আগাম টিকিট দেওয়ার হিসেবে এবারের ঈদযাত্রা ৭ আগস্ট থেকে শুরু হলেও মূলত পরদিন বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন লোকজন। লোকজন কোরবানির মাংস নিয়ে স্বজনদের কাছে যাচ্ছেন। ৯ আগস্ট বৃষ্টির কারণে ভোগান্তি বেড়ে যায় বহুগুণ। এরপর থেকে তো পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সড়ক ও রেলপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এবারও নয় দিনের ছুটি কাটাচ্ছেন অনেকে। কারণ, ১৪ আগস্ট ঐচ্ছিক ছুটি নিলে ১৫ আগস্টের ছুটি মিলিয়ে ফের অফিস শুরু ১৮ আগস্ট। কিন্তু যাত্রী চাপ বেশি ছিল ১০ ও ১১ আগস্ট। এরমধ্যে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গাড়ির চাপে যে বেহাল দশা হয়েছে তা আর বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। একমাত্র ভুক্তভোগীরা জানেন। অন্য মহাসড়কগুলোর অবস্থাও ভালো ছিল বললে ভুল হবে, তবে সেখানে যানজট ছিল অপেক্ষাকৃত কম। এরমধ্যে ফেরিঘাটের অবস্থাও ছিল যাচ্ছেতাই। আগে থেকে প্রস্তুত রাখা ফেরিগুলোও যানবাহনের চাপ সামাল দিতে পারছিল না।
কিন্তু স্মরণাতীতকালের সব রেকর্ড যেন ভেঙে দিয়েছে রেলপথ। সড়কপথের বিড়ম্বনা তো রয়েছেই। রেলপথের যাত্রীদের খুশির ঈদযাত্রা রূপ নিয়েছে দুঃস্বপ্নে। প্রতিটি ট্রেনই ছেড়েছে ৫ থেকে ১০ ঘণ্টা দেরিতে। এমনও দেখা গেছে, যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেশনে অপেক্ষা করে আছেন। আর আজকে যে ট্রেন ছাড়ার কথা সেটা ছেড়েছে কাল। এরমধ্যে বাস বা ট্রেন স্টেশনগুলোতে মশার উৎপাত, যেহেতু এবার ডেঙ্গু জ্বরের কারণে এডিস মশার আতঙ্ক ছিল, সে আতঙ্ক ভর করেছে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ওপর। এরপর ট্রেন এলে টিকিট বা সিটের বালাই বাদ দিয়েই বগির চেয়ে বেশি মানুষ হয়েছে ছাদে। নিরাপদ ট্রেনযাত্রার স্বপ্ন সেখানে দূর-অস্ত। ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা ক্লান্ত মানুষের ভিড় আনন্দের ঈদযাত্রা মুহূর্তেই রূপ নিয়েছে বিষাদে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ঈদের দিনের বিশেষ ট্রেনের যাত্রা বাতিল করতে হয়েছে এবং সেদিন যে কোনও ট্রেন চলবে না সেটিরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কারণ, রেল সচিব অন্তত এটা বুঝেছেন, ঈদের আগে মানুষগুলো ঘরে পৌঁছাতে না পারলে ক্ষোভ আরও বাড়বে। তাই ঈদের আগের দিন কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে শুক্রবার সুন্দরবন এক্সপ্রেস বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বে লাইনচ্যুত হওয়ার কারণকে দায়ী করে দুঃখ প্রকাশ করে আগামীতে শিক্ষা নেবেন বলে জানিয়েছেন।
এর আগে কয়েক দিন রেলস্টেশন ঘুরে যাওয়া রেলমন্ত্রীকে আমার বেশ অসহায় মনে হয়েছে। এরমধ্যে মাঝে মাঝে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ‘মাথা ঠিক রাখতে না পারার’ মতো অবস্থাও তৈরি হয়েছে।
সাধারণভাবে জানা কথা, ঈদুল ফিতরের চেয়ে ঈদুল আজহায় মানুষ বেশি ঢাকা ছাড়ে। তাই আগে প্রস্তুতি নেওয়াটাই সারকথা। কিন্তু প্রতিবার সে প্রস্তুতিতে ঢিলেমি দেখা যায়। দেখা যায় কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা, উদাসীনতা বা অব্যবস্থাপনা। এর সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করলেন ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের পথে পথে চাঁদাবাজি। সেটিও কারণ। তাছাড়া এবার সবাই ডেঙ্গু নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে ঈদযাত্রা নিয়ে সঠিক কর্মপরিকল্পনা করা হয়নি। একইসঙ্গে রাস্তাঘাটে হাট বসানোও ঠেকানো যায়নি। ট্রেনযাত্রার ক্ষেত্রে বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন ঈদের আগে মেরামতের যে আশ্বাস মন্ত্রী দিয়েছিলেন সেটা রাখতে পারেননি। চরম দুর্ভোগের সময় মন্ত্রী-সচিবেরা জনগণকে নানা কথা বলে আশ্বস্ত করেন। শিক্ষা নিয়ে প্রতিকারের কথা বলেন। আগামীতে এমনটি আর হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। জনগণকে বোকা ভেবে বোকা বানানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সময় পার হলে আবার ভুলে যান। আবারও ঈদ আসে। সবকিছু বদলে যায় কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ আর কমে না। এবারের অভিজ্ঞতায় মনে হলো দুর্ভোগ আরও বাড়ে। অথচ নগর পরিকল্পনাবিদরা, পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সাজেশন দেন কীভাবে এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা এসব থোড়াই কেয়ার করেন। আর ঈদের আনন্দ শেষে আমরাও ভুলে যাই পথের ক্লান্তি, বিড়ম্বনা, ঈদযাত্রার ভোগান্তি।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক