সংবাদমাধ্যম থেকে জানলাম, ১৬ জুলাই পুলিশ নিয়ে নোয়াখালী পৌর পার্কে অভিযানে যান এই সংসদ সদস্য। সে সময় অনেক তরুণ-তরুণীকে আটক করা হয়। এদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং ডাকা হয় অভিভাবকদের। কোন আইনে তিনি সেটা করলেন তা অবশ্য বোধগম্য নয়। ধরে নিলাম, একরামুল করিম চৌধুরীর ভাষায়, এই ছেলেমেয়েরা স্কুল ফাঁকি দিচ্ছিল, তারা অশালীন আচরণ করছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তাদের ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করাও এক ধরনের অপরাধ। এখন সংবাদমাধ্যমগুলোও বড় ধরনের বা প্রমাণিত না হলে অপরাধীর ছবি প্রকাশ করে না। আর তিনি সৎ উদ্দেশ্যে এই কাজ করেছেন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই তরুণ-তরুণীদের ছবি ছড়িয়ে দেন। (পরে অবশ্য ছবিগুলো ঢেকে দেওয়া হয়)।
সন্তানের খবর নিতে অভিভাবকদের পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি তিনি লেখেন, ‘স্পষ্টভাবে বলছি, স্কুল-কলেজ চলাকালীন কোনও শিক্ষার্থী পার্কে ঘুরাঘুরি করলে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে শাস্তি প্রদান করবে।’ পুলিশ কি শাস্তি দেওয়ার মালিক? পুলিশ কোন আইনে শাস্তি দেবে। বাংলাদেশের আইনে কোথায় আছে যে কেউ স্কুল পালালে তাকে পুলিশ শাস্তি দিতে পারবে? স্কুল কলেজ চলাকালীন কোনও শিক্ষার্থী পার্কে ঘোরাফেরা করলে পুলিশ শাস্তি প্রদান করবে- এই ফতোয়াই বা তিনি কীভাবে দেন। একথা ঠিক যে সন্তানকে দেখভালের দায়িত্ব অভিভাবকের। কিন্তু একরামুল করিম কি নিজের সন্তানের প্রতি অতোটা খেয়াল রাখতে পারেন। যদি সেটাই হতো, গেলো বছর ১৯ জুন রাত সাড়ে দশটার দিকে মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপরে তার ছেলে শাবাব চৌধুরীর গাড়ি বেপরোয়া গতিতে সেলিম ব্যাপারী নামের একজনকে চাপা দিয়ে দ্রুত বিজয় সরণির দিকে পালিয়ে ন্যাম ভবনে ঢুকে যায়, তখন তিনি করতে পেরেছেন। এ সংবাদ বাংলা ট্রিবিউনসহ অনেক সংবাদমাধ্যমে তখন প্রকাশ হয়েছিল। তখন কিন্তু আমরা সন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখেছি। আমাদের দেশে ‘উল্টো শাসনের’ কারণে অনেক কিছুই মীমাংসা হয়ে যেতে হয়।
এই যেমন সময়, সমাজকে সুন্দর না করে, অপরাধীকে শুধরানোর বা অপরাধী তৈরি হওয়ার মনন ধ্বংস না করে আমরা ধ্বংস করে দেই অপরাধীকে। সে কারণে নয়ন বন্ড ‘ক্রসফায়ারে’ পড়ে মরে। গবেষক শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা করায় তাকে তিরস্কার করা হয়, কেউ ব্যাংকের দেনা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। আর কেউ পুরো ব্যাংক খাতটাই ধ্বংস করে দেয়। নিম্নমানের মশার ওষুধে মশা মরে না অথচ মেয়রদের আস্ফালনে স্বয়ং বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করেন। দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসে অথচ বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না। পুলিশ সত্যি অপরাধীদের ধরতে পারে না। পারে শুধু নিরীহ প্রেমিক প্রেমিকাদের ধরতে, যারা পার্কে, বেঞ্চে এখানে সেখানে একটু নিভৃতে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে চান।
এমপি একরামের অভিযানের পর তার বিরুদ্ধে যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা উঠেছে। আবার অনেকে বলছেন, নোয়াখালীর এই পার্কটির পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। সে কথা হয়তো সত্য। শুধু নোয়াখালী কেন, দেশের বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনের কারণে। এখন অনেক পার্কে মদ, গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদক বিক্রি হয়। বখাটেদের কারণে যাওয়া যায় না। যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ, ভাসমান যৌনকর্মী থেকে শুরু করে পার্কের জায়গা দখল করে অনেকে বসবাসও করছে। সেদিকে কিন্তু প্রশাসনের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং মাসোহারা চুক্তিতে সেখানে দফা হয়ে আছে। চলতি মাসের শুরুতে ফরিদপুরের পার্ক থেকে অনেককে আটক করা হয়। এরমধ্যে আবার নিরীহ প্রেমিক প্রেমিকাও ছিল। মাঝে মাঝে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের পার্ক, হোটেলে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু এসব তো সমাধান নয়। আমরা বরং যদি সমাজটা সুন্দর করতে চাইতাম এলাকায় এলাকায় গিয়ে পরামর্শ দেওয়া হতো সন্তান থেকে শুরু করে অভিভাবকদের। পার্ক সুন্দর রাখা যাদের দায়িত্ব তারা সচেতন হলেই পরিবেশ সুন্দর হবে। আর প্রেম সে তো সহজ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ নিয়ে শিক্ষাটা বরং পরিবার, স্কুল বা সমাজ থেকে হলেই সেটি সুন্দর হতে পারে। এখানে সেখানে যুগলদের দৌড়ানি দিলেই কি সমাজ সুন্দর হবে?
আর চারদিকে নগরায়ণের ফলে স্থান যেভাবে সংকুচিত হচ্ছে তাতে মাদকের পেছনে না ঘুরে পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা নিয়ে চললে সেখানে তো ক্ষতি নেই। বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্ক কেউ যদি স্বাধীনতায় চলতে চায় তবে বাধা দেওয়ার উপায় তো নেই। আর এরাই তো তরুণ প্রজন্মের ভোটার। তাই ভোটারের মনও বুঝতে হবে। ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসা দিতে হয়। জোর করে অবদমন করলে বরং অশান্তির পথই প্রশস্ত হবে। আর মানুষের মন যতদিন না প্রেমিক হৃদয় হয়ে উঠবে ততদিন পৃথিবীতে হানাহানি বন্ধ হবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।