সাম্প্রদায়িকতা রুখে দিতে হবে

হায়দার মোহাম্মদ জিতুশাসকের সময় বিরুদ্ধ আচরণের প্রতিবাদ উপায় হিসেবে ‘চিকা মারা’র আয়োজন-আগমন। এককালে বহুল ব্যবহৃত এই শব্দের উত্তাপ আচরণ ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বৈষম্য আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া এবং বাঙালির সচেতনতাবোধকে জাগ্রত করা। যদিও এর বৈশ্বিক শুদ্ধ রূপ ‘স্ট্রিট আর্ট’-আর এখনকার বাংলায় ‘দেয়াল লিখন’।
তবে পাকিস্তানি আমলে ‘চিকা মারা’ শব্দটিকেই বেশি ব্যবহার করা হতো। আর তার কারণ হয়তো নিশাচর প্রাণী চিকার মতোই ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে ও লুকিয়ে বাঙালির স্বপ্ন বাস্তবতার ইশতেহারগুলোকে দেয়ালে দেয়ালে প্রকাশ করা। যদিও এই আচরণই যে বাঙালির শেষরূপ নয় তাও বিশ্ব দেখেছে অবাক বিস্ময়ে। আর সেটা বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। সময়ের ধারাবাহিক পরিক্রমণে সংগ্রাম, শোষণ এবং ষড়যন্ত্রের শৃঙ্খল পায়ে মাড়িয়ে আজ এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনা। যার নেতৃত্বে আজ বহু পথ এগিয়েছে বাংলাদেশ।

ফলাফল বৈশ্বিক বাস্তবতায় এখন আর পথেঘাটে ‘চিকা মারা’র প্রচলন দেখা যায় না। আর যাও কিছু দেখা যায় তা স্পষ্টভাব প্রকাশ না করে বরং নিরুদ্দেশ পন্থাকে নির্দেশ করে। আবার এও সত্য, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে মত প্রকাশের জন্য এখন নানান প্ল্যাটফর্ম রচিত হয়েছে। তবে রাষ্ট্রব্যাপী ‘চিকা মারা’ দেখা না গেলেও আজও কিছু রিকশা পেইন্টিং চোখে পড়ে। যদিও সেগুলোও পুরনো জমিদারদের ক্ষয়ে যাওয়া ইটের দালানের মতোই বিলীন হওয়ার অপেক্ষায়।

ইদানীং কালের এই পেইন্টিংগুলো মনোজগতের অবাধ বিকাশের চেয়ে প্রথাগত আচরণকেই বেশি নির্দেশ করে। ভিন্নভাবে বললে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্রকে অস্বীকার করে প্রকাশ করতে চায় মুসলিম জাতীয়তাবাদ। অথচ এই রাজধানী ঢাকার বুকে যখন টু-স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত অটোরিকশা ছিল তখনও এমন এক পাক্ষিক ধর্মীয় আহ্বান ছিল না। রিকশা পেইন্টিংয়ে থাকতো নানান প্রাকৃতিক দৃশ্য, সিনেমার পোস্টার, স্থাপনা, পশুপাখিসহ নানা কিছু। কিন্তু এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ধর্মীয় আহ্বান।

অথচ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্দেশ করে এ রাষ্ট্রের চরিত্র অসাম্প্রদায়িক চেতনার। আরও বিস্তৃতভাবে পূর্বাপরই মানুষ ধর্মকে প্রশান্তির জায়গায় পালন করে আসছে। কিন্তু কিছু মানুষ এখন এটিকে এমনভাবে সাজানোর চেষ্টা করছেন যে ক্ষেত্রবিশেষে একে উগ্রবাদী পন্থার ধর্মান্ধপূর্ণ চরিত্র মনে হয়, যা বাঙালির মনন মানসিক মানচিত্র বিরোধী।

আগে ছিল ‘আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠান’। যা এখন আর সচরাচর দেখা যায় না। এখন রিকশার পেছনের পেইন্টিংয়ে অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় নানান ধর্মীয় স্থাপনা, বাণী। বিষয়গুলো ভীষণ সামান্য এবং তুচ্ছ মনে হলেও এর ভাবার্থ ব্যাপক। কারণ এ ধরনের ধর্মীয় চিন্তা নয়, এদেশ স্বাধীন হওয়ার উৎসাহ ছিল সাংস্কৃতিক-সামাজিক সর্বজনীন বাঙালি ঐতিহ্যের জাতীয়তাবোধ।

যদিও এই সামান্য বিষয়গুলোরও নিরীক্ষণ বেশ বিস্তর। পৃথিবী শুধু উপার্জনসম্পন্ন সময় পারের স্থান নয়। অর্থাৎ জীবনের পুরো সময়টার যাপন কেমন, কীভাবে কী, সেটাই মুখ্য। সেখানে উপার্জন, সংসার এসব একেকটা সময় উদযাপনের ক্ষেত্রমঞ্চ মাত্র। আর এখানেই চলছে আমাদের মহাশূন্যতা। পূর্বে একজন রিকশাওয়ালা সপ্তাহে অন্তত এক থেকে দুটো সিনেমা দেখতেন। রাস্তার এখানে ওখানে বিশ্রামের ফাঁকে পাশেরজনের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন।

কিন্তু অতিরিক্ত নগরায়ণের চাপে এখন আর তারা কোথাও দাঁড়াতে পারেন না। অর্থাৎ শহুরে স্থান সংকুলনহীনতা হানা দিয়েছে তাদের এই ভাব বিনিময়েরও আস্তানায়। তার ওপর আগে সিনেমা নির্মাণ হতো সাধারণ দর্শকের উদ্দেশ্যে, আর এখন এটা নির্মাণ হয় বোদ্ধা শ্রেণি এবং নিজেদের একক ব্যবসার খাতিরে। তাছাড়া বিনোদন নিয়ে যারা কাজ করবেন তারা এখন নিজেদের দায়িত্ববোধ পালনে সময়ই পান না। কারণ তাদের মাঝে নিজেদের কাজের চেয়ে এখন সভা-সমিতির ভোটাভুটি খেলা চলে সারাক্ষণ। আবার জাতীয় নির্বাচনে যুক্ত হওয়ার নেশাও তাদের বেশ বিস্তর।

ফলাফল বিনোদন শূন্যতায় একটা বিশাল জনগণ। পাশাপাশি একের পর এক সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এখনও দেশের প্রায় চার থেকে ছয় কোটি মানুষ ঔপনিবেশিক কিংবা আকাশ সংস্কৃতিসম্পন্ন বিনোদন নয় বরং দেশীয় রসের বিনোদন চান। এই মানসিক শূন্যতারই সুযোগ নিচ্ছে উগ্রবাদী ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ। তাছাড়া এখানে কিছু সমস্যাও আছে। কারণ এখানে এখনও ভাতের লোভে মানুষ খেপিয়ে মানুষ হত্যা করতে দেখা যায়। কাজেই এসব সাংস্কৃতিক শূন্যতায় পথ অনুসন্ধান যে একক জনগণের জন্যই স্পষ্ট করা জরুরি।

কারণ এখানে ধর্মকে আশ্রয় করে যুদ্ধাপরাধী এবং অপতৎপরতা চলানো একটা অংশ মিলে রাজনীতির মতো পবিত্র দায়িত্ববোধের জায়গাকেও কলুষিত করেছে। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যার প্রামাণ্য দলিল খানিক সুযোগেই আজ ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানোর প্রচেষ্টা। তবে সহজিয়া বাঙালির সেই নিরপেক্ষ সমাজ এবং মানসিক মানচিত্র নির্মাণ এখনও সম্ভব। তবে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সকল জনগণকে সর্বাত্মক সাহস জোগাতে হবে।

আর এই ধরনের চোরাগোপ্তা সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িকতা যারা ছড়াচ্ছে তাদের রুখতে একক গণতন্ত্রই যথেষ্ট। কারণ এর মূল বিষয় হলো ১০০% এর ৫১% কোনদিকে। সেক্ষেত্রে এখানে ‘69’ (সিক্সটি নাইন থিওরি) ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বা অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষজন যা ‘6’ দেখছেন কিছু অংশ যারা ‘9’ দেখছেন তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এরপর গণতন্ত্রের বলয়ে সেইসব উগ্রবাদী চিন্তাকে ধসিয়ে ‘9’ দেখা মানুষদেরও ‘6’ দেখতে হবে। অর্থাৎ সহজিয়া বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যগত সর্বজনীন চরিত্র গ্রহণে বাধ্য করতে হবে। আর এই মোকাবিলা পথে একক শক্তি জনগণ এবং বাঙালির জাত্যাভিমান।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কার্যনির্বাহী সংসদ

haiderjitu.du@gmail.com