দিনপঞ্জির পাতায় শীত না এলেও, জীবন পাতায় জলবায়ু পরিবর্তন বলি আর স্থান পরিবর্তন যাই বলি না কেন শীত শুরু হয়েছে। আর শীত শুরু মানেই শীতের টাটকা সবজি। ধরে নিলাম পেঁয়াজ খাবো না, কিন্তু অন্য সবজির দামও এখন বেশ চড়া। যারা এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, সাংবাদিকদের কাছে বলতে গিয়ে শুনেছি এদের অজুহাতের শেষ নেই, কখনও পরিবহন সংকট, কখনও পথে পথে চাঁদাবাজির হিসাব। কিন্তু বাস্তবচিত্রে দেখা গেছে, যেখানে মূল পণ্য উৎপাদিত হয়, সেখানে কৃষক লোকসানে। চাষিরা পণ্য ফেলে চলে যাচ্ছেন। চাল ও ভোজ্যতেলের বাজারেও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। পর্যাপ্ত মজুত ও পাইকারি পর্যায়ে দাম না বাড়লেও খুচরা বাজারে বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে এবং কারসাজি করে দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু দাম যেটা বাড়ার, সেটা বেড়েই গিয়েছে।
ভাবছি, ভাত খাওয়াও কমিয়ে দেবো। চিকিৎসকরা বলছেন, এখন বাজারে যে চাল পাওয়া যায়, তার মধ্যেও নাকি ভেজাল রয়েছে। আর তিন সাদা মানে, চিনি, চাল আর লবণ তো শরীরের পক্ষে মোটেই উপকারী নয়। তাই দাম বাড়ার অজুহাতে ভাত খাওয়া কমিয়ে দিতে পারি। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্য বলছে, গত এক মাসে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মাঝারি ধরনের চালের দাম। গত এক মাসে এই চালের দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত ৬ নভেম্বর মাঝারি ধরনের চালের প্রতিকেজির দাম ছিল ৪২ থেকে ৪৮ টাকা। আর এই মাসে অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর এই চাল প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ৪৬ থেকে ৫২ টাকা। অর্থাৎ এক মাসে প্রতিকেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৬ টাকা।
চিকিৎসকরা বলে থাকেন, তেল নাকি স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। বেশি তেল খেলে নানা রোগব্যাধি হয়। কিন্তু কে না জানে, বাঙালি তো রসনায় মজে। তেলে ঝোলে অম্বলে না হলে তার চলেই না। কিন্তু সেই বাজারেও স্বস্তি নেই। কোম্পানিগুলো বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম না বাড়ালেও খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে খুচরা বাজারে। গত কয়েক দিনে সারাদেশে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৩ থেকে ৭ টাকা। আমদানিনির্ভর এই নিত্যপণ্যটির চাহিদা বা সরবরাহে কোনও প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। তারপরেও বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। সব মিলিয়ে নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে গিয়ে নিম্নআয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অবশ্য জীবন যেখানে যেমন, সংবাদমাধ্যমগুলোর লাইফস্টাইল পেজ বা অনুষ্ঠানে এখন দেখা যায়, পেঁয়াজ ও তেল ছাড়া সুস্বাদু রান্নার নানা রেসিপি। আলু, ডিম খেয়ে যারা সারাবছর ক্ষুধা নিবারণ করতে চান, সেখানেও নেই স্বস্তির খবর। দাম বেড়েছে বেশ। কিন্তু কেন বাড়ছে, তার কোনও কারণ জানা নেই কারও। ডিমের দাম সেই যে কবে বেড়েছে, আর নামলো না।
সবাইকে যেমন সুকুমার রায়ের ছড়ার মতো প্রশ্ন করা হয়, ‘মাথায় কতো প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার’। জবাব শুনতে চাইলেই কড়া ধমক, ‘মিথ্যে বাজে বকিস না আর খবরদার।’ কৃষিমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, আলুর নাকি দাম আরও বাড়া উচিত। চাহিদার তুলনায় বেশি উৎপন্ন হওয়ায় তিনি এ জবাব দিয়েছেন। সাংবাদিকরা যখন তাকে প্রশ্ন করলেন, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে কিনা, জবাবে কৃষিমন্ত্রী বললেন, ‘কাঁচাবাজার যেটা পচনশীল, চাল ছাড়া বেশিরভাগই পচনশীল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা এই র্যাব-পুলিশ দিয়ে কোনোদিনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। এটা মার্কেট ফোর্স এবং বাজারের যে শক্তি, সেটাই নিয়ন্ত্রণ করবে। শুধু মনিটরিং করা। সব দেশেই কমিটি আছে প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু তারা তেমনভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে।’ এলাচের দাম বেড়েছে কেজিতে ৬০০ টাকা। বিয়ের অনুষ্ঠানের খাবারে যে একটু সুগন্ধির বিলাসিতা করবেন, সেই উপায়ও নেই। আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায়, বাজেটের সময় বা রমজানের সময় দাম বাড়িয়ে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সময় অসময় নেই। ইচ্ছে হলেই বাড়ছে দাম।
এতো কিছুর পরও বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। যেটা খাবার নয়, কিন্তু জীবনে খাবারের চেয়েও এখন বেশি। গণশুনানি চলছে, সাধারণ মানুষ যাই বলুক না কেন, এসব গণশুনানি শুধুই লোক দেখানো। প্রকৃতপক্ষে দাম বাড়বেই। আর এর প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্যেও। কৃষি সেচের মাধ্যমে। তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? খাবে কী? লোকে বলে হাওয়া খেয়ে বাঁচেন। হাওয়া যে খাবো, সেই উপায়ও নেই। দূষিত বাতাস। কিন্তু যাদের হাতে এসব নিয়ন্ত্রণের ভার, তারা কী করছেন? গেলো ৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীলতার পেছনে বিএনপির ইন্ধন রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কেননা, দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে তারা (বিএনপি) উসকানি দেবে। তারা ইন্ধন দিচ্ছে, মদত দিচ্ছে।’ আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব প্রায় প্রতিদিনই বলে যাচ্ছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। মাঝখানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের একটু উচ্চবাচ্য করেছিলেন দ্রব্যমূল্য বাড়া নিয়ে। এখন নিজেদের গৃহবিবাধ এতোই বেশি যে, সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলতেই ভুলে গেছেন। তবে এটা ঠিক, শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দিয়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সমাধান হবে না। সেটা শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাও বলেছেন। তাহলে? সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হতে হবে সরকারকে। ঠিক কোথা থেকে এই কারসাজি চলছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে আলাদাভাবে মনিটরিং করতে হবে। জনগণ খেয়ে পরে শান্তিতে বাঁচতে পারলেই খুশি। তখন কে ক্ষমতায় এলো গেলো, তা নিয়ে মাথা খাটাবে না। কিন্তু যদি পেটে লাথি পড়ে, কেউবা খাবে ভীষণ, আর কেউ খেতে পাবে না। তা কি হতে দেবে? এমন তো নয়, সমস্যাটা কোথা থেকে শুরু তা বের করা বেশ দুরূহ বা সরকারের অজানা। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, সমস্যা সমাধানে সরকার কতোটা আন্তরিক। তাই উচিত হবে টেলিভিশনের সামনে বা বক্তৃতা বিবৃতিতে কথার ফুলঝুরি না সাজিয়ে, বাজারে সাজিয়ে রাখা সবজি থেকে শুরু করে নিত্যপণ্য যেন খাওয়ার টেবিলে সাজিয়ে পরিবেশন করা যায়, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের সেই ব্যবস্থা করা।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক