X
শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
২৫ মাঘ ১৪৩১

ডিজিটাল যুগ ও মিডিয়া লিটারেসির অপরিহার্যতা

মো. সামসুল ইসলাম
০৫ জুলাই ২০২৪, ১৯:২১আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৪, ১৯:২১

রাসেল ভাইপার সাপ নিয়ে মিডিয়ার প্রচারণা এবং দেশব্যাপী জনগণের উদ্বেগের কারণে আবারও আমাদের দেশের জনগণের মিডিয়া লিটারেসি বা গণমাধ্যম সাক্ষরতার দুর্বলতা বা অভাব অনুভূত হয়েছে। দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে হয়তো সাপের উপদ্রব থাকতে পারে। কিন্তু মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণার কারণে দেশের শহরাঞ্চলের মানুষ যদি মনে করা শুরু করে যে তাকে সাপে কামড়াতে পারে এবং তার বুট জুতা পরে হাঁটা উচিত, তাহলে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে তাদের মিডিয়ার ব্যাপারে জ্ঞানের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।

এই ডিজিটাল যুগে দেশের সব নাগরিকের তথ্য প্রাপ্তি, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের দক্ষতা থাকতে হবে। সকাল থেকে শুরু করে রাতে ঘুমুতে যাওয়া পর্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ তথ্য পাচ্ছেন। এই বিশাল তথ্যের মধ্যে নেভিগেট করা এবং সেখান থেকে সঠিক তথ্য বাছাই করার ক্রিটিক্যাল ইভালুয়েশনের ক্ষমতা আমাদের দেশের সাধারণ জনগণের নেই।  

মিডিয়ার একজন শিক্ষক হিসেবে মিডিয়ায় বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণ কীভাবে এনগেইজড হচ্ছে তা আমাকে ভালোভাবে লক্ষ করতে হয়। প্রচুর ভিডিও দেখতে হয়। বিভিন্ন পোস্ট বা বিজ্ঞাপনে সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া দেখি। আশপাশের মানুষের জীবনযাত্রা দেখলেই তো বোঝা যায় মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।  

পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমার প্রাপ্তি ভয়াবহ। আমি দেখছি সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, মোটিভেশনাল স্পিকারদের বক্তব্য, অনলাইনে বিভিন্ন চিকিৎসা ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ জনগণ চরমভাবে প্রতারিত হচ্ছে। অনলাইনে ডাক্তারদের কথায় প্রভাবিত হয়ে বিশেষ ডায়েট ফলো করে হাসপাতালে ভর্তির কথা শুনেছি। কারও কিডনি বিকলের উপক্রম হয়েছে, কারও মাথার চুল পড়ে গিয়েছে।

অসংখ্য মানুষ মরিঙ্গা পাউডারের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা, অ্যাপল সিডার ভিনেগার আর মধু দিয়ে তৈরি রেমেডি জুসের মাধ্যমে হার্টের ব্লক অপসারণের কাহিনি বিশ্বাস করছেন এবং দেদার কিনছেন। কিন্তু ইন্টারনেটে একটু সার্চ করলেই সব ওষুধ বা ডায়েটের ভালোমন্দ জানা যায়। সেই জ্ঞান তো আমাদের সাধারণ জনগণের নেই।

তরুণদের ফ্রিল্যান্সার ট্রেনিং, লিডারশিপ ট্রেনিং, করপোরেট গ্রুমিং ইত্যাদির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা ইনকামের রাস্তা দেখানোর জন্য অনলাইনে কতজন যে সক্রিয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কম্পিউটার সম্পর্কিত অনলাইনে একটা কোর্সে ভর্তি হয়েছে এমন একজনের কাছে একটি অদ্ভুত তথ্য পেলাম। ফ্রিল্যান্সিং, চাকরি, ইন্টার্নশিপ ইত্যাদির প্রলোভনে হাজারের ওপর তরুণ তরুণী সেখানে ভর্তি হয়। তারপর একে একে সবাই কোর্সটি ছাড়তে থাকে। কিছু দিনের মধ্যেই হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র টিকে থাকে। সবার মোহভঙ্গ হয়।

আমি চিন্তা করছি কোর্সটি থেকে সেই প্রতিষ্ঠান কত আয় করেছে আর কত মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণ তরুণীর পরিবারের অর্থনাশ হয়েছে।

সবাই আসলে মিডিয়ায় মোটিভেশনাল স্পিকারদের One-Size-Fits-All ধরনের সাজেশন বিশ্বাস করছেন, বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কোভিড পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ ইত্যাদির কারণে বিভিন্ন দেশে মোটিভেশনাল স্পিকার, মোটিভেশনাল বই ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা, স্বাস্থ্যের অবনতি, ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা, দক্ষতা বৃদ্ধি ইত্যাদির জন্য মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর মিডিয়া বিষয়ক জ্ঞানের অভাবে তারা অহরহ প্রতারিত হচ্ছেন চটকদার কথায়।

বলা বাহুল্য ফেক নিউজ, মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন এই ব্যাপারগুলো আমাদের দেশে এখন সাংবাদিকতা এবং অ্যাকাডেমিয়াতে বহুল আলোচিত। মিডিয়াতে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং তারা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গেই মিডিয়ায় বিভিন্ন ভাইরাল বা সেনসেশনাল ইস্যুর যথার্থতা নির্ণয় করছেন। এছাড়া রয়েছে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের অ্যাডভোকেসি ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা।  

কিন্তু এসব পদক্ষেপ মিডিয়ার ব্যাপকতা সম্পর্কে জনগণকে জ্ঞানদানের জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়। মিডিয়া লিটারেসির শিক্ষাদানের জন্য একটি সামগ্রিক কর্মসূচি নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা উন্নত দেশগুলোর মডেল পর্যালোচনা করতে পারি।  

উদাহরণস্বরূপ ফিনল্যান্ডের কথা বলা যেতে পারে।  ইউরোপিয়ান মিডিয়া লিটারেসি ইনডেক্স ২০২৩-এ ফিনল্যান্ড শীর্ষস্থান অধিকার করেছে। এরপর রয়েছে ডেনমার্ক ও তৃতীয় স্থানে নরওয়ে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে দিকপাত করলে দেখা যায় সেখানে মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষা তাদের সার্বিক কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত। আমি যুক্তরাষ্ট্রের এক অধ্যাপকের সাক্ষাৎকার থেকে জানলাম যে ফিনল্যান্ডে একেবারে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বিভিন্ন ধরনের মিডিয়ার বিশ্লেষণ, ভুয়া নিউজ শনাক্তকরণ শেখানো হয়ে থাকে। শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে এবং প্রতিটি বিষয়ে– গণিত থেকে সামাজিক বিজ্ঞান পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়েই মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষা দেওয়া হয়। এটিকে আলাদা একটি বিষয় হিসেবে শেখানো হয় না, যেটা বেশিরভাগ দেশেই হয়ে থাকে। এটি আমার কাছে বেশ অবাক করা তথ্য মনে হয়েছে।

বাংলাদেশের নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নাকি ফিনল্যান্ডের আদলে করা হয়েছে। এবং এখানে নাকি মিডিয়া লিটারেসি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমার ভুল হতে পারে তবে আমি মাধ্যমিক পর্যায়ের কারিকুলামের কয়েকটি বই নাড়াচাড়া করে মিডিয়া লিটারেসি নিয়ে খুব কম্প্রিহেন্সিভ কিছু দেখলাম না। উচ্চ মাধ্যমিকের আইসিটি বইও দেখলাম। সেখানেও একই অবস্থা।

বিচ্ছিন্ন কিছু থাকলেও আমি উপরে যেসব সমস্যার কথা বলেছি এ ধরনের ভুয়া বা ভুল তথ্য থেকে নিজেকে রক্ষার জ্ঞান বৃদ্ধির খুব বেশি কিছু পাইনি। তবে মিডিয়ার প্রভাব, আধেয়, মিডিয়ায় প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের দক্ষতা ক্রমান্বয়ে টেক্সট বইগুলোতে সংযোজিত হবে তা প্রত্যাশা করা যায়।

সংক্ষেপে মিডিয়া লিটারেসির আওতায় এর গুরুত্ব বর্ণনা করা মোটামুটি অসম্ভব। আমি সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু দিক আলোচনা করেছি মাত্র। একবিংশ শতকে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া এক বিস্তৃত ক্ষেত্র এবং মানব জীবনের এক তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। একে অস্বীকার করা কোনও উপায় নেই। মিডিয়া এডুকেশনের ব্যাপারে এখন প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন।

শুধু উন্নত দেশ নয়, অনেক উন্নয়নশীল দেশও মিডিয়া লিটারেসির ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে। যেমন ব্রাজিল সরকার ২০২৩ সালে মিডিয়া এডুকেশন স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করেছে। সেখানে শিশু-কিশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের মিডিয়া লিটারেসি বৃদ্ধির কৌশল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, সিভিল সোসাইটি ও অ্যাকাডেমিয়ার সঙ্গে পার্টনারশিপ ইত্যাদি প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে।

আমার মনে হয় বাংলাদেশের সময় এসেছে মিডিয়া এডুকেশন ও মিডিয়া লিটারেসি উন্নয়নের জন্য জাতীয় নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করা। ডিজিটাল যুগে নাগরিকদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এর কোনও বিকল্প নেই।

 

লেখক: কলামিস্ট, বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজীপুরে মিছিল নিয়ে সমাবেশে আসছেন শিক্ষার্থীরা
গাজীপুরে মিছিল নিয়ে সমাবেশে আসছেন শিক্ষার্থীরা
যথেষ্ট রান ছিল, পরিকল্পনা মতো বোলিং করতে পারিনি: খালেদ
যথেষ্ট রান ছিল, পরিকল্পনা মতো বোলিং করতে পারিনি: খালেদ
গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ন্যারেটিভ তৈরি করতে মিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে: প্রেস সচিব
গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ন্যারেটিভ তৈরি করতে মিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে: প্রেস সচিব
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এখনও আস্থা আছে: দুদু
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এখনও আস্থা আছে: দুদু
সর্বশেষসর্বাধিক