আমি কিন্তু ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কয়েকটি পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স আর ব্যক্তিগত আগ্রহে সামান্য কিছু পড়াশোনা ছাড়া এই বিষয়ে আমার কোনও দক্ষতা নেই। সামান্য পড়াশোনার একপর্যায়ে পশ্চিমে ম্যানেজমেন্ট গুরু হিসেবে পরিচিত পিটার ড্রাকারের নাম জেনেছি। তার এ ধরনের প্রসিদ্ধ উক্তি Management is doing things right; leadership is doing the right things ইত্যাদি অন্য সবার মতো আমিও শুনেছি।
তবে পত্রিকা তো আর তত্ত্ব আলোচনার জায়গা নয়। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে কেন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা সফল হতে পারছি না? বেশ কয়েক বছর থেকেই দেশের মানুষ একটি বিশেষ সময়ে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি রোগে ভুগছে, মারা যাচ্ছে। কিন্তু যারা ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্বে আছেন তাদের ঝুঁকি নিরূপণে ভয়াবহ ব্যর্থতা অমার্জনীয়।
আসলে কোন সমস্যা রেখে কোনটার কথা বলবো। পত্রিকায় দেখলাম ইউজিসি ২৯টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে নোটিশ দিয়ে জনগণকে সতর্ক করেছে। অথচ তারাই একসময়ে এদের অনুমতি দিয়েছে। এখন জনগণ এতে চরম বিভ্রান্ত হবে। যারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সেখানে পড়ছে তাদের মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়। একই অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজ নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন তাদের না পারছে গিলতে না পারছে উগরাতে। মাঝখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।
এগুলোর পিছনে যে একেবারে রাজনীতি নেই তা আমি বলছি না। কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত ব্যর্থতা রয়েছে অনেকাংশে। প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপকদের ভবিষ্যতের ঝুঁকি নিরূপণ বা রিস্ক অ্যানালিসিস এবং সেইক্ষেত্রে কৌশল বা স্ট্রাটেজি নির্ধারণের ক্ষেত্রে রয়েছে জ্ঞানের অভাব।
আমি যতটুকু জেনেছি যে প্রতিটি উন্নত দেশে আর্থসামাজিক অবস্থা বা সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে সে দেশের ম্যানেজমেন্ট স্টাইল বা ব্যবস্থাপনার ধরন গড়ে ওঠে। শুধু উন্নত দেশের কথা বলছি কেন। উন্নয়নশীল দেশ হলেও ভারতীয় ব্যবস্থাপকদের খ্যাতি এখন বিশ্বজোড়া। আমি বেশ কিছু দিন আগে বাংলা ট্রিবিউনে এ সম্পর্কিত একটি কলামও লিখেছিলাম।
কিন্তু আমাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কোথায়? তার চেয়েও বড় বিষয় যেটি আমাদের ব্যবস্থাপনার আলাদা কোন ধরন বা মডেল বা দর্শন আছে কি? এই যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার বিজনেস গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে তাতে দেশের ব্যবস্থাপনার কি পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে?
বলাবাহুল্য, আমি এ দেশের ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তেমন কোনও সদুত্তর পাইনি। তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বতন্ত্র কোনও ব্যবস্থাপনার স্টাইল নেই। টেক্সট বইয়ে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশের ম্যানেজমেন্ট স্টাইল এবং বিজনেস মডেল পড়ানো হয়, সেটা অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়।
যেমন প্রথমেই শিক্ষাক্ষেত্রের কথা বলা যেতে পারে। আমাদের দেশে পিইসি বা জেএসসি পরীক্ষার ধারণা কোথা থেকে এসেছে তা বলা মুসকিল। সম্ভবত থাইল্যান্ড থেকে। সেখানে ক্লাস সিক্সে এবং নাইনে এ ধরনের পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি আছে। কিন্ত বাংলাদেশ বিশাল জনসংখ্যার একটি দেশ। এসব পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা যেমন কঠিন তেমনি তা অভিভাবকদের জন্য বিশাল দুর্ভোগ বয়ে আনছে।
বর্তমান বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থা লক্ষ করলে দেখা যায় যে দিনে দিনে সব পর্যায়ে শিক্ষা পদ্ধতি flexible হচ্ছে। শিক্ষায় বয়স, স্থান আর সময়ের বাধা অতিক্রম করা হচ্ছে। আমাদের দেশের রয়েছেন লক্ষ লক্ষ প্রবাসী। বিদেশে যাচ্ছেন, আসছেন। অনেক প্রবাসীই তাদের ছেলেমেয়েদের এসব পরীক্ষা নিয়ে বিপাকে পড়েন। এরপর তো রয়েছে ডেঙ্গু, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা নির্বাচন ইত্যাদি। এসব কারণে উচ্চ মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত কেউই আর তাদের ছেলেমেয়েদের বাংলা দেশীয় মাধ্যমে পড়াতে চান না। ঢাকায় ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা তাই প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমরা যদি খেয়াল করি তাহলে দেখবো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হায়ার অ্যান্ড ফায়ার। দুঃখজনক হলো বাংলাদেশের বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান পশ্চিমা ম্যানেজমেন্টের এ ধারণা এ দেশে বাস্তবায়িত করেন।
কিন্তু তারা ভুলে যান যুক্তরাষ্ট্রে যে সোশ্যাল সিকিউরিটি আছে তাতে কারও চাকরি গেলে পরিবারে বেঁচে থাকার সমস্যা নেই। কিন্তু বাংলাদেশসহ অনেক তৃতীয় বিশ্বের দেশে কারও চাকরি যাওয়া মানে মোটামুটি না খেয়ে থাকা, বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া। ঢাকায় কর্মরত একজন ছোট চাকুরে যখন চাকরি হারান তখন তাকে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ছাড়তে হয়।
এ বছর ডেঙ্গু যখন প্রায় মহামারির পর্যায়ে যাচ্ছে তখনও আমরা দেখছি ব্যবস্থাপনার চরম দুর্বলতা। একদিকে মানুষ মরছে আর অন্যদিকে কোন ওষুধ কেনা হবে তা নিয়ে চলেছে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা। এডিস মশা মূলত বাসাবাড়িতে বেশি হয় সে জন্য দরকার ছিল কার্যকর অ্যাডভোকেসি কর্মসূচি। কিন্তু জনগণ তো বিভ্রান্ত। এতদিন তো মানুষকে বাসায় ছাদবাগান, মাছ আর কোয়েল পাখির চাষ করতে বলা হয়েছে। এখন আবার কোথাও পানি যাতে না জমে সে কথা বলা হচ্ছে।
ঘনবসতিপূর্ণ একটি মেগাসিটিতে ছাদে বাগান করার পরামর্শ দেয়ার আগে কি পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া হয়েছে? অবশ্যই নয়। পত্রিকায় পড়লাম, ঢাকা সিটি করপোরেশনে একজনই মশা বিশেষজ্ঞ ছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে তারও নাকি বেতন বন্ধ করে দেয়া হলে তিনি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
ব্যাংক বা শেয়ারবাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। তবে বেশ কিছু দিন আগে একটি বিদেশি সংস্থায় কর্মরত অর্থনীতিবিদ আমাকে বলেছিলেন, দুর্নীতি তো আছেই, কিন্তু অর্থনীতির শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের জ্ঞান ও দক্ষতার ঘাটতি কিন্তু বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কম দায়ী নয়। যেমন, এবারের কোরবানির ঈদের চামড়া নিয়ে বিপর্যয়ে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনার দক্ষতার ঘাটতি মূলত প্রতিভাত হয়েছে।
তবু আমরা আশাবাদী হতে চাই। সব ক্ষেত্রেই যে আমরা অসফল তা তো নয়। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের সফলতা আছে। গার্মেন্টস শিল্পে বিদেশিদের চাপাচাপিতে মোটামুটি শৃঙ্খলা এসেছে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ একটি খুবই উত্তম পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে একেবারে অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ অনেকাংশে বন্ধ করা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও এ পদ্ধতি চালু করা উচিত।
এখন সময় হয়েছে দেশে বিদেশে ব্যবস্থাপক হিসেবে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন সেসব বাঙালিকে বিভিন্ন সেক্টরের অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে কাজে লাগানো, তাদের উপদেশ শোনা। এ লেখার শুরুতেই আমি ম্যানেজমেন্ট গুরু পিটার ড্রাকারের কথা বলেছিলাম। সৌভাগ্যের বিষয় যে পিটার ড্রাকারের মৃত্যুর পরে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বে যিনি বর্তমানে ম্যানেজমেন্ট এবং কোয়ালিটি গুরু হিসেবে পরিচিত, যার বই মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে, তার নাম সুবীর চৌধুরী, তিনি একজন বাংলাদেশি।
সুবীর চৌধুরীর কিছু লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে, ম্যানেজমেন্টের মতো জটিল বিষয়কে তিনি সাধারণ কথাবার্তা আর উপদেশের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ; মনে হয়েছে প্রাচ্যের মূল্যবোধগুলোকেই তিনি পশ্চিমা সমাজে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সেজন্য তার বইগুলো বিভিন্ন দেশে হয়েছে বেস্ট সেলার।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের শীর্ষ নীতিনির্ধারক বা ব্যবস্থাপকরা কি এ ধরনের বিশেষজ্ঞদের কথা শুনবেন বা পরামর্শ নেবেন? আমাদের এতদিনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তো তা বলে না।
লেখক: কলামিস্ট
ইমেইল: shamsulbkk@gmail.com