X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গাইবান্ধার উপনির্বাচন কি ‘পাতানো খেলা’?

ডা. জাহেদ উর রহমান
১৫ অক্টোবর ২০২২, ১৮:৫৪আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২২, ১৮:৫৪

গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারি দলের মধ্যে ‘চাপান-উতোর’ শুরু হয়ে গেছে। ‘শুরু হয়ে গেছে’ না বলে ‘শুরু করা হয়েছে’ বলাই সমীচীন হবে বলে মনে হয়। 

এটা সত্য, গাইবান্ধার উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশন যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি। বিতর্কিত পরিস্থিতির অভিযোগে একটা নির্বাচন স্থগিত করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সুতরাং বিষয়টা নিয়ে খুব প্রশংসা হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু এটা বাংলাদেশ, আর আমরা গণতন্ত্রের পথে দীর্ঘকাল নানা রকম হোঁচট ধাক্কা খেতে খেতে চলছি, নানা রকম খানাখন্দে পড়েছি, তাই আমাদের মনে সংশয় হয় এবং সেটাই যৌক্তিক।

নির্বাচন স্থগিত করার দিন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহবুবউল আলম হানিফ প্রাথমিকভাবে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়ে জানিয়েছিলেন ঢাকায় বসে নির্বাচন কমিশন কীভাবে একটা উপনির্বাচন স্থগিত করেন। এরপর একই অভিযোগ করেন দলের আরও ওপরের পর্যায় থেকে। সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদেরও নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন একই যুক্তিতে।

ঘটনার পরদিন এর জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইনের ৯১ ধারায় বলেছে, আমরা যদি মনে করি, কী দিয়ে মনে করলাম, ঢাকায় বসে মনে করবো, না কুমিল্লায় বসে করবো, না চট্টগ্রামে বসে করবো বা আমরা জাহাজে বসে মনে করতে পারি, তা নয়; আমাদের কাছে যদি অনুমিত হয়, নির্বাচনটা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না, তাহলে নির্বাচন কমিশন যেকোনও কেন্দ্রের বা সব কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে।’

আমরা নিশ্চয়ই আত্মবিশ্বাসের সাথে অনুমান করতে পারি, নির্বাচন কমিশনের এই জবাবের পর আওয়ামী লীগ থেকে পাল্টা বক্তব্য দেওয়া হবে। এবং এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়ার প্রবণতা চলবে আরও কিছুদিন। 

এই পরিস্থিতিতে একটা ব্যাখ্যা করছেন অনেকেই, সেটা হলো ‘সহীহ নিয়ত’ থাকলেও নির্বাচন কমিশন একটা নির্বাচন সঠিকভাবে করতে পারে না সরকারের সাহায্য না পেলে, সেটা প্রমাণিত হলো। প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের ‘সহীহ নিয়ত’ কি ছিল? 

এরপরে যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেটা দেখে আমার বিশ্বাস ঘটনা ভিন্ন। সরকারি দলের অনেককে মিডিয়ার সাক্ষাৎকারে কিংবা টিভির টকশোতে দেখছি সব সমালোচনার করার পরও একটা আলোচনা মাঠে নামাচ্ছেন। বলছেন তারা নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনের ওপরে অখুশি কিন্তু এই ঘটনায় একটা বিষয় প্রমাণিত হলো যে নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ নয়। 

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, গাইবান্ধার উপনির্বাচনটি স্থগিত হবার মাধ্যমে সরকার খুব বড় একটি মাইলেজ পেয়েছে। দেশের ক্ষমতাসীন দলটির জোট ছাড়া আর সব বিরোধী দল সমস্বরে বলছে ক্ষমতাসীন সরকারটির অধীনে কোনও নির্বাচন হতে পারবে না। কিন্তু সরকার যথারীতি সেই দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলছে নির্বাচন সরকারের অধীনেই হবে।

ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া নিয়ে প্রধান যে যুক্তি সেটি হচ্ছে, নির্বাচন তো সরকার করে না, নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন যেহেতু একটি কাগজে-কলমে সাংবিধানিক স্বাধীন সংস্থা তাই তাদের পক্ষে অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা খুবই সম্ভব। কিন্তু এই সংবিধানিক এবং আইনি পরিকাঠামোর মধ্যেই বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন কী করতে পারে আর কী করতে পারে না, সেটা আমাদের জানা আছে। সবচাইতে বড় কথা সরকারটি যে নির্বাচন কমিশন গঠন করে সেটি কী মাথায় রেখে গঠন করে– সেটাও জানে এ দেশের নাগরিকরা।

এইমাত্র যা লিখলাম, এটার বিরুদ্ধেই একটা বয়ান হিসেবে গাইবান্ধা নির্বাচনকে সরকার হাজির করছে। সরকার এখন নানা বক্তব্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধাচারণ করে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে চাইছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই বয়ান বা প্রচারণার লক্ষ্য কে?

গৌণ লক্ষ্য নিয়ে আগে কথা বলা যাক। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামছে। সেই আন্দোলনের জবাবে সরকার গাইবান্ধার উপনির্বাচন সামনে নিয়ে আসতে পারবে। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায়, নির্বাচন কমিশনের অধীনেই একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে, বিরোধীদলকে এই টোপ দেখানো হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে– বিরোধীরা এই টোপ গিলবে কিনা।

এবার আসা যাক প্রধান লক্ষ্যের কথায়। সেটা বলার আগে প্রেক্ষাপটটা একটু আলোচনা করা যাক। তাত্ত্বিক কথা অনেক কিছুই বলা যায়। কোনও এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আরেক দেশ কেন নাক গলাবে? কেন কোনও দেশ আরেকটা দেশের নির্বাচন বা অন্যান্য বিষয়ে কথা বলবে? কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীটা এমনই যে এই বিষয়গুলো ঘটে। আর আমাদের মতো দেশ যেখানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় নেই, ক্ষমতায় আছে নানা রকম কারসাজির মাধ্যমে সেখানে তো এটা অনেক বেশি মাত্রায় ঘটবে।

আমরা পছন্দ করি বা না করি নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশিদের বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে তখন সরকারের সাথে বিরোধী দলগুলোর সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে মূলত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে। ফলে বিদেশিরা যাদের আমরা ইউফেমিস্টিকলি ‘উন্নয়ন সহযোগী’ বলি, তাদেরকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলোচনায় ঢুকতে হবে। সেই আলোচনায় সরকার যেন নিজের অবস্থানটা ভালো রাখতে পারে, তার জন্যই সরকার নির্বাচন কমিশনকে অত্যন্ত সক্ষম এবং নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে চাইছে বহির্বিশ্বের কাছে। 

এই ইন্টারপ্রিটেশন যদি সঠিক হয়, তাহলে প্রশ্ন তৈরি হয়, গাইবান্ধা পাঁচ উপনির্বাচনে যা হয়েছে সেটা কি ‘পাতানো খেলা’? এই যে নির্বাচনের মাঠে যেসব নির্বাচনি অপরাধ করেছে নির্বাচনি কর্মকর্তারা তাদের সবাইকে শাস্তির আওতায় নির্বাচন কমিশন আনার কথা। আরপিও-তে এসব অপরাধের শাস্তি দুই থেকে সাত বছর কারাদণ্ড। এসব লোককে কি শাস্তি দেওয়া হবে?

নির্বাচন কমিশন এমন কিছু করবে না তার একটা আলামত কয়েকদিন আগেই হলো। কিছুদিন আগেই নির্বাচন কমিশন ডিসি-এসপিদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। সেই মতবিনিময় সভায় একজন নির্বাচন কমিশনার জনাব আনিসুর রহমান বক্তৃতা দিতে ওঠে ডিসি-এসপিদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ তোলেন। তখন ডিসি-এসপিরা তার বক্তৃতায় বাধা দেন। এক পর্যায়ে সেই কমিশনার জানতে চান ডিসি-এসপিরা কি তার কথা শুনতে চান না? তখন তারা সমস্বরে জানিয়ে দেন, তারা চান না। 

রাষ্ট্রীয় অবস্থানের মর্যাদা ক্রমে (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) নির্বাচন কমিশনারদের অবস্থান নবম। আর প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সচিব ক্যাবিনেট এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের অবস্থান তিন ধাপ নিচে, দ্বাদশ। আর ডিসি-এসপিদের অবস্থান ২৫। যে কমিশনারের বিরুদ্ধে এই ঘটনা ঘটেছে তিনি অফিস করছেন না। কিন্তু এমন কাণ্ডের পরও নির্বাচন কমিশনের একজন কমিশনার এটাকে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি বলে এড়িয়ে গেছেন। এটার বিরুদ্ধে অফিশিয়ালি সরকারের কাছে কোনও অভিযোগও জানানো হয়নি। আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি গাইবান্ধায় নির্বাচনি অপরাধের পরিণতি আসলে কী হবে।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ