্টি করা। দেশবন্ধুই বেঙ্গলের প্রথম রাজনীতিক যিনি উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ধর্মীয় রাজনীতি দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেও দ্রুত নিজেই সেখান থেকে নিজের উত্তরণ ঘটান। বিশেষ করে ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা দেখার পরে বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে উপলব্ধি করেন, সাম্প্রদায়িক কোনও রাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্য কোনও সমাধান নেই। তিনি তাই দ্রুত একজন একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে ওঠেন শরৎ বোস এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যুক্তবঙ্গ সৃষ্টির চেষ্টার। তাদের সে চেষ্টা সেদিন ব্যর্থ হলেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গতিপথ বদলে যায় পুরোপুরি। তিনি ১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর কলকাতার ছাত্রজীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন ঠিক, তবে ঢাকায় যখন আসেন তখন তিনি আর পাকিস্তানে বিশ্বাসী কোনও রাজনীতিক নন। তবে ছাব্বিশ বছরের এই তরুণ একটি পরিণত রাজনীতিকের মস্তিষ্ক নিয়ে পাকিস্তান কাঠামোর ও ধর্মীয় উন্মাদনার ভেতর খুবই শান্তভাবে প্রগতিশীল রাজনীতির বীজ বোনা শুরু করেন। শান্ত মাথায় শুরু করলেও তার গতি ছিল তীব্র। তিনি ১৯৪৯-এর ভেতর আধা অসাম্প্রদায়িক ও ১৯৫৭-এ এসে পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন শুধু গড়ে তোলেন না, চিত্তরঞ্জন ও সুভাষ বসুর পরে তিনিই আধখানা বেঙ্গলের প্রথম রাজনীতিক যিনি হিন্দু মুসলিম সকলের আস্থা অর্জন করতে শুরু করেন। এখানেই দেশবন্ধুর থেকে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাগ্রহণ ও তার পথ অনুসরণ করা। বঙ্গবন্ধু অনেক সংগ্রামের পথ পার হয়ে ১৯৬৯-এ পূর্ববাংলার সকল মানুষের একক নেতা হয়ে ওঠেন। আর এ সময়ে তিনি নেতাজীর রাজনৈতিক জীবনের একটি বিষয় খুবই গুরুত্বের সঙ্গে অনুসরণ করেন। তিনি সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, কেন নেতাজী ভারতীয় কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে ভারতের বাইরে গিয়ে সরকার গড়তে চেয়েছিলেন? নেতাজী যদি ভারতীয় কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করতে পারতেন তাহলে সারাবিশ্বে তখন ওই সরকারের অবস্থান হতো ভিন্ন। নেতাজী সে লক্ষ্যে অনেক চেষ্টা করেছিলেন ভারতীয় কংগ্রেসের দ্বিতীয়বার সভাপতি হতে- নির্বাচিতও তিনি হয়েছিলেন। থাকতে পারেননি। নেতাজীর রাজনীতির এই অধ্যায় থেকে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা নেন, তাকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামে যাওয়ার আগে নির্বাচিত নেতা হতে হবে। আর এই নির্বাচিত নেতা হওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সামরিক শাসকের অধীনে, বিশেষ সামরিক রীতিনীতি মেনে (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক বা এলএফও) নির্বাচনে যান। আর ওই এলএফও’র মধ্যে বসে নির্বাচন করে তিনি পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা হন। যে কারণে স্বাধীনতা ঘোষণা ও তারপরে গণতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন দুই তার পক্ষে ছিল আইনসিদ্ধভাবে। তার স্বাধীনতা ঘোষণা অনুযায়ী, নির্বাচিত নেতারা একটি স্বাধীন সরকার গঠন করতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। অন্যদিকে নির্বাচিত নেতাকে বন্দি করে ইয়াহিয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী বনে যান আর বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন।
নেতাজীর আন্দোলন থেকে যেমন এ শিক্ষা নিয়ে সফল পথে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমনি তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগের থেকেও শিক্ষা নেন। পৃথিবীতে গান্ধীর পরে সফল অসহযোগ আন্দোলন করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জয়প্রকাশ নারায়ণ অবশ্য বলেছেন, সফলতার দিক থেকে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আরো এগিয়ে। এমন সর্বাত্মক অসহযোগ পৃথিবীতে এর আগে আর কখনও হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনে দেখেছিলেন গান্ধীর অসহযোগ ও সুভাষ বসুর সশস্ত্র সংগ্রামের মিলন না ঘটার ফলে ভারতবাসীর ইচ্ছেমতো ভারত স্বাধীন না হয়ে ব্রিটিশের ইচ্ছেমতো বানরের পিঠা ভাগ হয়। এ কারণে বঙ্গবন্ধু তার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন ও তার পরবর্তী অধ্যায় হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য জাতিকে প্রস্তুত করেন। যার দিকনির্দেশনা তিনি দেন সাত মার্চের ভাষণে। একদিকে পূর্ণ অসহযোগ অন্যদিকে সশস্ত্র যুদ্ধের জাতিকে নির্দেশ। এবং অসহযোগ আন্দোলন শেষে সশস্ত্র আন্দোলনের ডাকও তিনি দেন। সফলও হয়েছিলেন তিনি।
আর এ কারণে এই উপমহাদেশের অতীতের সব মহান নেতাদের জীবন পরিপূর্ণতা পায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও কর্মের মধ্যে। বাস্তবে তাই দীর্ঘ সংগ্রামী চেতনার শীর্ষ বিন্দুই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত