বিরোধীদের জাতীয় ঐক্যের ডাক কেন ‘অর্থহীন’

ডা. জাহেদ উর রহমানভদ্রলোকের পড়াশোনার বুদ্ধিমত্তা যথেষ্ট আছে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য যে বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত আরও বেশি জরুরি, ‘ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স’, সেটাও তার খুব ভালো‌ আছে, এটা নিশ্চিত। তিনি তার বর্তমান পদে বসার পর থেকে হোয়াইট হাউস ছেড়ে যেতে দেখেছেন পাঁচ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার কর্মজীবনের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট। ডক্টর এন্থনি ফাউচির কথা বলছি।
মূলত করোনা আসার পরে বিশ্ববাসীর মতো আমরাও তাকে চিনলাম, জানলাম তিনি আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ-এর পরিচালক পদে আসীন ১৯৮৪ সাল থেকে। ট্রাম্পের আগে যে পাঁচ জন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি, তাদের মধ্যে রিপাবলিকান, ডেমোক্র্যাট দুই দলের প্রেসিডেন্টই ছিলেন। তাদের সঙ্গে কাজ করতে কোনও সমস্যাই হয়নি তার।
এই ভদ্রলোকই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে খুব বেশি স্বচ্ছন্দ্য বোধ করছেন বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কখনও প্রকাশ্য চাপান-উতোরে জড়িয়ে পড়ছেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। আবার আমরা জেনেছি ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট রকম খারাপ পরিস্থিতি তাদের মধ্যে রয়েছে। একবার তো এমনও শোনা গিয়েছিল, ফাউচিকে পদ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন ট্রাম্প। এরপর চারদিকের চরম সমালোচনার মুখে সেই সিদ্ধান্তের দিকে আর যাননি তিনি। যথেষ্ট ভালো ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স থাকা মানুষটার কেন ষষ্ঠ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সমস্যা হলো? 

পৃথিবীতে আরেকজন ‘ট্রাম্প’ আছে, ‘ট্রাম্প অব দ্য ট্রপিকস’, জাইর বোলসনারো, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট। করোনার কারণে মতবিরোধে এই প্রেসিডেন্টের অধীনে এপ্রিল আর মে মাসে পদ থেকে সরে যেতে হয়েছে পর পর দুইজন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে। এমনকি  এই মুহূর্তে করোনায় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটা হয়েও লকডাউন শিথিল করে সব ব্যবসা খুলে দিতে চাইছেন তিনি, যা নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের সঙ্গে তার তীব্র মতপার্থক্য চলছে। কিন্তু বোলসনারো তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কেন তিনি কারও যৌক্তিক কথাও শুনছেন না?

করোনা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সরকারের সঙ্গে ঘোষিত বা অঘোষিত জোটে থাকা দলগুলো এবং ‘বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টি বাদে আর সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে করোনা মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের আহ্বান করা হয়েছে। এই আহ্বানে ভুলের কিছু নেই; এত ভয়ঙ্কর একটা সংকটে দেশের সব দল-মত নির্বিশেষে মানুষ একত্র হয়ে কাজ করলে সেটা দেশের জন্য ভালো হতো নিশ্চয়ই।‌ এই আহ্বানের একটা প্রতীকী মূল্যও আছে, সেটা নিয়ে পরে বলছি। ‌কিন্তু এর মূল যে কার্যকারিতার জায়গা সেই প্রেক্ষাপটে এই আহ্বানকে আমি একেবারেই অর্থহীন বলে মনে করি। 

অথচ এভাবে কি আমরা কেউ ভেবেছি, ঘটনাটা তো বরং উল্টো হওয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে বর্তমানে নানা রকম সংকটের মুখে দেশ। এমনকি করোনা উত্তরকালে দেশের অর্থনীতি বড় মন্দার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, যা আমরা দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি। সরকারের উচিত ছিল এই ক্রাইসিসের সময় সবাইকে নিয়ে কাজ করা, এতে অন্তত তার বিরুদ্ধে সমালোচকদের মুখ অনেকটা বন্ধ হতে পারতো। এছাড়া ব্যর্থতার দায়ভার অনেকটাই অন্যদের ওপরও দেওয়া যেতে পারতো। তাই জাতীয় ঐক্যের ডাক তো সরকারের পক্ষ থেকেই আসার কথা ছিল। হতেও পারতো নানা কারণে নিপীড়িত বিরোধী দল এতে আগ্রহী হলো না, এবং অনেক অনুরোধ করে তাদের রাজি করাতে হলো। কিন্তু সেটা তো হয়নি। 

ব্যবসায়শাস্ত্রে ইউএসপি (ইউনিক সেলিং প্রপোজিশন বা ইউনিক সেলিং পয়েন্ট) বলে যে কথাটা প্রচলিত আছে, তার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত আমরা। কোনও কোম্পানি তার কোনও পণ্য যখন বাজারজাত করে সেই পণ্যের নানা গুণাগুণ ভোক্তাদের সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেও তাদের বিচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা অনেক বেশি পরিমাণে বলে, যেটা তাদের ওই পণ্যকে অন্য কোনও কোম্পানির একই পণ্যের চাইতে আলাদা করে। অনেক ক্ষেত্রে সেটা নিয়েই পণ্য বিক্রির শ্লোগানও তৈরি হয়। এটাই সেই পণ্যের ইউএসপি। 

ট্রাম্প বা 'ট্রাম্প অব দ্য ট্রপিকস', জাইর বোলসনারো অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এই দুই দেশই শুধু না পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন এই ধরনের ডানপন্থী ডেমাগগদের এক ধরনের জয়জয়কার চলছে। মজার ব্যাপার ওদের সবার ইউএসপি কিন্তু মোটাদাগে এক‌ই—এরা শক্তিশালী শাসক, এরা কর্তৃত্বপরায়ণ, এরা অন্যদের কথার আমল না দিয়ে নিজের চিন্তাকে কার্যে পরিণত করতে পারে। 

তাই ট্রাম্প বা বোলসনারো সবার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেন তাদের এই শক্তি প্রদর্শনের জন্য। সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে, কিন্তু তবুও নেন। আদৌ কোনও পরীক্ষিত ওষুধ না, এমনকি রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে, কিন্তু তারপরও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ভারতকে হুমকি দিয়ে হলেও এনে ছেড়েছেন; খেয়েছেন নিজেও। ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের সমালোচনা হলেও তাদের ইউএসপি কিন্তু রক্ষিত হয়। আবার ভোটে জিততে ওটা তার লাগবে। 

বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারটিও কর্তৃত্বপরায়ণ। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সবার সঙ্গে সহযোগিতা-সমন্বয় প্রদর্শনের চাইতে এই সরকারের অনেক বেশি দরকার সে নিজেই অনেক বেশি শক্তিশালী এবং একাই সব করতে পারে, এটা দেখানো। তাই করোনা মোকাবিলায় সব বিরোধী দল ক্রমাগত একটা ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চাইতে থাকলেও ক্ষমতাসীনরা কখনও এটায় সাড়া দেবে না। ভুল করুক বা শুদ্ধ, তারা একাই চলবে। এই সরকারগুলোর ধরনই এমন।

মূল বক্তব্য শেষ। লেখা শেষ করি বিরোধীদের জাতীয় ঐক্যের ডাকের প্রতীকী মূল্যটার কথা বলে। বিরোধী দলগুলো এই ডাক দেওয়ার মাধ্যমে জনগণকে অন্তত এটুকু দেখাতে পারলো, তারা জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে অত্যন্ত খারাপ সম্পর্ক থাকার পরও এই সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিল।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট