রাজনীতি ও রসবোধ

রাশেক রহমানজাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে উঠেছিল প্রায় অন্তঃসারশূন্য। সেই গতানুগতিক ধারা পরিবর্তনের সূচনা ঘটে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার পরে। রাজনীতিতে তিনি ফিরিয়ে আনেন একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদের দর্শন। ইংরেজ রাষ্ট্রনায়ক, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্যার উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন রাজনীতিবিদের পরবর্তী দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছরের ভবিষ্যৎ নিয়ে দূরদর্শিতা থাকা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সেই ক্ষমতা থাকাও প্রয়োজন যিনি কোনও কিছুর ব্যত্যয় ঘটলে তার কারণ বলতে পারবেন। শুধু দূরদর্শিতায় নয় বরং বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক রসবোধও ফিরিয়ে এনেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি ভারত সফরে তিনি একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছেন তাতে দেখা যায় তার রসবোধ অনেক বার্তা পৌঁছে দিয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছেও।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম নিয়ে যে আলোচনার ঝড় ওঠে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লিতে আইসিটি মৌর্য হোটেলের কামাল মহল হলে আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামের (আইবিবিএফ) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেভাবে কথা বলেন, সেটাতে অনেকে ভাবতে পারেন উনি হয়তো রসবোধ থেকেই বলছেন। তিনি তার বক্তব্যের মাঝে হঠাৎ করেই হিন্দিতে বলা শুরু করেন, ‘পেঁয়াজ মে থোড়া দিক্কত হো গিয়া হামারে লিয়ে। মুঝে মালুম নেহি, কিউ আপনে পেঁয়াজ বন্ধ কার দিয়া! ম্যায়নে কুক কো বোল দিয়া, আব সে খানা মে পেঁয়াজ বান্ধ কারদো (পেঁয়াজ নিয়ে একটু সমস্যায় পড়ে গেছি আমরা। আমি জানি না, কেন আপনারা পেঁয়াজ বন্ধ করে দিলেন। আমি রাঁধুনিকে বলে দিয়েছি, এখন থেকে রান্নায় পেঁয়াজ বন্ধ করে দাও)।’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভারত রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়, আর তাতে সমস্যায় পড়ে বাংলাদেশ। ভারত এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বাংলাদেশকে আগে জানালে, ঢাকা অন্য কোনও দেশ থেকে পেঁয়াজ আনার ব্যবস্থা করে নিতো।’



বক্তব্যে তিনি এমনভাবে বিষয়টা উপস্থাপন করেন যেখানে ফুটে ওঠে সমস্যার মূল কারণ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এবার সফরসঙ্গী হিসেবে তার সঙ্গে যাওয়ার এবং সামনে থেকেই এই বক্তব্য শোনার। প্রধানমন্ত্রীর এমন রসিকতাকে দর্শকরা করতালি দিয়ে স্বাগত জানান। আর রসবোধ নাড়িয়ে তোলে দিল্লির মসনদকেও। এর পরেই আমরা দেখি বাংলাদেশের স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের পেঁয়াজ প্রবেশ করার বিষয়টি এবং একই সঙ্গে বাজারে স্থিতিশীলতা আসার ব্যাপারও।
১৯৪৮ সালে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়াকে সাময়িকভাবে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু তখন কমিউনিস্ট পার্টি একজন তরুণ রাজনীতিবিদ ছিলেন। তার বিরুদ্ধেও একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। সেই সময়ে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডা. শ্রী বিধান চন্দ্র রায়। একজন ভালো বক্তা হিসেবে জ্যোতি বসুকে খুব পছন্দ করতেন ডা. রায়। তিনি জ্যোতি বসুকে ফোন করে বললেন, জ্যোতি তোমার জন্য একটা গাড়ি পাঠাচ্ছি। গাড়ি করে তুমি আমার বাড়ি চলে এসো। এখানে কয়েকদিন থেকো। আমি তো ছোট মাছ খাই, কিন্তু তুমি তো বড় মাছ খেতে ভালোবাসো, যেটা তুমি এখানে পাবে না। তবে ছোট মাছ ও ভাত তোমাকে আমি রোজই খাওয়াবো। এখানেই থেকো কারণ তুমি যদি না আসো তবে পুলিশের একটি ওয়ারেন্ট বের হয়েছে তোমার বিরুদ্ধে এবং সেটা দিয়ে পুলিশ তোমাকে প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যেতে পারে।
এটাকে বলা যেতে পারে এক ধরনের মজা বা রসবোধ। কিন্তু এখানে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করা ও তা বজায় রাখার বিষয়টিও সামনে চলে আসে।
শুধু রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও একদিকে দেখা যায় রসবোধ আর অন্যদিকে দূরদর্শিতা। এবারের ভারত সফরে এশিয়াটিক সোসাইটি অব কলকাতা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক টেগোর পিস অ্যাওয়ার্ড দেয়। সেখানে দেওয়া এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হলো তখন তৎকালীন গভর্নর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল হাই সাহেবকে ডেকে বলেছিলেন আপনারা এতো রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত করেন, নিজেরা একটা দুইটা রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে পারেন না?’ জবাবে আবদুল হাই সাহেব বলেছিলেন, ‘যদি অন্য কেউ সঙ্গীত লেখেন তবে সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত কীভাবে হবে?’  নিজের বক্তব্যে এভাবেই পাকিস্তান আমলে সংস্কৃতি অঙ্গনে যে স্থবিরতা আনার চেষ্টা করা হয়েছিল তা ফুটিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তিনি তার বক্তব্যে প্রায়ই রসবোধের সঙ্গে এমনভাবে বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলেন, যা ভাবিয়ে তোলে। আর রাজনীতিতে এই হিউমারটা ফিরে আসা খুবই জরুরি। ধ্বংসাত্মক বক্তব্য, কর্মকাণ্ড আর যাই হোক, রাজনীতিতে কখনও গঠনমূলক কিছু গড়তে পারে না। আর সেক্ষেত্রে এমন রসবোধ জন্ম দেয় এক নতুন ধারার রাজনীতি, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। পৃথিবীর বিখ্যাত সব রাজনীতিবিদ যারা বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির চর্চা করেছেন, তাদের সবার মাঝেই রসবোধ, হিউমার খুঁজে পাওয়া যায়। আমার নেত্রীও ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত এবং বাস্তববাদী একজন রাজনীতিবিদ। আর তাই তো তিনি এখন শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।
লেখক: রাজনীতিবিদ