অনেককাল আগে ওপরের আলোচনাটা প্রথম শুনেছিলাম আমার অন্যতম প্রিয় stand-up কমেডিয়ান জর্জ কার্লিন এর প্রেজেন্টেশনে। ভাষায় শব্দের নেগেটিভিটি কমিয়ে সেটাকে সফট কোরে বলার চর্চা, যেটা পরিচিত ইউফেমিজম নামে, সেটাকে কার্লিন তীব্রতমভাবে আক্রমণ করেছিলেন তার স্বভাবজাত তীক্ষ্ণ স্যাটায়ারে। ভাষার মূল ধারার আলোচনায় গত কয়েক দশকে ইউফেমিজম নিয়ে এত কথা হলো, এত করে আমাদেরকে প্রেসক্রাইব করা হলো ব্যবহার করতে, কিন্তু কার্লিন কেন এর এত বিরোধী?
করোনার আগে এবং করোনার সময় বাংলাদেশে ফেরত আসা সৌদি প্রবাসীদের বিদেশ ফেরত যাওয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা গত কয়েক দিন সব মিডিয়ায় খুব গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। এই মানুষগুলো যে এক ভয়ঙ্কর সংকটে পড়েছে সেটা আমরা ‘শহুরে ভদ্রলোক’গণ হয়তো টেরই পেতাম না, যদি না তারা পরপর কয়েক দিন এয়ারলাইন্স টিকেটের অফিসের সামনে ভীষণ হট্টগোল না করতেন, ঢাকার রাস্তা অবরোধ না করতেন। আমরা এখানে এটুকু খেয়াল রাখবো, এই মানুষগুলোকে তাদের অত্যন্ত ন্যায্য দাবি মানতে রাস্তা আটকে ফেলার মতো চাপ তৈরি করতে হয়েছে।
এই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বৈদেশিক কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তো আছেই, সঙ্গে তাদের পাঠানো এই টাকা এদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মূল খাত গার্মেন্ট রফতানি না। প্রাথমিক দৃষ্টিতে রফতানির অঙ্কটা বড় মনে হলেও এটা থেকে বাদ যাবে গার্মেন্টের এইসব পণ্য তৈরি করার জন্য আমদানির পরিমাণ। তাতে গার্মেন্টের বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত আয় প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের চাইতে অনেক কম। সমাজের উঁচু তালার একটা শক্তিশালী গ্রুপ হওয়ার কারণে গার্মেন্ট মালিকরা খুব জোর গলায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রফতানির মূল খাত হিসেবে নিজেদেরকে দাবি করেন। ওদিকে অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী কর্মীরা সংগঠিত নন এবং তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণেই এই রাষ্ট্র তাদের প্রয়োজনীয় স্বীকৃতি দেয় না।
এবারের সংকটটা শুরু হয় যখন সৌদি আরব ঘোষণা করে বাংলাদেশের আটকে পড়া সৌদি প্রবাসীদের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সৌদি আরবে ফিরতে হবে। এছাড়া সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে সৌদি আরবের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পুনরায় চালুর একটা ঘোষণা এসেছিল সেখানকার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
বাংলাদেশের সরকারি বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও সৌদি সরকারের শর্ত সাপেক্ষে ফ্লাইট আংশিকভাবে চালু করতে চেয়েছিল। কিন্তু সৌদি আরবের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সেই অনুমতি বাংলাদেশ বিমানকে দেয়নি। এরপর বাংলাদেশও সৌদি এয়ারের ফ্লাইট চলাচলের অনুমতি বাতিল করে দেয়।
ফলে প্রচণ্ড অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় সৌদি প্রবাসীরা। তাদের খুব বড় বিপদ তৈরি হয়। তারা আবার সৌদি আরবে ফিরে যেতে পারবেন এই আশায় দেশের কয়েক মাস ধার-কর্জ করে তাদের পরিবার নিয়ে জীবন যাপন করেছেন। তারাই যদি বিদেশে যেতে না পারেন তাহলে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, সেটা ধারণা করা খুব সোজা।
আমি মানি, বাংলাদেশের বিমানকে সৌদি আরবে ল্যান্ডিংয়ের অনুমতি না দিয়ে আন্তর্জাতিক রীতি ভঙ্গ করেছে সৌদি আরব। কিন্তু এই প্রচণ্ড ইমার্জেন্সি সিচুয়েশনে আমরা পাল্টা ব্যবস্থাটা কি না নিলে পারতাম না? শুধু সৌদি আরবের এয়ারলাইন্সে আমাদের মানুষকে পাঠানো শুরু করে তারপর বাকি আলোচনা করলে কী খুব ক্ষতি হতো? কিন্তু আমরা সেটা করিনি বরং আমরা এই মানুষগুলোকে ঠেলে দিলাম এক ভয়ঙ্কর স্ট্রেসের মধ্যে।
সেই সমস্যার আপাত সমাধান হয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাতে আমরা জানতে পেরেছিলাম সৌদি আরব কর্মীদের ইকামার মেয়াদ বাড়িয়েছে। কিন্তু এখন আমরা জানতে পারছি ভিন্ন কথা। কোনোরকম অফিসিয়াল সিদ্ধান্ত এখনও সৌদি আরবের পক্ষ থেকে আসেনি যার কারণে এই লেখা যেদিন জমা দিচ্ছি সেদিনও (মঙ্গলবার) কারওয়ান বাজারের রাস্তা কিছু সময়ের জন্য অবরোধ করেছিলেন এই কর্মীরা সমাধানের আশায়।
এদিকে তাদের সামনে এখন খুব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা পরীক্ষার সনদপত্র। এর মধ্যেই আমরা মিডিয়ায় দেখেছি কোনোরকমে সনদপত্র নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে মানুষ বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের জন্য ঢাকা শহরে একটি মাত্র পরীক্ষা কেন্দ্র কেন, কেনইবা সেটার কারণে পরীক্ষার ফল দিতে দেরি হওয়া জনিত কারণে এই প্রবাসী কর্মীদের এই ভয়ঙ্কর ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হচ্ছে, এসব প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই আসছে। যে মানুষগুলোর বিদেশে ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাদের ব্যাপারেই আমরা যখন আমাদের অক্ষমতা এবং অদক্ষতার স্বাক্ষর রাখছি, তখন কি আমরা একটু ভেবে দেখছি পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ?
এর মধ্যেই আমরা নানা মিডিয়ায় খবর পেয়েছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা করোনার কারণে কাজ হারিয়েছেন, কিন্তু দেশে ফিরে আসতে পারেননি। এই ধরনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে করোনার প্রভাবে আগামী সময় লাখ লাখ প্রবাসী কর্মী কাজ হারিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসবেন। এদিকে করোনার মধ্যেও দেশে ফিরে এসেছেন অনেক কর্মী। করোনার লকডাউন শুরু হওয়ার আগেই দেশে ছুটিতে এসেছিলেন ২ লাখ প্রবাসী কর্মী। আর এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে ফিরেছেন আরও এক লাখ। অর্থাৎ এই তিন লাখ কর্মী দেশে এসে আটকা পড়েছেন। সব রকম প্রস্তুতি শেষ করেও বিদেশে যেতে পারেননি কমপক্ষে এক লাখ কর্মী।
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণে এক সভায় জানানো হয় এ বছর আগস্ট মাস পর্যন্ত এক লাখ ৮১ হাজার ২৭৩ জন মানুষের বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ গত বছর এই সময়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছিল ৪ লাখ ৬ হাজার ৯৬২ জন মানুষের। আর এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৭ লাখ মানুষের বৈদেশিক কর্মসংস্থান হবে। তাহলে আমরা বুঝতে পারছি সম্ভাব্য কত মানুষের কর্মসংস্থান হয়নি করোনার কারণে।
করোনার সময়ে দেশে ফেরত আসা প্রবাসীরা কেমন আছেন সেটা জানতে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এপ্রিল ও মে মাসে একটি জরিপ পরিচালনা করে। ‘বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীদের জীবন ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব' শীর্ষক জরিপে জানা যায়, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির সময়ে দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই কোনও আয়ের উৎস নেই। ৭৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা এখন প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে রয়েছেন। ৩৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের নিজেদের সঞ্চয় বলতে এখন আর কিছু নেই৷ ৯১ শতাংশ বলেছেন, তারা সরকারি বা বেসরকারি কোনও সহায়তা পাননি।
আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি করোনার কারণে এসে আটকে পড়া মানুষদের জীবনে কত বড় সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে? কোনও সন্দেহ নেই এই আটকে পড়া কর্মীদের একটা বড় অংশই ফেরত যেতে পারবেন না। এবং এটাও নিশ্চিত আরও বহু কর্মীকে দেশে ফিরে আসতে হবে। বিদেশ থেকে ফিরে আসা কর্মীদের জন্য সরকার করোনার শুরুতে তাৎক্ষণিকভাবে ২০০ কোটি টাকা এবং এরপর বাজেটে আরও ৫০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে, যেখান থেকে যেসব কর্মী ফিরে যেতে পারবেন না তাদেরকে সহজ শর্তে এবং কম সুদে ঋণ দেওয়া হবে।
একটা সহজ হিসাবে দেখা যাক এই টাকা আসলে কত টাকা। এমন বহু তহবিলের অর্থ বাংলাদেশের শেষ পর্যন্ত খুব একটা ছাড় করা হয় না, কিন্তু ধরে নেই এই টাকা পুরোটা ছাড় করা হবে। বিদেশ থেকে নতুন করে ফেরত আসাদের কথা বাদই দেই, এই টাকাটা যদি দেশে এখন পর্যন্ত ফিরে আসা তিন লাখ কর্মীর মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয় তাহলে প্রতি জন কর্মী পাবেন ২৩ হাজার ৩৩৩ টাকা। এর মধ্যে কিছু কর্মী ফিরে যেতে পারলে মাথাপিছু আর কয়েক হাজার টাকা বাড়বে। এই অর্থে কী করে জীবিকা সংস্থানের মতো কিছু করতে পারবেন এই মানুষগুলো?
‘প্রবাসী কামলা’ শব্দটা কয়েকদিন আগে একজন অতি আলোচিত-সমালোচিত ব্লগার ব্যবহার করেছিলেন তার একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসে। আটকে পড়া সৌদি প্রবাসী কর্মীদের আন্দোলনে কারা ইন্ধন জোগাচ্ছে এই ধরনের একটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি এই শব্দযুগল ব্যবহার করেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, আমরা অনেকে সরাসরি বলে ফেলি না, কিন্তু এই সমাজের ‘সুশিক্ষিত’ জনগণ তো বটেই, এই রাষ্ট্রও এই কর্মীদেরকে এই চোখেই দেখে। বিভিন্ন দেশে প্রবাসী কর্মীদের সংকটের সময় আমাদের দূতাবাসগুলো পর্যাপ্ত সাহায্য দেওয়া দূরে থাকুক নানারকম হয়রানি তাদের করে–এমন খবর নিয়মিতভাবে মিডিয়ায় আসে।
আমরা, ‘অক্ষম’রা যারা তাদের জন্য কিছু করতে পারছি না, তারা এখন তাদের জন্য একটা ইউফেমিস্টিক শব্দ বানিয়ে, ব্যবহার করে তাদের সম্মানিত করার চেষ্টা করছি। হ্যাঁ, আমি ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’র কথা বলছি। ভেবে দেখুন তো ঋণে জর্জরিত হয়ে আধপেটা খেয়ে রোদের বৃষ্টিতে এই মুহূর্তে যেই মানুষগুলো দিনের পর দিন টিকিট আর ভিসা নবায়নের আশায় অপেক্ষা করে আছে তাদের কাছে কেমন লাগবে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ শব্দযুগলের সান্ত্বনা?
শুরু করেছিলাম জর্জ কার্লিনের ইউফেমিজম নিয়ে দেওয়া বক্তব্য দিয়ে। কার্লিন ইউফেমিজমের ঘোর বিরোধী, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন ইউফেমিজম আসলে বাস্তবতাকে লুকিয়ে ফেলে। বাস্তবতাকে লুকিয়ে ফেলার কারণে আমাদের সামনে সেই বিষয়ের ভয়াবহতা আর থাকে না। এবং আমরা এক ধরনের আত্মতৃপ্তিতে ভুগি, যেটা কোনও নেগেটিভ বিষয়ের সত্যিকারের পরিবর্তনের পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তিটা আমিও গ্রহণ করি।
এটা ঠিক কোনও কর্মী দেশকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে বিদেশে কাজ করতে যান না, যান নেহাত নিজের এবং পরিবারের জীবিকা অর্জনের জন্য। এর সঙ্গে অবশ্য নিশ্চিতভাবেই আছে এই রাষ্ট্রের অক্ষমতা - মানুষগুলোকে উপযোগী কাজ দিতে পারেনি এই রাষ্ট্র। দশকের পর দশক ধরে ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবনের নানা রকম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে কোটি কোটি মানুষকে। এর বিনিময়ে তাদের পেশাগত সংকট যেমন দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়ানো, বিদেশে যেতে আশপাশের দেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি টাকা দিতে বাধ্য হওয়া, বিদেশে নিয়োগকারীর চুক্তি ভঙ্গ, শারীরিক-মানসিক অত্যাচার এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে তাদের জীবনকে একটু সহজ করার চেষ্টা এই রাষ্ট্র করেনি। আমরা, 'সুশিক্ষিত-সচেতন' নাগরিকরাও রাষ্ট্রের ওপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারিনি তাদের এইসব সংকট থেকে মুক্ত করতে।
‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ শব্দযুগল, আমি বিশ্বাস করি, প্রবাসী কর্মীদের প্রতি এই রাষ্ট্রের সীমাহীন অবজ্ঞা আর তাদের স্বার্থ রক্ষায় আমাদের সামষ্টিক অক্ষমতার এক প্রতীক।
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট