মিডিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করার নানা ‘তরিকা’ আছে অবশ্য, কে কোনটা গ্রহণ করবেন সেটাই প্রশ্ন। সমস্যা হলো এই দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সঠিক কাজ করে শিরোনাম হওয়ার তরিকা পছন্দ না। তারা পছন্দ করেন শর্টকাটগুলোকে। যেমন, দেশে হঠাৎ করে আবিষ্কৃত হওয়া ক্যাসিনোগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে আপনি বলুন, ‘এগুলো সব বিএনপি আমলে তৈরি হয়েছিলো’, আপনি নিশ্চিত শিরোনাম হবেন। দেশের ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেলো, আপনি সেটাকে ‘পিনাট’ বলুন, আপনি মিডিয়ার দারুণ মনোযোগ পাবেন। দেশের একটা আস্ত গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ধসে গিয়ে হাজারের বেশি মানুষ মারা গেলো, কারণ হিসেবে আপনি বলুন, ‘বিপক্ষ দলের মানুষজন স্তম্ভ ধরে নাড়াচাড়া করেছিল’—আপনি নিশ্চিত শিরোনাম হবেন। দুদক চেয়ারম্যান এই সহজ পথেই হাঁটছেন।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেওয়ার সময় দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৯। সেই বাংলাদেশের এখনকার অবস্থান ১৪৯। যে দেশে দুর্নীতির এই ভয়ঙ্কর ভয়াবহতা চলছে সেখানে দুর্নীতি নিয়ে মোটামুটি কিছু কাজ করলেও একজন দুদক চেয়ারম্যান মানুষের আলোচনায় থাকতে পারতেন, মানুষের ভালোবাসা পেতেন। অবশ্য এই প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক—তাকে আদৌ সেই কাজের জন্য বসানো হয়েছে কিনা।
মাস তিনেক আগে দুদক চেয়ারম্যান দেশবাসীকে ঋদ্ধ করলেন নতুন এক জ্ঞানে। ডিসি সম্মেলনে গিয়ে দেওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, ‘সিআরপিসি (পেনাল কোড) অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি সরল বিশ্বাসে কোনও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সেটি অপরাধ বলে গণ্য হবে না। সেটিকে বড় করে সমস্যা মনে করার কথা নয়। তবে সরল বিশ্বাস যেন সরল বিশ্বাসই থাকে, তা নিশ্চিত হতে হবে।’
তখন আমরা সবাই ভীষণ সমালোচনামুখর হয়েছিলাম। হওয়ারই কথা। পৃথিবীর ভয়ঙ্কর রকম দুর্নীতিপরায়ণ একটা দেশে, যেখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, সেখানে এই রাষ্ট্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দুর্নীতির প্রতি এক ধরনের প্ররোচনা দেওয়া হয়েছিল তার সেই বক্তব্যে।
পরিস্থিতি শান্ত হলো এরপর। নানা ঘটনার ডামাডোলে আমরা ভুলে গেলাম দুদক চেয়ারম্যানের কথা। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথাকথিত অভিযানের মধ্যে দুদক চেয়ারম্যান আবার এলেন আমাদের সামনে এবং এবারও আরেকটা নতুন জ্ঞান নিয়ে। এবার অবশ্য তার দুর্ভাগ্য—আলোচিত হলেন না আগেরবারের মতো। কিন্তু বিষয়টা খুবই ভয়ঙ্কর বলেই লিখছি।
সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থার উপ-সহকারী পরিচালক থেকে উপ-পরিচালক পদমর্যাদার ৩০ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ কর্মশালায় চেয়ারম্যান বলেছেন—‘ঘুষ খাওয়া আর ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই’ (প্রথম আলো, ১ অক্টোবর)। দেশটা বাংলাদেশ বলেই অবাক হইনি, না হলে ভীষণ রকম অবাক হওয়ার কথা ছিল এটা দেখে—দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা একটা স্বাধীন কমিশনের চেয়ারম্যান বলছেন এই কথা!
ভিক্ষা করা অসুন্দর, কোনও সন্দেহ নেই। শারীরিক সামর্থ্য থাকা, কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করার সক্ষমতা থাকা মানুষের জন্য এটা হয়তো অনৈতিকও। কিন্তু ভিক্ষা করা কি অপরাধ? আবার আমরা যেমন কম্ফোর্ট জোনে বসে ভিক্ষাবৃত্তি সম্পর্কে এমন মন্তব্য করি, বাস্তবের বহু মানুষের জীবনে হয়তো ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায়ও থাকে না। সেদিক বিবেচনা করলে এটাকে কিছু মানুষের জন্য ‘অসুন্দর’ বলাটাও অন্যায় আমাদের।
কিন্তু দুর্নীতির মতো একটা ভয়াবহ অপরাধকে দুদক চেয়ারম্যান তুলনা করছেন ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে! দুর্নীতি বিষয়টা এতটাই তুচ্ছ তার কাছে! সরল বিশ্বাসে দুর্নীতি করলে শাস্তি হবে না শুনে যেসব কর্মকর্তা অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছেন দুর্নীতি করে যাওয়ার ব্যাপারে, দুর্নীতি ভিক্ষাবৃত্তির মতো ব্যাপার জেনে তারা আরেক দফা প্রণোদনা পাবেন আশা করি।
এমন এক দেশে আমাদের বসবাস, আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা এখন আর সেবা চাই না, আমরা বরং এটুকু নিশ্চিত করতে চাই, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের আরও ক্ষতি না করুক, তাদের দ্বারা আমরা যেন হয়রানির শিকার না হই। দুর্নীতি দমন দুদক করবে সেই আশা কোনোকালেই এই দেশের মানুষ করেনি বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু এই আশা এখনও ছাড়তে পারি না, দুদক অন্তত দুর্নীতির প্ররোচনা দেবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হয়ে উঠবে না দুর্নীতির ‘প্ররোচনা কমিশন’।
জানি, কেউ বলতে পারেন উনি ব্যাপারটা ঠিক এভাবে বলতে চাননি, দুর্নীতির প্ররোচনা দিতে চাননি, কথাটা বলে ফেলেছেন ‘সরল বিশ্বাসে’। কিন্তু যে মানুষটা দুর্নীতি আর ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যকার পার্থক্য বোঝেন না, সেই মানুষটা দুদক চেয়ারম্যান হন কীভাবে।
লেখক: সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, নাগরিক ঐক্য