বাঙালির এই নবরূপের পহেলা বৈশাখ পালনের উৎসবের সৃষ্টিও হয়েছে এই তথাকথিত ধর্মীয় মৌলবাদ যখনই আমাদের অধিকাংশ মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, তেমনি এক সময়ে। ১৯৪৬-এর এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভেতর দিয়ে এই উপমহাদেশের মানুষ একদিন হিন্দু ও মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। তারা মানুষ ছিল না। তাই ধর্মের নামে দুটি দেশ হতে পেরেছিল। সেই ধর্মের নামে দেশ হওয়াতে আমাদের পূর্ববাংলার মানুষের যেমন ভূমিকা ছিল বেশি, তেমনি এটা পূর্ববাংলার এক শ্রেণির তরুণ-তরুণীকে ধাক্কাও দিয়েছিল অনেক বেশি। এর হয়তো একটা বড় কারণ, গোটা উপমহাদেশের মধ্যে আমাদের পূর্ববাংলায় যা আজ আমাদের বাংলাদেশ; এই নদী বিধৌত অঞ্চলে ধর্মের বর্মটা অতটা কঠিন নয়, বরং এখানকার আলো বাতাসের মতো সহজিয়া। আর তাই এখানে চৈতন্য, লালন ও হাছন রাজা জন্ম নেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকালে, তাকে একটু গভীর মনোযোগে জানলে, বোঝা যায়, তিনি লালনকে জেনে বিস্মিত হননি, বরং আরও বেশি সহজিয়া হয়েছিলেন। তাই পূর্ববঙ্গের জল হাওয়ার রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন আরেক রবীন্দ্রনাথ। যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের উপহার দেন ‘আমার সোনার বাংলা’, যার সুরে মিশে আছেন গগন হরকরা। এখানে এসেই আপন বুকের বজ্রানলে আলো জ্বালিয়ে প্রয়োজনে একলা চলতে আহ্বান জানান যে রবীন্দ্রনাথ সেখানেও মিশে আছে কুষ্টিয়ার কীর্তন, হরি নাম নিয়ে জগত মাতালে আমার একলা নিতাই। পূর্ববাংলার এই জল হাওয়াই তাই সেদিন সনজিদা খাতুন ও তাঁর বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করেছিল পহেলা বৈশাখকে গ্রাম বাংলার পথে পথে ছড়ানো থাকা অবস্থা থেকে, ব্যবসায়ীর হালখাতার খাতা থেকে আমাদের জাতীয়তাবাদ জাগানোর জীবনে তুলে আনতে। ৫০-এর দশকে তাঁরা সেদিন একটি বাসায় বসেই শুরু করেছিলেন পহেলা বৈশাখের রূপান্তর ঘটিয়ে অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের পথ ধরতে। রবীন্দ্রনাথ যেমন গগন হরকরার ‘আমার মনের মানুষকে’ ‘আমার সোনার বাংলা’ বানিয়ে দিয়েছিলেন, সনজিদা খাতুনরাও সেদিন গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে থাকা এক কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নববর্ষ যার শহরে শুধুই প্রবেশ দ্বার ছিল ব্যবসায়ীর হালখাতায়; তাকে রূপান্তরিত করে বাঙালি সংস্কৃতি লালনের প্রধান দিবসে পরিণত করার যাত্রা শুরু করেন। তারা জানতেন, তাদের এ উদ্যোগ একটি ঘরে বসে হলেও একদিন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। কারণ, এর অন্তরে রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির মূল উপাদান। সে উপাদান কি তা পহেলা বৈশাখের এক ভাষণে ভাষা সৈনিক গাজীউল হক বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতি বা কৃষ্টি’ শব্দটি এসেছে কর্ষণ থেকে আর কর্ষণ এসেছে কৃষি থেকে। পহেলা বৈশাখের উৎপত্তি কৃষি থেকে। তাই এ পহেলা বৈশাখ কৃষকের সন্তান এই বাঙালিরা চিরকাল তার আপন সত্তা হিসেবে ধরে রাখবে।’ বাস্তবে শুধু বাঙালির সভ্যতা নয়, বাঙালির সংস্কৃতি নয়, মানব সভ্যতা, বিশ্ব মানব সংস্কৃতি এসেছে কৃষি থেকে। তাই যে সংস্কৃতির উপাদান কৃষি থেকে এসেছে তাকে কোনও দেশে কেউ কখনও রুখতে পারবে না। বাঙালির পহেলা বৈশাখকেও রুখে দেওয়ার কোন পথ নেই। আপন ভূমিরসে জারিত হয়ে সে দিনে দিনে বিশাল মহীরুহে পরিণত হবে। তাই সুদিনে হোক আর দুর্দিনে হোক, আপন সংস্কৃতিকে বিকশিত করে যে দিবস সে দিবস মানুষের পক্ষেরই দিবস।
এবার যখন আমাদের জীবনে পহেলা বৈশাখ এসেছে, এর থেকে বড় কোনও দুর্দিনে বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ আসেনি। ১৯৭১ সালে এক গণহত্যা ও লাশের পাহাড়ের ওপর পহেলা বৈশাখ এসেছিলে। কিন্তু তখনও এত বড় দুর্দিন ছিল না। কারণ, তখন জীবন দান ছিল আমাদের মহান অস্ত্র। তখন একটি জীবন দেওয়ার অর্থই ছিল লক্ষ জীবন বাঁচানো। তখন লাশের পাহাড় তৈরি হয়েছিল বিজয় স্তম্ভ হওয়ার জন্যে। তাই একাত্তরের পহেলা বৈশাখেও মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন রণাঙ্গনে, তারা জানতেন তাদের প্রাণের বিনিময়ে বাঁচবে লক্ষ প্রাণ। কিন্তু আজ যখন আমাদের ঘরে পহেলা বৈশাখ তখন জীবন দেওয়ার অর্থ হলো আরেকটি লাশের সংখ্যা বাড়ানো। শুধু এখানেই শেষ নয়, আমার একটি লাশ থেকেও সৃষ্টি হবে আরও লাশ, আরও মৃত্যু, কোনও জীবন এখানে জাগবে না। আর এ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে। আজ জীবন বাঁচাতে পৃথিবীজুড়ে মানুষ ঘরের ভেতর ঢুকেছে। তাকে এখন পৃথিবীকে বাঁচাতে ঘরে থাকতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে মানুষ থেকে দূরে থাকতে হবে।
তাই এবারের পহেলা বৈশাখ এসেছে কোনও মিলন কেন্দ্রে নয়, বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে। তারপরেও কি এবারের পহেলা বৈশাখ অন্তরে অন্তরে পালিত হবে না? হবে। কারণ, এই করোনাকালেও দেখছি, নিজের ঘরে বসে জীবনকে জাগিয়ে রাখতে, ভবিষ্যতে বেঁচে ওঠার পথ খুঁজতে মানুষ তার প্রার্থনা তার শুভকামনা অব্যাহত রেখেছেন। আজ করোনা যুদ্ধে যে ডাক্তাররা লড়ছেন তাদের মনোবল বাড়াতে প্রতিটি মানুষই যে যার মতো করে ঘরে বসে তাদের জন্যে প্রার্থনা করছেন। এই ডাক্তারদের উদ্দেশে কেউ কবিতা লিখছেন, কেউ ছবি আঁকছেন, কেউবা তাদের জন্যে পালন করছেন কিছুটা সময় নীরবতা। এবারের পহেলা বৈশাখে তাই ঘরে বসে সবাই এ দিনটিকে পালন করে তাদের জন্যে উৎসর্গ করি, যে ডাক্তাররা তাদের পরিবারের সব সদস্যের মায়া ভুলে দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্যে করোনাযুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। হয়তো এর কোনও ব্যবহারিক মূল্য নেই। তারপরেও ওই ডাক্তারদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের একটা স্মারক তো হতে পারে। হোক না সেটা যতই ক্ষুদ্র, তবু তো হৃদয়ের আকুতি।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক