মিডিয়ার শরীর ভালো নেই

স্বদেশ রায়সারা পৃথিবীতে মিডিয়ার শরীর ভালো নেই। গার্ডিয়ান তাদের প্রতিটি নিউজে অনুদান চাচ্ছে পাঠকের কাছে। এর থেকেই বোঝা যায়, নিউ মিডিয়ার ধাক্কায় প্রচলিত মিডিয়া কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার সোশ্যাল ফোরাম মিডিয়ার আকার নেওয়ায় নিউ মিডিয়া ধাক্কা খাচ্ছে। প্রচলিত টেলিভিশনকে যেমন আইপিটিভি চ্যালেঞ্জ করছে, তেমনি আইপিটিভি জায়গা নেওয়ার আগেই নানান ভিডিও ফোরাম তাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তাই বলা যেতে পারে, প্রযুক্তির ঘোড়ায় গাড়ি বেঁধে দিয়ে মিডিয়া এখন ছুটতে ছুটতে নিজেই ঘোড়া হয়ে মুখ দিয়ে লালা ঝরাচ্ছে হাঁফিয়ে। তবে মিডিয়া যতই হাঁফিয়ে উঠুক না কেন, প্রযুক্তির ঘোড়ায় তাকে ছুটতেই হবে। আর দৌড়ে তার পরিবর্তন আসবে, বেশি মানুষের কাছে যাবে। তবে সব সময়ের এই বৈশ্য পৃথিবীতে নিশ্চয়ই মিডিয়াকে আয়ের একটা পথ বের করে নিতে হবে, অনুদান তার বেঁচে থাকার কোনও পথ নয়। এই বেঁচে থাকার পথের প্রথম সোপানটি হলো আরও বেশি ইনফরমেশনের চাহিদার পৃথিবী তৈরি করতে হবে। মিডিয়ার ইনফরমেশনের বৈচিত্র্য নানামুখী করতে হবে। বাড়াতে হবে মানুষের নলেজের চাহিদা, বাড়াতে হবে পড়ার আকুতি নিজ নিজ মনোজগতে। প্রযুক্তির এই বিস্তারের সঙ্গে মানুষের মনোজগতের বিস্তারও ঘটাতে হবে তথ্য ও জ্ঞানকে ঘিরে। মিডিয়া আসলে সমাজেরই অংশ। সমাজ গোটা শরীর, মিডিয়া তার একটি পার্টস। তাই মিডিয়ার শরীর খারাপ হলে গোটা সমাজ নিয়েই ভাবতে হবে।

যেমন- রাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় বৈচিত্র্য এ তিন বিষয়ও সমাজের অংশ। যদিও এখন কারও কারও মতে, এই মুহূর্তে সমাজ বলে কিছু নেই। রাষ্ট্র তাকে গ্রাস করেছে। এখানে আমার মত একটু ভিন্ন। আমি মনে করি সমাজের রূপ ও ধরন বদলে গেছে। কাচের বদলে সে হীরে হয়েছে। তাতে আলো এত ঠিকরে পড়ে যে তাকে দেখা যায় কম। তাই রাষ্ট্রকেই বড় মনে হয়। বাস্তবে রাষ্ট্র কেবল সমাজকে একীভূত করে সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। তবে রাষ্ট্রকে এই পরিচালনার ধরন ঠিক করতে হয় সমাজের চরিত্র অনুযায়ী।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব সমাজেই সহনশীলতা কমে গেছে। সহনশীলতা কমে গেলে সমাজ স্বাভাবিকভাবে অনুদার হয়। সমাজ অনুদার হলে রাষ্ট্রও স্বাভাবিকভাবে অনুদার হয়ে পড়ে। কারণ, সমাজের প্রকৃতি থেকে রাষ্ট্রের প্রকৃতি কখনোই ভিন্ন হতে পারে না। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রনায়ক এমনকি নায়কগণও যদি হন, তারাও পারেন না রাষ্ট্রকে সমাজের প্রকৃতি থেকে ভিন্ন রাখতে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ কেমন ছিল, সে বিতর্কে না গিয়ে বলা যায়, এ মুহূর্তে পৃথিবীতে সবচেয়ে উদার সমাজ হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজ। উদার রাষ্ট্র হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবে এই দুইয়ের উপস্থিতি কি এখন পৃথিবীতে আছে?

এ মুহূর্তে মোটা দাগে দেখলে অনেক রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যাবে। কিন্তু বাস্তবে এ মুহূর্তের পৃথিবীতে নির্বাচনকে ভিত্তি করে কিছু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আছে ঠিকই, তবে তারা কেউ গণতন্ত্রের যে মূল শর্ত অর্থাৎ উদারতা, সেটা পূর্ণ করে না। বরং পৃথিবীতে দিকে দিকে গণতন্ত্রের নামে যারা অনুদার হয় তারা সরাসরি গণতন্ত্রের ভোটের সিস্টেমে বিজয়ী হচ্ছে, না হয় অনুদারদের সঙ্গে আপস করে বিজয়ী হচ্ছে উদাররা। এমনকি গণতন্ত্রের মাতৃভূমি ব্রিটেনেও এখন অনুদার ব্রেক্সিটের জয়ডঙ্কা।

মিডিয়া সমাজের উদারতার একটি ফসল। সমাজের উদারতার ফসল হিসেবে যেমন গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছে, তেমনি সমাজের উদারতার আরেক ফসল হিসেবে মিডিয়ার জন্ম হয়েছে। এ কারণে উদার গণতন্ত্র ও মিডিয়া একে অন্যের পরিপূরক। আর গণতন্ত্র যখন রাষ্ট্রের বাহন, রাষ্ট্র যখন সমাজের পরিচালক, সে সময়ে উদার গণতন্ত্র না থেকে যদি অনুদার গণতন্ত্র এসে তীরে ভিড়ে, তাহলে মিডিয়ার শরীর ভালো থাকবে কীভাবে?

বাস্তবে অনুদার গণতন্ত্র বলে কিছু নেই। কট্টরপন্থার ভদ্রস্থ নাম দিয়েছি আমরা অনুদার গণতন্ত্র। এটা গণতন্ত্রের  না হোক, রাষ্ট্রের একটি আপস। রাষ্ট্র তার কিছু লোককে বেশি ক্ষমতা দেওয়ার জন্য হোক আর কোনও ধরনের পুঁজিকে বেশি সুবিধা দেওয়ার জন্য হোক, এই আপস করে অসুস্থ গণতন্ত্রের নাম দিয়েছে অনুদার গণতন্ত্র। এই অনুদার গণতন্ত্রের সঙ্গে বর্তমান পৃথিবীর মুক্তবাজার পুঁজির একটি চমৎকার বিয়ে হয়েছে। আর সে সংসারটি এতদূর এগিয়ে গিয়েছে যে, আমরা এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি বা কেউ কেউ ইচ্ছে করে বলছি,  উন্নয়নের জন্যে অনুদার গণতন্ত্রের প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তা দেখাতে গিয়ে উদার গণতন্ত্রকে তুলনা করছি স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে। স্বেচ্ছাচারিতা, নৈরাজ্য  আর উদার গণতন্ত্রের মধ্যে অনেক পার্থক্য। স্বেচ্ছাচারিতা ও  নৈরাজ্য অসংস্কৃত আর উদার গণতন্ত্র (যা প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র) সংস্কৃত।

সব প্রাচীনপন্থার ভেতর একটা অসংস্কৃত চরিত্র আছে। সেটাকে সামনে নিয়ে এসে গণতন্ত্রের চরিত্র নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। সব মাতাল পুঁজির ভেতর একটা অসংস্কৃত আচরণ বা চরিত্র আছে, সেটাকে জোর বেগে ছুটতে দেওয়ার জন্য গণতন্ত্রকে করা হচ্ছে সর্বোচ্চ অনুদার। আর এই অসংস্কৃত প্রাচীনপন্থা ও মাতাল পুঁজি; দুই মিলে সমাজকে প্রতিমুহূর্তে করছে যথেষ্ট অনুদার আর এরই প্রতিফলন ঘটছে রাষ্ট্রে ও পৃথিবীতে।

এ রকম একটা অনুদার সময়ে আর যাই হোক মিডিয়ার স্বাস্থ্য কোনও মতে ভালো থাকতে পারে না। মিডিয়ার এই শরীর খারাপ এটা সময়েরই বাস্তবতা। এখন প্রশ্ন হলো, মিডিয়ার এই শরীর খারাপের চিকিৎসা কে করাবে? ভবিষ্যৎ বড়ই অস্বচ্ছ। সেখানে দেখা যায় না কিছু। তবে এই বলে ভবিষ্যৎ নিয়ে অংক করা থেমে থাকেনি কখনও। সে অংক কষতে বসলে বলা যায়, যে প্রযুক্তিকে দৃশ্যত মনে হচ্ছে প্রচলিত মিডিয়ার শরীর খারাপ করে দিচ্ছে; সে-ই ভাঙচুর করে মিডিয়াকে সুস্থ করবে। তাই মিডিয়াকে সুস্থ করার জন্য এখন নতুন মিডিয়াকে স্বাগত জানানো দরকার সবার আগে। বাংলা ট্রিবিউন নতুন মিডিয়া, অনলাইন নিউজ পোর্টাল। তাই তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাকে স্বাগত জানানোর অর্থই হলো মিডিয়ার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারকে খোঁজা।

লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত