ডেল্টার শিক্ষা আর ওমিক্রন ঠেকানোর প্রস্তুতি

এরশাদুল আলম প্রিন্সকরোনার প্রকোপ অনেকটা কমে গেলেও একেবারে চলে যায়নি। করোনা সংক্রমণের প্রায় ২০ মাস পর নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশে শনাক্তের হার নেমে আসে দেড় শতাংশের নিচে। এরই মধ্যে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। বিশ্ব যখন ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছিল ঠিক তখনই করোনার এ  নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়াতে শুরু করেছে।

প্রথমে আফ্রিকায় শুরু হলেও এখন তা ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি এশিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়ার হার যদিও এখনও ততটা বেশি নয়, তবে অতীতের সবগুলো ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে এটা ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক যে ওমিক্রনও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ইতোমধ্যে ওমিক্রন সংক্রমিত হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশেও যে এটা ছড়িয়ে পড়বে না তা বলা যায় না।

এছাড়া ইতোমধ্যে আফ্রিকা থেকে ২৮ জন নাগরিক দেশে ফিরেছেন এবং তাদের কোনও হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। কোয়ারেন্টিনের ভয়ে বাড়তি ঝামেলা এড়াতে তারা দেশে এসেই লাপাত্তা হয়ে গেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, তারা দেশের মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশে গেছেন। আগতরা যে ওমিক্রনে আক্রান্ত নয় তা আমরা নিশ্চিত নই। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে দ্রুতই  ওমিক্রন আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই সতর্কতার বিকল্প নেই।

এর আগে ইতালি থেকে কয়েকজন প্রবাসী দেশে এসে কোয়ারেন্টিন এড়িয়ে সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে মিশে যায়। ধারণা করা হয়, প্রাথমিকভাবে তাদের মাধ্যমেই হয়তো দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়েছিল। সুনির্দিষ্টভাবে এর সত্যতা নিশ্চিত করা না গেলেও স্বাভাবিকভাবেই করোনাকালীন বহির্গমন  ও বহিরাগম নিয়ন্ত্রিত করা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবিধির মধ্যেই পড়ে। কিন্তু আমরা সে রকম ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি। বিদেশ থেকে এলে তাদের জন্য আমরা মানসম্পন্ন কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে পারিনি। পারিনি তাদের ওপর এটা বাধ্যতামূলক করতে।

কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা না গেলে সবাই এটি এড়িয়ে যেতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। সব আগমনকারীদের বাধ্যতামূলক পরীক্ষা ও আক্রান্তদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা একটা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। বিদেশ থেকে প্রত্যাগতদের আত্মীয়-স্বজনদেরও বুঝতে হবে যে প্রথমে তাদের সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আগমনকারী ও তাদের স্বজনদের এ বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে।

করোনা যখন দেশে প্রথম আঘাত হানে এসব সাধারণ বিষয় নিয়ে তখনও সবাই কথা বলেছেন। কিন্তু, দুঃখের বিষয় গত ২০ মাসেও মাসেও এ বিষয়ে আমাদের অবস্থা প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। সমন্বয়হীনতা ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির মাশুল ইতোপূর্বে দেশের মানুষকে দিতে হয়েছে। করোনার ২০ মাসে আমাদের আগাম প্রস্তুতি বা জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা কতটুকু বেড়েছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। সক্ষমতা কিছুটা বাড়লেও জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য তা অপ্রতুলই মনে হয়। করোনা আক্রান্ত বা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে এ বার্তাই পাওয়া যায়।

এছাড়া করোনা চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক। এর পেছনে অবশ্য আন্তর্জাতিক টিকা ও ওষুধ বাণিজ্য অনেকটাই দায়ী। তবে, দেশীয় সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি থাকলে সেসব দূর করতে হবে।

আমাদের আগে ভারতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে। সেখানে অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সীমান্তগুলো তখন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় করায় বাংলাদেশে ডেল্টার ভয়াবহতা ভারতের মতো হয়নি। যদিও দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টেই বেশি প্রাণহানি হয়েছে। তবে  বিশ্বব্যাপীই করোনা প্রকোপ কমে গেলে বাংলাদেশেও পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।

করোনা ব্যবস্থাপনায় প্রথম দিকে যথেষ্ট ত্রুটি থাকলেও ধীরে ধীরে ব্যবস্থাপনা ত্রুটিগুলো দূর হতে থাকে। তবে সর্বশেষ যে অব্যবস্থাপনা নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে তা হচ্ছে টিকা ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি। সেটিও এখন অনেকটাই দূর হয়েছে। তবে দেশের অধিকাংশ মানুষই এখনও টিকার আওতায় আসেনি। দুই ডোজ টিকা দিয়েছে এমন সংখ্যা ও কোনও ডোজই দেয়নি এমন  সংখ্যাই বেশি। তাই সবাইকেই টিকার আওতায় আনতে হবে। দেশে নতুন ভ্যারিয়েন্ট সমাগত, অথচ আগের ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে টিকাই দেওয়া হয়নি। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।

করোনায় টিকা কেন্দ্রিক বিশ্ব বাণিজ্যের ফলে অনেক দেশই পর্যাপ্ত টিকা পায়নি। দেখা যাচ্ছে, যেসব দেশ টিকা পর্যাপ্ত টিকা পায়নি ও তাদের নাগরিকদের টিকা দিতে পারেনি, সেসব দেশ থেকেই নতুন ওমিক্রন ছড়িয়েছে। ওমিক্রন দমনে নতুন টিকা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে, আমাদের পুরনো স্বাস্থ্যবিধিতেই ফিরে যেতে হবে।

মূলত, করোনাকালীন এ সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিটি আমাদের সব সময় মেনে চলার অভ্যাস গড়তে হবে। করোনা আমাদের জীবন যাত্রায় বা লাইফস্টাইলে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারতো। আমরা স্বাস্থ্যবিধিকে সব সময়ের জন্যই নিজেদের জন্য অপরিহার্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু প্রথম থেকেই করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাতে আমরা সর্বোচ্চ অনীহা দেখিয়েছি। আর করোনা একটু কমে যাওয়াতে স্বাস্থ্যবিধি পুরোই অগ্রাহ্য করা শুরু করেছি।  

ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়ার এই প্রাক্কালে আমাদের  প্রাথমিক ও সার্বক্ষণিক রক্ষাকবচ হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি পালন। পরিবর্তিত অবস্থায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে বৈদেশিক যোগাযোগের বিষয়টিও আমাদের পুনর্বিবেচনা করতে হবে। দেশভেদে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এছাড়া নতুন ভেরিয়েন্ট দমনে অন্যান্য দেশ কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। সে অনুযায়ী আমাদেরও ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেও এমনকি ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও ওমিক্রন আক্রান্ত করতে পারে। তারা আরও বলেছেন, ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতা ডেলটার চেয়েও বেশি। কাজেই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এখন থেকেই প্রতিরোধমূলক (স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতামূলক) প্রতিকারমূলক (টিকা, চিকিৎসা) ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।

করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ায় প্রথম দিকে এটা নিয়ে মানুষের ভেতরে নানা রকম ভয়ভীতি কাজ করেছে। সংক্রমিতদের সঙ্গে আমরা ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে পারিনি। তাদের বাড়ি-ঘরে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমেই এসব করা হয়েছে। কেউ সংক্রমিত হলে তাকে বাড়ি ছাড়া বা এক ঘরে করে রাখার প্রবণতাও দেখা গেছে। এর ফলে যারা সংক্রমিত হয়েছে তারা বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করেছে। এখন আবার সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সন্দেহভাজন আক্রান্তদের বাড়ি-ঘরে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এটা কোনও সঠিক পদক্ষেপ নয়। কেউ আক্রান্ত হলে তার হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে ও সেই সঙ্গে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রান্তদের আশ্বস্ত করে তাদেরকে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। ভয়-ভীতি দেখিয়ে নয়। আক্রান্ত হয়ে কেউ ফৌজদারি অপরাধ করেনি যে তাকে আটক করে রাখতে হবে।

পরীক্ষা ও চিকিৎসার ওপর জোর দিতে হবে। ওমিক্রন আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য বিশেষ ধরনের আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট প্রয়োজন হয়। জানা যায়, আইইডিসিআর ছাড়া এ ধরনের আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট অন্য কোথাও নেই। তাই অন্যান্য হাসপাতালেও আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

করোনার ২০ মাসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। চিকিৎসক ও রোগী সবার জন্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করতে হবে। সবাইকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ওমিক্রন প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আগের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে একটি সমন্বিত  উদ্যোগ জরুরি। সরকার, জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সবার এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট