অনেকে হয়তো বলতে পারেন, শেখ হাসিনা অনেক কিছুই তাঁর দেশের মানুষের জন্যে করেন ঠিকই কিন্তু তার শতভাগ সুফল দেশের মানুষ পায় না। এর সবটুকু দায় কোনোমতেই শেখ হাসিনার ওপর চাপানো যাবে না। এখানে আমাদের জাতীয় চরিত্র, আমাদের প্রত্যেকের চরিত্র দায়ী। পাশাপাশি সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের ওপর, অনেক সিদ্ধান্তের ওপর একটি অর্থ শক্তি কাজ করছে। এ কারণে একটি বিশেষ গোষ্ঠী অনেক কিছু নষ্ট করে দিচ্ছে। একটি বিশেষ গোষ্ঠী অনেক সুবিধা তাদের নিজেদের মতো করে নিয়ে নিচ্ছে। বর্তমান পৃথিবীর অটোক্রেটিক রাষ্ট্র, কম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, অনুদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এমনকি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সবখানেই এই অর্থশক্তি অনেক বেশি কাজ করছে। এমনকি যেসব দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো অনেক বেশি সংগঠিত সেসব দেশেও এটা ঘটছে। পৃথিবীকে দ্রুত এখান থেকে বের হতে হবে। বাংলাদেশকেও দ্রুত এখান থেকে বের করে আনতে হবে। তা না হলে সমাজে বৈষম্য বেড়ে যাবে সব ক্ষেত্রে। শেষ অবধি উন্নয়নের সুফল জনগণ শতভাগ পাবে না। এমনকি সিংহভাগও পাবে না। তাই শেখ হাসিনা সব দেশের কাছ থেকে কোভিড টিকা আদায় করছেন পাশাপাশি এর বণ্টন ব্যবস্থাও করতে হবে তাকেই। তাঁর দেশের দরিদ্র মানুষ যাতে এই কোভিড টিকা সহজে পায় তার একটি কার্যকর ব্যবস্থাও তাকে করতে হবে। কোনোক্রমেই যেন প্রশাসনিক দুর্নীতি ও ব্যবসায়ীর অতি মুনাফার লোভ বা কোনও একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে এটা জিম্মি না হয়। কারণ, এই সত্য পৃথিবী উপলব্ধি করেছে, কোভিড টিকা ছাড়া কোনোক্রমেই পৃথিবীকে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্যে এই টিকাগুলো আদায় অনেক জরুরি ছিল। সেখানে শেখ হাসিনা সফল হয়েছেন।
অন্যদিকে যারা মনে করেছিলেন বা বিভিন্নভাবে প্রচার করছিলেন, শেখ হাসিনা ভারতের চাপে পড়ে চীনের টিকার তৃতীয় ধাপ পরীক্ষার সুযোগ বাংলাদেশে দিচ্ছেন না- তারাও শেখ হাসিনার এই কাজের ভেতর দিয়ে একটি উত্তর পেলেন। যেসব বুদ্ধিজীবী বা পেশাজীবী ইতোমধ্যে এ নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলেন তারাও মনে হয় একটি বেশ কঠিন উত্তরই পেলেন। এমনকি তাদের এটা বোঝা উচিত ছিল, কোভিড টিকা আমাদের মানুষের জীবন মরণ বা অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। একটি জীবন রক্ষা যে একটি দেশের অস্তিত্বের সঙ্গে কতবেশি জড়িত তা কেবল দেশ ও মানুষকে ভালোবাসলে বোঝা যায়। মাঝে মাঝেই একজন করে পরিচিত মানুষ, একজন বন্ধু, একজন আত্মীয় মারা যাচ্ছে। প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ জন। এমন একটি সময়ে এই টিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কতটা অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শেখ হাসিনা যে এখানে তাঁর দেশের মানুষের জীবনকে সব থেকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেটাই বোঝা যায়। কারণ, শেখ হাসিনা চীনের কোভিড টিকার তৃতীয় ধাপ পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছেন ২৭ আগস্ট। এর মাত্র বারো দিন আগে চীন শুধু শেখ হাসিনার অস্তিত্ব নয় গোটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষ মানুষের অস্তিত্বের ওপর আঘাত করেছে। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, গোটা পৃথিবীর যেসব মানুষ বাংলাদেশ সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখেন, তারা জানেন বেগম খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্টের জন্মদিনটির আসল রহস্য। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট তার যে মিথ্যে জন্মদিন পালন করেন- এর একমাত্র উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনটিকে উৎসবে পরিণত করা। কারণ, এটা বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থী ও বাংলাদেশ বিরোধীদের জন্যে একটি উৎসবের দিন। ১৫ আগস্ট তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি; ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে আধুনিক বাংলাদেশটি তৈরি হয়েছিলো, সেই বাংলাদেশের সব ধরনের চেতনা, তার সংবিধানকেও হত্যা করে। বাংলাদেশের একজন সম্পাদক একটি পোর্টালে লিখেছেন, এটা শেখ হাসিনার জন্যে একটি সেনসেটিভ দিন। বাস্তবে এটা শুধু শেখ হাসিনার জন্যে নয়- যারা ১৯৭১-এর বাংলাদেশটি চায় তাদের সকলের জন্যে সেনসেটিভ। কারণ, এই দিনকে জাতীয় শোক দিবস মনে না করে মিথ্যে জন্মদিনের উৎসব করার অর্থই হলো বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভেতর দিয়ে যে পাকিস্তানিমার্কা বাংলাদেশ সৃষ্টি তারা করেছিল সে কাজের জন্যে উৎসব করা। খালেদা জিয়া সেটাই করেন। কারণ, বাংলাদেশ বিরোধী ও পাকিস্তানি শক্তির তিনিই মূল প্রতিনিধি।
শুধু শেখ হাসিনা একা নন, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মসহ স্বাধীনতাকামী সকল মানুষ গত বারো বছর ধরে এই শক্তির বিরুদ্ধে একটি কঠিন যুদ্ধে। এবং তাদের একটি ক্ষয়িষ্ণু জায়গায় নিয়ে এসেছে নতুন প্রজন্ম শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বাংলাদেশ বিরোধী শক্তিকে এখন বাংলাদেশে অনেক দুর্বল অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশবিরোধী শক্তি যখন দেশের মধ্যে দুর্বল এই সময়ে এবারের ১৫ আগস্ট চীন কিন্তু একটি ভিন্ন বার্তা গত বারো বছর পরে দিয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতের প্রতিনিধি বেগম খালেদা জিয়াকে তার এই ষড়যন্ত্রমূলক জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও উপঢৌকন পাঠিয়ে মূলত বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্বের ওপর আঘাত করেছে। কারণ, এই সত্য বিশ্বের সকলকে মানতে হবে, ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করার অর্থই হলো বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা। খালেদা জিয়া সেটাই করে চলেছেন। এবার ১৫ আগস্ট চীনের এই শুভেচ্ছা ও উপঢৌকন সেই ষড়যন্ত্রকেই স্বীকৃতি দিয়েছে। যেমন তারা প্রথমে স্বীকৃতি দেয় ৩১ আগস্ট ১৯৭৫। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ১৫ দিন পরে।
যাহোক, তারপরেও শেখ হাসিনা রাষ্ট্রনায়ক। তিনি জানেন, রাষ্ট্র ক্ষমতাকে সব সময়ই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে চলতে হয়। আর এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই দেশের মানুষের স্বার্থ আদায়ের নামই কূটনৈতিক সাফল্য। শেখ হাসিনা সেই ধৈর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন এক্ষেত্রে। শেখ হাসিনার এই ধৈর্যর ভেতর দিয়ে চীনও নিশ্চয়ই একটি বার্তা পাবে। কারণ, ধৈর্য সব সময়ই সাহসের পরিচয়। আর পাশাপাশি এটাও সত্য বেগম খালেদা জিয়ার ষড়যন্ত্রের দিনকে স্বীকৃতি দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর কোনও চাপও সৃষ্টি করা যাবে না। আবার বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে নতুন করে কোনও ষড়যন্ত্রও আর সম্ভব হবে না। কারণ, পুরনো জুতো নতুন পোশাকে মানায় না।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক