৫০ বছরের পথপরিক্রমায় বাংলাদেশের অনেক অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, ভৌত অবকাঠামোর দিকে তাকালেও অবাক হতে হয়। অনেক কম সামর্থ্যের মানুষ যখন আমরা ছিলাম তখন আমরা যতটা স্বার্থপর-আত্মকেন্দ্রিক ছিলাম এখন তার চাইতে ঢের বেশি সামর্থ্য নিয়ে আমরা অনেক বেশি স্বার্থপর-আত্মকেন্দ্রিক। এমনিতেই আত্মকেন্দ্রিক আমরা বড় বিপদকে সামনে রেখে শুধু আরও আত্মকেন্দ্রিকই হয়ে উঠি না, আমরা এই সংকটে অন্যের বিপদে ফায়দা লোটার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, প্রতিটি সংকট বিপর্যয় কারও না কারও কিছু সুবিধা তৈরি তো করেই। করোনার এই ভয়াবহ সময়ে স্বার্থপর-আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকা ঠিক হবে?
এক প্রকাশ্য (কিংবা হয়তো অজানা গূঢ়) কোনও কারণে দীর্ঘদিন করোনা নিয়ে চরম ঔদাসীন্য দেখালেও সরকার এখন কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। সরকারের অতি গাছাড়া ভাব জনগণের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল। জনগণ ঘুরে বেড়িয়েছে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে, গেছে কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষটাকে চিড়িয়ার মতো দেখতে, বিয়ে করে বউভাত আয়োজন করতে, ভোট দিতে, জনগণ এখনও চায়ের দোকান ঘিরে গায়ে গা ঘেঁষে আড্ডা দেয়। সবকিছু মিলিয়ে করোনা কমিউনিটি লেভেলে ছড়িয়ে পড়েছে এই অনুমান করাই যায়। একটা প্রমাণও আছে এর পক্ষে, করোনায় আক্রান্ত মৃত দ্বিতীয় ব্যক্তির পরিবারের কেউ বিদেশ থেকে ফেরেনি। মারা যাওয়া ব্যক্তির ছেলের ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাস গণমাধ্যমে এসেছে—ডাক্তার তার করোনা হয়েছে সন্দেহ করার পরও আইইডিসিআর তার করোনা পরীক্ষা করতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
খুব দ্রুত দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে, বাড়বে মৃতের সংখ্যাও। অনুমান করা যায় তাতে জনগণ নিজ থেকেই অনেক সাবধান হয়ে যাবে।নিজেরাই আর ঘর থেকে বের হবে না। সংক্রমণের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে খুব দ্রুত, তখন সরকার একের পর এক এলাকা লকডাউন করতে বাধ্য হবে। তখন এক নতুন বিপদ তৈরি হবে, যার লক্ষণ এরমধ্যেই দেখা যেতে শুরু করেছে।
করোনার মতো অতি সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য সবচেয়ে জরুরি পরামর্শ হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়ে তোলা। শারীরিকভাবে মানুষ মানুষের যত কাছে আসবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা তত বাড়বে। সেই কারণেই আমাদের শহরের বস্তিগুলো হবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার প্রধান স্থান। সেখানে চাইলেও মানুষের পক্ষে এই দূরত্ব বজায় রাখা অসম্ভব হবে। এদিকে বস্তিতে যেসব মানুষ থাকেন তাদের বেশিরভাগই দিনে এনে দিনে খায়-এর মতো অবস্থা, তাই তাদের যেকোনও মূল্যে কাজের সন্ধানে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই হবে।
দেশের অর্থনীতি এরমধ্যেই স্থবির হয়ে পড়েছে, সময় যত যাবে এই পরিস্থিতি ততই খারাপ হতে থাকবে। বিভিন্ন দেশে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর অর্থনীতিবিদরা একটা দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। অবশেষে ২০ মার্চ জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে ভয়াবহ মন্দা আসছে, যা ছাড়িয়ে যাবে অতীতের সব রেকর্ড। এরমধ্যেই রিকশাচালক, দিনমজুর, শ্রমিক, বাসার খণ্ডকালীন গৃহকর্মী, পরিবহনকর্মী, ফেরিওয়ালাসহ নানা অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত গরিব মানুষদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
এবার সামনে আছে আরও বড় বিপদ। কোনও এলাকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার কারণে সরকার সেই এলাকায় লকডাউন ঘোষণা করতেই পারে। এরমধ্যেই মাদারীপুর জেলার শিবচর এলাকাটিকে লকডাউন করা হয়েছে। আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি ওই এলাকার দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষগুলো কীভাবে বেঁচে থাকছে? ভবিষ্যতে লকডাউন করা এলাকার সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে, তখন সেই মানুষগুলো কীভাবে বেঁচে থাকবে? হ্যাঁ, কোটি কোটি মানুষ এই সংকটে পড়তে যাচ্ছে।
এদিকে পত্রিকায় খবর আসছে, দেশের দরিদ্র মানুষের একটা খুব বড় অংশের মানুষের উপার্জনের জায়গা গার্মেন্ট সেক্টর ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি। নতুন অর্ডার আসা প্রায় বন্ধ, এমনকি পুরনো অর্ডার বাতিল হচ্ছে, তৈরি হওয়া পণ্যের শিপমেন্ট করতে বারণ করা হচ্ছে। অচিরেই গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বন্ধ হতে শুরু করবে। এমনকি এই মহামারি ছড়িয়ে পড়ার মুখে স্বাস্থ্যগত কারণেও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়া উচিত। লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ বেকার হয়ে পড়বে খুব দ্রুত।
এই শহরের এবং অন্যান্য শহরের মানুষের ঘরে লাখ লাখ নারী কাজ করেন খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে, যারা আমাদের কাছে ‘ছুটা বুয়া’। এই মানুষগুলো করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ বাহক, এতে কোনও সন্দেহ নেই। অনেকেই এটা বুঝে তাদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিচ্ছেন, আবার কিছুদিন পর হয়তো সরকারি পদক্ষেপে এটা বন্ধ হবে। কাজ হারাবেন লাখ লাখ নারী।
ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে আদৌ পাঠানো যায় কিনা, সেটা খুব বড় প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী লেখক অভিজিৎ ব্যানার্জি এবং এস্তার দুফলো তাদের অতি বিখ্যাত বই ‘পুওর ইকোনমিকস’-এ যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, অন্য অর্থনৈতিক প্রভাব থাকলেও দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা একেবারেই তুচ্ছ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা সত্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষগুলো এখন একাধিক এনজিওর কাছে ‘কিস্তির জালে’ আবদ্ধ। সিডর-আইলা ঘূর্ণিঝড়ের পর সর্বস্ব হারানো মানুষের ওপর এনজিওগুলো ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য কী করেছিল, সেটা আমাদের এখনও খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোটি কোটি মানুষের উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা খুব কমে যাবে, কিন্তু পেছনে প্রচণ্ড কিস্তি পরিশোধের চাপ আছে—কল্পনা করতে পারছি কি আমরা পরিস্থিতিটা? এই মানুষগুলোকে কি ঘরে বেঁধে রাখা যাবে?
করোনার পরিস্থিতিতে উন্নত দেশগুলো তাদের সব জনগণের জন্য কী কী করছে, সেটা আমরা জানি। জনগণের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া, অফিসে না গিয়েও বাসায় বসে বেতন পাওয়া, ঋণের কিস্তি জনগণের হয়ে সরকারের পরিশোধ করা, এমন নানান সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমি খুব ভালোভাবে জানি আমাদের সরকারের সবার জন্য এতকিছু করার সামর্থ্য নেই, কিন্তু সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য সরকার কিছু করবে না, এটা কোনোভাবেই ভাবতে রাজি নই। ইউরোপ-আমেরিকা বাদ দেই, আমাদের পাশের দেশের পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে মাত্র দ্বিতীয় করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছয় মাস রাজ্যের গরিবদের বিনামূল্যে চাল, ডাল, গম দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
নিশ্চিতভাবেই মূল দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। সরকারকে খুব দ্রুত এ ব্যাপারে একটা তহবিল তৈরি করে ওই মানুষগুলোকে আশ্বস্ত করতে হবে। তাদের খাবারের জোগান দিতে হবে। আগামী কয়েক মাসের জন্য সব রকম ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ দেওয়া বন্ধ করতে এনজিওর ওপরে কঠোর নির্দেশ জারি করতে হবে। দেশের বড় ব্যবসায়ীদের জন্য সরকার এরমধ্যেই ঋণ পরিশোধের শিথিলতার ব্যবস্থা নিয়েছে। অথচ এই ব্যবস্থাটা নেওয়া উচিত সবার আগে এই দরিদ্র মানুষদের জন্য।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, আর সব সংকটের মতোই অনেক সংগঠন এই সময়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। অনেকেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনে বা বানিয়ে দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করছেন। সেই মানুষগুলোর প্রতি আহ্বান, এর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করার পদক্ষেপ নিন। আমরা যদি এমন কোনও দরিদ্র মানুষের চাকরিদাতা হয়ে থাকি, তাহলে করোনার কারণে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বাদ দিতে হলেও যদি সম্ভব হয় তাকে পূর্ণ অথবা আংশিক বেতন দেই। রিকশাচালকরা তাদের ‘খ্যাপ’ হারাচ্ছে এর মধ্যেই। নিজেই দেখছি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রিকশা ভাড়া কমে গেছে। এখন ওদের চরম দুঃসময়, তাই বার্গেইন করলে এটা আরও কমিয়ে ফেলা যায়। যদি খুব বিপদগ্রস্ত না হই আমরা, তাহলে এই সময়ে রিকশাচালকদের সঙ্গে বার্গেইন আমরা যেন না করি।
ধনীরাও ভাবুন এক্ষেত্রে। এবারের এই সংকট থেকে বাদ যাবেন না আপনারাও। এই প্রথম অতি তুচ্ছ কারণ থেকে শুরু করে সিরিয়াস অসুখে বিদেশে পাড়ি জমানো আপনাদের দেশে থাকতেই হবে এবং আক্রান্ত হলে দেশেই চিকিৎসা নিতে হবে।
মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ শেষ হয়ে গেছে আমি সেটা মনে করি না। এই ক্রান্তিকালে এসে আমি মানুষের মানবিকতায় আস্থা বিশ্বাস রাখতে চাই। তারপরও কেউ যদি সেটা না করেন, একেবারে অস্তিত্ববাদী হয়ে থাকতে চান, তাকেও বলছি মানবিক চিন্তার দরকার নেই, নিজের স্বার্থে হলেও এই মানুষগুলোকে খাইয়ে-পরিয়ে রাখতে হবে। এবার কিন্তু ও না খেয়ে মরা মানে শুধু তার মরা না, তারা এবার এই রোগটা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিয়ে যাবে, যার ঝাপটা এসে গায়ে লাগতে পারে আমাদেরও। তাই এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়কর সময়ে গরিব মানুষকে বাঁচানো মানে নিজেও বাঁচা।
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট