মিথ্যাচারে আক্রান্ত শেখ কামাল

হায়দার মোহাম্মদ জিতুউইলিয়াম ডোনাল হ্যামিলটনের হ্যারাল্ড থিউরির অর্থ দাঁড়ায় নির্লিপ্ত এবং নির্বোধের মতো পূর্বেরজনকে অনুসরণ বা অনুকরণ করা। যাকে গড্ডালিকা প্রবাহও বলা যায়। সচরাচর এই প্রবণতা পশুশ্রেণির মাঝে দেখা যায়। তথ্যমতে, এই অন্ধ অনুকরণের ফলে তুরস্কে প্রায় ১৫০০ ভেড়া মারা পড়েছিল। বিষয়টি ছিল এমন যে একপাল ভেড়া পাহাড়ের পাশে চরে বেড়াচ্ছিল। এর মাঝে হঠাৎ একটি ভেড়া পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে। ব্যস, তার দেখাদেখি একেবারে নির্লিপ্ত এবং নির্বোধের মতো সেখানকার ১৫০০ ভেড়ার সবক’টি একে একে লাফিয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষেত্র বিশেষে বহুকাল যাবৎ এই তত্ত্ব প্রয়োগের অপচেষ্টা চলছে। যদিও এ ধরনের আচরণ এখানকার জনগণ বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। কিন্তু তবু এই তত্ত্বের বাস্তবায়ন চেষ্টা আজও বন্ধ হয়নি; বরং চোরাগোপ্তাভাবে চলে আসছে। তবে আনন্দের বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে অর্থাৎ তথ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে মানুষ এখন মুহূর্তেই বুঝে যায় সাদা ও কালোর তফাৎ।

বেশ দীর্ঘকাল যাবৎ বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালকে নিয়ে এমন তত্ত্ব প্রয়োগের চেষ্টা চলে আসছে। মিথ্যাচারের মধুচন্দ্রিমায় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বকে নাই করে দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। অথচ বঙ্গবন্ধুপুত্র শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রথম ব্যাচের একজন ক্যাডেট অফিসার ছিলেন এবং সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট থাকা অবস্থায় প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সাংস্কৃতিক বোধ সঞ্চালনের তাগিদে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব এবং পরবর্তী সময়টায় নিরলসভাবে কাজ করেছেন বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ ও ছড়িয়ে দিতে। নাটক, কবিতা, গান সব মাধ্যমকেই সমাদৃত করেছেন অংশগ্রহণকারী, সংগঠক এবং দর্শক হিসেবে। সংগঠক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নাট্যচক্র’ নামের নাটকের সংগঠন প্রতিষ্ঠায় যুগ্ম আহ্বায়ক এবং আরেক নাট্য সংগঠন ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।

অভিনয় শিল্পী হিসেবে টিএসসি থেকে কলকাতার মঞ্চ সব জায়গায় আলো ছড়িয়েছেন। কলকাতার মঞ্চে ফেরদৌসি মজুমদারসহ অভিনয় মুগ্ধতায় সারি সারি লাইনে অটোগ্রাফ দিয়েছেন। সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর সচেতনতার মাত্রা এতটাই জোরদার ছিল যে পাকিস্তানি সামরিক সরকার কর্তৃক রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণায় সংস্কৃতি কর্মী জড় করে জায়গায় জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং সেখানে নিজে অন্যদের নিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন। ছায়ানটে সেতার বাজানোর তালিমও নিচ্ছিলেন।

খেলাধুলায়ও অনুরাগ ছিল অপ্রতিরোধ্য। ঢাকার শাহীন স্কুলে পড়াকালীন নিখুঁত লাইন লেন্থের ফাস্ট বল করতেন। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও খেলেছিলেন। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি খেলারও খেলোয়াড় এবং সংগঠক ছিলেন। তাঁর হাত ধরেই দেশের ঐতিহ্যবাহী আবাহনী ক্রীড়া চক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

তবে এত অর্জনের বাইরে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যাচার করা হয় তা হলো, ডালিমের স্ত্রী অপহরণের মিথ্যা অপবাদ। এ নিয়ে খোদ ডালিম তার ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইতে পরিষ্কার লিখেছেন, অপহরণের ঘটনার দিন ঢাকা লেডিস ক্লাবে তার খালাতো বোন তাহমিনার বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও রেডক্রসের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার পরিবারসহ সামরিক ও বেসামরিক অতিথিরা।

ডালিমের কানাডা ফেরত শ্যালক বাপ্পির চুল টানা নিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলেদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। বিষয়টা সেখানেই নিষ্পত্তি হয় না। গাজী গোলাম মোস্তফা সশস্ত্র লোকজন নিয়ে ক্লাবে এসে ডালিম, ডালিমের স্ত্রী ও তাদের পরিবারের আরও কয়েকজনকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।

অথচ জুড়ে দেওয়া হয়েছিল শেখ কামালের নাম! আসলে এসব রসালো গল্পের ব্যাপ্তি দ্রুত হবে জেনেই তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবী সংখ্যালঘুরা এমনটা করেছিল। কারণটাও পরিষ্কার ছিল। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে হিসেবে শেখ কামাল যেভাবে মহীরুহ হয়ে উঠছিলেন, আলো ছড়াচ্ছিলেন, তাতে তাদের কুকর্মের পরিধি ছোট হয়ে আসছিল এবং ভবিষ্যৎ ছিল শঙ্কার মাঝে।

তবে ট্র্যাজেডি হলো, ২৬ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ, সংস্কৃতি এবং খেলাধুলাকে এগিয়ে নিয়েছেন, সেটাকে তাঁর সম্পর্কিত এক-দুটি মিথ্যাচারে ঢেকে ফেলার চেষ্টা চলে আসছে। যদিও এখন তথ্যের অবাধ প্রবাহ আছে। কাজেই তথ্যপ্রবাহের এই সময়ে কেউ যেন আবারও সেই পুরনো মিথ্যাচারগুলোকে গড্ডালিকা প্রবাহ বা নির্বোধ-নির্বুদ্ধিতার সঙ্গে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকা জরুরি। পাশাপাশি প্রকৃত সত্যকে সবার কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ নিতে হবে আরও জোরালোভাবে।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ

haiderjitu.du@gmail.com