স্বাস্থ্যসেবার ভগ্নদশা ও বরাদ্দ-ব্যয়ের মধ্যকার সংকট

স ম মাহবুবুল আলমলেখক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালে আমার মা ২২ বছর বয়সে মারা যান বিনা চিকিৎসায়। শুধু তিনি নন, প্রসবের সময় তাঁর কন্যা সন্তানটিও মারা যায়।...একলাম্পশিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অতিরিক্ত রক্তস্রাবে তাঁর মৃত্যু হয়।... ওষুধপথ্য বলতে ছিল কয়েকটি বড় বোতল। তা দিয়ে প্রসবকালীন ধনুষ্টঙ্কার রোগীর জীবনরক্ষা সম্ভব হতো না। সমগ্র মানিকগঞ্জ জেলায় (তখন মহকুমা) ছিলেন একজন এমবিবিএস চিকিৎসক মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে।’
সেখান থেকে বিগত কয়েক দশকে দরিদ্র ও ঘনবসতির বাংলাদেশ, স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন সূচকে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। ডায়ালাইসিস, হার্ট সার্জারির মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসার সংযোজন হয়েছে। রোগ নির্ণয় কিংবা ফলোআপের উচ্চ ডায়াগনস্টিক সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। 

তারপরেও করোনাপূর্বকাল থেকে জনগণের চিকিৎসাসেবা নিয়ে হাহাকার, ব্যাপক অসন্তোষ ছিল। আর করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল চিত্র মানুষের কাছে প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের এই করুণ অবস্থার কারণ কী মনে করেন আপনি? কোনটা ভাবছেন, দুর্নীতি খেয়ে ফেলেছে সব, না ডাক্তারদের অমানবিক আচরণ? 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানাচ্ছে, স্বাস্থ্য ব্যয় নিজের পকেট থেকে মেটাতে গিয়ে (Catastrophic Health Expenditure) প্রতি বছর ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে, আর বড় ধরনের আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে সোয়া দুই কোটি মানুষ। বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতের মোট ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে (OOP) বহন করে। বৈশ্বিক মানদণ্ডে যা ৩২ শতাংশের নিচে। ব্যক্তির এই ব্যয়ের ৬১ শতাংশ যায় শুধু ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়ে। জনগণ ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছে। গরু, ছাগল, জমি-জমা বিক্রি করে চিকিৎসা খরচ মেটাচ্ছে। দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত মানুষ চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রাখছে, সাধারণ রোগ জটিল রোগে পরিণত হচ্ছে, অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেসিসটেন্সের জন্ম দিচ্ছে, অভুক্ত থেকে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশাল অসমতা সৃষ্টি হচ্ছে। গত ৪৯ বছরে বাংলাদেশে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র ১ শতাংশেরও কম। এটা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হলো আমাদের মতো একটা দেশের স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অন্তত পাঁচ শতাংশ বরাদ্দ রাখা। এই সংস্থার মতে একটি দেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত। স্বাস্থ্য খাতে এবারের বরাদ্দ মোট বাজেটের আকারের তুলনায় মাত্র ৫ দশমিক ১ শতাংশ। সেই স্বাস্থ্য বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় ৬০ শতাংশের ওপর, অর্থ চলে যাচ্ছে মূলত ভৌত অবকাঠামো, পরিচালন খাতে, বেতনভাতা ইত্যাদিতে। প্রকৃতপক্ষে রোগীর সেবার জন্য বরাদ্দ খুবই কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুসরণ করলে এ বছরের বাজেটে (জিডিপির অনুপাতে) স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ পাওয়ার কথা এক লাখ ৫৮ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। করোনাকালে যে স্বাস্থ্য খাতের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা তার প্রাপ্তি হয়েছে সুপারিশের অঙ্ক থেকে এক লাখ ২৯ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা কম বরাদ্দ (২৯২৪৭ কোটি টাকা এ বছরের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ)। অঙ্কের হিসাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবের চেয়ে কত কম! বছরের পর বছর অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দে সরকারি স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশার কারণে বাংলাদেশে মানহীন বিশাল একটি বেসরকারি চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সরকারি হাসপাতালের কথা বলতেই ভেসে উঠে ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, জনভোগান্তি, দালাল-হকারদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি নিয়ে এক মানবিক অসহায়তার করুণ দৃশ্য। ওষুধ নাই, নাই চিকিৎসাসামগ্রী, নাই পরীক্ষা সুবিধা। তারপরেও সেই হাসপাতালে রোগীর শয্যা খালি নাই। সেখানেও সেবা নিতে গেলে দুই-তৃতীয়াংশ খরচ নিজের পকেট থেকে মেটাতে হয়।

এটা এখন খুবই স্পষ্ট, অবহেলিত, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাতকে টেনে তুলে উন্নত ও নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সামর্থ্য ও দক্ষ করতে হলে স্বাস্থ্য বাজেট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। বাজেট মেটারস ফর হেলথ। একটি বলিষ্ঠ, সুবিশাল সরকারি স্বাস্থ্য অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। যা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অসমতা দূর করে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করবে। প্রতিটা নাগরিকের মানসম্মত চিকিৎসাসেবা পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত হবে, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে আর্থিক বিপর্যয় ঘটবে না। জাতিসংঘ ঘোষিত আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে জনগোষ্ঠীকে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (UHC) আওতায় আনতে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। আর গতিশীল ও শক্তিশালী সরকারি অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা হলো সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের চালিকাশক্তি। দরিদ্র ও অতি দরিদ্র জনগণের জন্য সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির রূপরেখা কেমন হবে? কীভাবে তাদের জন্য তহবিল গড়ে তোলা হবে? জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণে, রাজনীতিবিদ, নীতি নির্ধারক, বিশেষজ্ঞ ও সেবা প্রদানকারীদের মতামতের ভেতর দিয়ে অর্থ সংস্থানের সম্ভাব্য সব পথকে বিবেচনায় এনে গ্রহণযোগ্য পথ বের করতে হবে। অন্যান্য দেশের মডেল ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় আনতে পারি, তবে আমাদের উপযোগী সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি ও অর্থপূর্ণ স্বাস্থ্যবিমা পদ্ধতি আমাদেরকেই খুঁজে নিতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও বাস্তবায়নে কমিউনিটিকে যুক্ত করতে হবে। আগামী বাজেটের আগে এই মুহূর্তেই আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডে স্বাস্থ্য বাজেট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে বাধা কোথায়, কোন পথে এগুলে আমরা জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখতে পারবো। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ।

মুখে জিরো টলারেন্স, বাস্তবে দুর্নীতির প্রশ্নে সরকার ও জনগণ সর্বোচ্চ সহনশীল। এই দেশে করোনাকালে দুর্নীতির রগরগে গল্প পরিবেশন করে স্বাস্থ্য খাতকে উলঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেক গল্প—বরাদ্দ বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই স্বাস্থ্য খাতের। ২০১৯-২০ সালের  অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থেকে অব্যবহৃত হওয়ায় এক হাজার কোটি টাকা ফেরত গেছে। এটা কি স্বাস্থ্য খাতের অদক্ষতা নাকি যারা ছেঁড়া কাপড়ে আব্রু ঢাকতে ব্যস্ত স্বাস্থ্য খাতকে করোনাকালে ‘বেআব্রু’ করেছে তাদেরই কলকাঠি নাড়ার ফল? ঘাটতি বাজেটের অঙ্ক মেলানোর কৌশল, অর্থ ছাড়ে বাধা?

দুর্নীতি, অপচয়, বাস্তবায়নে অদক্ষতা কি একা স্বাস্থ্য খাতের জিনে প্রথিত!  বাংলাদেশের সমস্ত মন্ত্রণালয়ের চিত্র একই, রাষ্ট্রীয় অফিসে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। দুর্নীতির দুষ্ট চক্রকে ধ্বংস করতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সরকারি সম্পদের প্রতিটি পয়সার জবাবদাহিতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। দুর্নীতি দমনে রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কোথায়? অবশ্যই বাজেট বাস্তবায়ন সক্ষমতা বৃদ্ধি হলে অপচয় রোধ হবে, অপ্রতুল বাজেটের মধ্যেও সুফল পাবে জনগণ। বাজেট প্রস্তাবনার ভেতর থাকবে সেই দক্ষতা, সক্ষমতা তৈরির উদ্যোগ। বাজেট প্রণয়নের দক্ষতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা। অর্থ মন্ত্রণালয় ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে আসছে।

স্বাস্থ্য খাতে গতি আনতে বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে অব্যাহত বেশ কিছু আর্থিক নীতিমালার সার্বিক পরির্বতন আনতে হবে। প্রথমত বাজেট প্রণয়নে দুর্বলতা দূর করতে হবে। এখানে প্রতিবছরে যে বাজেট বরাদ্দ থাকে তার বিপরীতে সামান্য বাড়িয়ে একধরনের ‘দাক্ষিণ্য’ দেখানো হয়। প্রয়োজনীয়তার নিরিখে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। জনসংখ্যা, রোগের প্রাদুর্ভাব, হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা, শয্যা সংখ্যার অকুপেন্সি, জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিবেচনায় আনা হয় না। কত রোগী চিকিৎসা দেওয়া হলো, শয্যার টার্ন ওভার ইত্যাদির ভিত্তিতে কার্যক্ষমতা নির্ধারণ হয় না। স্থানীয় প্রতিনিধি ও সেবা প্রদানকারীদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকে না। স্বাস্থ্য খাতের অগ্রাধিকার গুরুত্ব পাচ্ছে না। প্রতি বছরের স্বাস্থ্য বাজেট গৃহীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ও স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশলপত্রের (২০১২-২০৩২) সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য অর্থায়ন সামঞ্জস্যপূর্ণ ও একই লক্ষ্যাভিমুখী হতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা নিঃসন্দেহে ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংলাপ হতে হবে। শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি করে নয়, কার্যকর ও সুষ্ঠু সরকারি অর্থিক ব্যবস্থাপনার উপস্থিতি প্রয়োজন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা অর্জন। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে প্রতিটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অর্থ সরকারি ট্রেজারিতে জমা দিতে হবে। সেটা ল্যাবরেটরি টেস্ট, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া বা অন্য কোনও ইউজার ফিস হতে পারে। সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার নীতি পরিবর্তন করে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অর্থ স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের অধিকার দিতে হবে। সেবা প্রদানকারীদেরকে আর্থিক ব্যবস্থাপনা, জনবল পরিচালনা ও সেবা প্রদানে স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। একই সঙ্গে আর্থিক ব্যয় ও পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সৃষ্টি পূর্বশর্ত। এটা সেবা প্রদানকারীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি করবে এবং প্রতিষ্ঠানে দক্ষতা ও সেবার মান উন্নত হবে। স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে হলে সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, চিকিৎসকদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় প্রাপ্য মর্যাদা ও আর্থিক প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে দুষ্কৃতকারীদের হাতে নিহত চিকিৎসক বনাম আহত ইউএনও’র প্রতি রাষ্ট্রের আচরণের বৈপরীত্য উল্লেখ্য। দক্ষ ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার বিপরীতে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত ও জাতীয়ভাবে পরিশোধিত অর্থের যথাযথ ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের দ্বৈত প্র্যাকটিসের অবসান ঘটাতে হবে। কর্মীদের ভেতর প্রতিষ্ঠানের প্রতি নিজস্বতার অনুভূতি তৈরিতে, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, সেবার মান উন্নত করতে দ্বৈত প্র্যাকটিসের অবসান প্রয়োজন।

স্বাস্থ্যসেবায় কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে হলে লক্ষ্যাভিমুখী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ন্যূনতম বাজেট বরাদ্দ রেখেও সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্য এসেছে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তুলতে পারার জন্য। প্রাইমারি হেলথ কেয়ারকে সর্বতোভাবে শক্তিশালী করার মধ্যে দিয়ে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার লড়াইয়ে জিততে হবে। দেখতে হবে, কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে আগে বিনিয়োগ করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের সমস্ত সেবা, সামগ্রী-কে কোডিং-এর আওতায় এনে প্রতিটি সেবার অর্থমূল্য স্বচ্ছতার সঙ্গে সেবা প্রদানকারী ও সেবা গ্রহণকারীর (ক্রেতার) কাছে প্রতীয়মান করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবায় সেবা প্রদানকারী ও সেবা গ্রহণকারী (ক্রেতা)-কে যেন স্পষ্টভাবে পৃথক করা যায়। সেবা গ্রহণকারী যেন তার সেবার গুণমানের মূল্য ধরতে সক্ষম হয়। যা স্বাস্থ্য খাতে বাজারশক্তির বিকাশ ও মানসম্পন্ন সেবার সূচনা করবে।

স্বাস্থ্য খাতের অপর্যাপ্ত বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয়ই বেশি, উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। উন্নত স্বাস্থ্য গবেষণার জন্য বরাদ্দ দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে জনবল ও অনুপাত স্বীকৃত মাত্রায় এনে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। একটি সুশৃঙ্খল, সুসংগঠিত স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তার ওপরে ভিত্তি করে আসবে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির সাফল্য। সরকারি-বেসরকারি খাত হবে সেখানে পরস্পরের পরিপূরক।

স্বাস্থ্য খাতে তথ্য প্রাপ্তিতে এক বিশাল ঘাটতি আছে। আমাদের একটি জাতীয় বৃহদায়তন ও সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। যেখানে সহজ পন্থায় নীতি নির্ধারক, গবেষক, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, সেবাদাতা, সেবাগ্রহীতা, রোগী ও অন্যরা যেন প্রয়োজনীয় তথ্য ও তার প্রশ্নের উত্তর পায়, আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির আলোকে গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশলপত্রে (২০১২-২০৩২) স্বাস্থ্য বাজেট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশে উন্নীত করা ও স্বাস্থ্যসেবা পেতে ২০৩২ সালে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় (OOP) ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। গত আট বছরে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে না এগিয়ে উল্টোমুখে হাঁটা দিয়েছে।

সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জরুরি নয়। বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যম স্বাস্থ্য। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয়, এমন দেশও সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এগিয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতকে দুর্দশার অতলগ্রাস থেকে উদ্ধার করে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সর্বাগ্রে দরকার সুউচ্চ রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও দৃঢ় নেতৃত্ব।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। সিনিয়র কনসালটেন্ট ও ল্যাব কোঅর্ডিনেটর, প্যাথলজি বিভাগ, এভার কেয়ার হাসপাতাল

mahbubhistopath@gmail.com