প্রিয়জন এবং শত্রুপক্ষকে গাছ উপহার

হায়দার মোহাম্মদ জিতুনাট্যকার সিরাজুল ইসলাম সিরাজ-এর ‘পাখ পাখালির গান’ নাটকের গল্প কাঠামো বর্তমান পরিবেশ ব্যবস্থার একখণ্ড প্রতিফলন। যেখানে গাছ কাটার কারণে অর্থাৎ আবাসস্থল ধ্বংসের প্রতিবাদে পাখিরা তাদের গান (রূপকার্থে) গাওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলাফল রাজা অর্থাৎ ক্ষমতা কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানকারীর চোখ থেকে ঘুম চলে যায়। যা সমাধানে এগোতেই বেরিয়ে আসে রাজার বিশ্বাস, সততার বিপরীতে ক্ষমতা কাঠামোর চারপাশে থাকা জনদের অনৈতিক চিত্র এবং প্রকৃতি ধ্বংসের চোরাগুপ্তা পন্থা।
বর্তমান বিশ্বের সার্বিক ফলাফল ওই রচনার মতোই। সামনে ভদ্র পোশাকের আড়ালে সর্বত্র প্রকৃতি ধ্বংসের নির্মম রচনা। ফলাফল ‘পাখ পাখালির গান’ নাটকের রাজা চরিত্রের ঘুমহীন ব্যাধির মতোই অগণিত ব্যাধির ঘোরে বিশ্ব মানুষ। দুনিয়া জোড়া পুঁজিপতিদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং ক্ষমতার লাগামহীন কাঠামোয় পরিবেশ তার স্বকীয় স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। যদিও উদযাপনের মিছিলে এখনও বিশ্বজুড়ে একে নিয়ে কিছু কিছু পালাপার্বণ এবং মেকি কান্না জারি আছে। তবে সেটাও এক ধরনের বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতির স্বার্থবিন্দুর কারণে।

যেখানে চোরের উপদ্রব বেশি সেখানে পুলিশি তৎপরতা বেশি প্রয়োজন, এটাই সাধারণ জ্ঞান। সে হিসেবে পরিবেশ নিয়ে এসব দিবসকেন্দ্রিক আয়োজন-আলোচনাই নির্দেশ করে বিশ্ব পরিবেশ বিরূপ বিপর্যয়ের শিকার। অথচ মোড়ল রাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদী পৃথিবী যে অর্থ ধ্বংস কিংবা ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করে তার সামান্যও যদি কল্যাণে ব্যয় করতো তবে এ পৃথিবী বনে যেতো ঈশ্বরের ঈর্ষার সমতুল্য।

শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি মতে, একটি সুস্থ ভূখণ্ডের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আদতে তা থাকে শুধু পুঁথিতেই। অথচ শৈশবে-কৈশোরে এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে ‘প্রমোশনের’ জন্য একজন শিক্ষার্থীর দুইটি গাছ রোপণ বাধ্যতামূলক, এমন সামাজিক আচরণ রচনা করতে পারলে বর্ষ ঘুরে বাংলাদেশ হতে পারে বিশ্ব উদাহরণ। তাছাড়া জন্ম-মৃত্যু-বিয়েসহ বাকি উৎসবগুলোতেও প্রিয়জন এবং শত্রুপক্ষকে গাছ উপহার দেওয়ার একটা চল করারও  সুযোগ আছে। এ বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সামাজিক সহনশীলতা এবং ভারসাম্যহীনতার যে অভাব তাও কমে আসার একটা সুযোগ তৈরি হতো।

কারণ প্রকৃতি স্তম্ভ গাছ থেকেই শেখার আছে এ জীবন ত্যাগের, ভোগের নয়। তাছাড়া সমকালীন বাস্তবতায় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে বৈপরীত্য অবস্থান সেখান থেকেও উত্তরণেও আছে সহজ দর্শন। অর্থাৎ মানুষের জন্ম-জীবন এবং মৃত্যু সবটাই যে প্রাকৃতিক সেটাকে মনে রাখা। যদিও ট্র্যাজেডি হলো কোণঠাসা না হওয়া পর্যন্ত মানুষ বরাবরই এসব ভুলেই থাকে।

সরদার ফজলুল করিমের বোধ-দর্শনে, প্রবাদ প্রবচন যেকোনও জাতি রাষ্ট্রের আত্মপরিচয় বহন করে। সে হিসেবে বাঙালির সকলকে নিয়ে ভালো থাকার যে সংস্কৃতি তাকে পাশ কাটিয়ে হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপনে ভালো তো জগৎ ভালো নীতিতে হাঁটা জরুরি। কারণ বৈশ্বিক মোড়ল রাষ্ট্রগুলো ‘গেম থিউরির জিরো সাম ম্যাথ’ নীতিতে চলেন। অর্থাৎ নিজেদের ঘাটতি লাঘবে সীমানাহীন লুটে অংশগ্রহণ করেন। কাজেই ঔপনিবেশিক বাথটাব, কমোডের মতো পানি অপচয়ের সংস্কৃতি ছেড়ে ভবিষ্যৎ বাস্তবতার ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কারণ পানি’সহ পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের রক্ষণ এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতায় প্রকৃতির সঙ্গে আরও নিবিড় বন্ধুত্ব জরুরি।

সেক্ষেত্রে প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে অপচনশীল পণ্য ছেড়ে যাপনের ক্ষেত্রে সমস্ত পচনশীল পণ্য ব্যবহারে আগ্রহী হওয়া। পাশাপাশি মানুষ হিসেবে গোটা দুনিয়ার একটা অংশ হয়ে ওঠা। যেখানে অপচয় নয় নিহিত থাকবে অন্যান্য জীবের মতো শুধুই প্রয়োজনীয় অংশ। না হলে আগামী একশ’ বছর পর যখন সভ্যতার পুনঃরূপান্তর হবে তখন হয়তো ভবিষ্যৎ জানবে তাদের অতীত রক্তধারা ছিলেন শুধুই ভোগের বর্বরতায় ঠাসা।

কারণ বস্তিতে হঠাৎ আগুন লেগে যাওয়া এবং পরে সেখানে গরিব-মেহনতি মানুষকে শ্লেষ করে দাঁত কেলানো দালানের পরিকল্পনা-পটভূমি এবং একই কায়দায় বন-পাহাড়ে আগুন, নদী দখলের চল সবটাই যে উল্টানো সত্য, সে অতীত ভবিষ্যৎ চৌকস প্রজন্মের কাছ থেকে লুকানো যাবে না।

কাজেই নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্ভ্রম বাঁচাতে এসব মিথ্যা মিথের চল যেমন প্রকৃতি পুত্র-কন্যা উপাধি ছেড়ে মনুষ্যত্বের মানুষ-মশাল জ্বালানোর সংকল্পে একটা জেনারেশন টার্গেট করে তাদের বৈশ্বিক-প্রকৃতির অংশ হিসেবে গড়ে তোলাই সময়ের যৌক্তিকতা। তাহলেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ হবে বিশ্ব জয়ের। নইলে জীবন অবস্থা বনে যাবে পাখ পাখালির গান নাটকের পটভূমির মতোই। অর্থাৎ দূর-অদূরে প্রকৃতি মুখ ফিরিয়ে নেবে।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ

haiderjitu.du@gmail.com