X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতির ধারণাসূচক: ক্রমাগত উপেক্ষার ফল কী?

এরশাদুল আলম প্রিন্স
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:৪৭আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:৪৭

প্রত্যেক বছরের মতো এবারও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশের দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় এবার ১ পয়েন্ট কম পেয়ে ২৪ পয়েন্ট পেয়েছে, ফলে গত বছরের তুলনায় এ বছর দুই ধাপ অবনতি হয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে নিচের দিক থেকে আমাদের অবস্থান দশম ও ওপরের দিক থেকে ১৪৯তম অবস্থানে আছি।

টিআইবির ধারণাসূচকে ফলাফল যাই হোক, দেশে দুর্নীতি যে সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে, গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই তা বোঝা যায়। হাজার কোটি টাকার নিচে দুর্নীতির খবর এখন সংবাদমূল্য হারিয়েছে। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অনেক আগেই। কিন্তু সেই যুদ্ধ অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়ে গেছে।

টিআইবির ধারণাসূচকে দুর্নীতি বলতে বোঝানো হয়েছে ব্যক্তিগত সুবিধা বা লাভের জন্য সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার। সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার সরকারের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই করতে পারে। সরকারি কর্মচারী, আমলা ও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতি নিয়েই টিআইবির প্রতিবেদন।

দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে যে আইন আছে সেখানেও মূলত সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়েই কথা বলা হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী এ আইনটি হয়েছে ১৯৪৭ সালে। এ আইন অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার তথা ঘুষ বা অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে কোনও না কোনোভাবে লাভবান হওয়াকেই দুর্নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

দণ্ডবিধির ১৬১-১৬৫ ও ১৬৫-ক ধারার অপরাধগুলোই এ আইনের অধীনে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এ আইনের মাধ্যমে অন্যান্য বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও বিচার করা যাবে। কাজেই, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন ও টিআইবির দুর্নীতির ধারণাসূচকে ‘দুর্নীতি’র সংজ্ঞাগত কোনও পার্থক্য নেই।

৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই ধারণাসূচক অনুযায়ী, গত ১৬ বছরের মধ্যে এবারই দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল।

এ কথা সত্য যে গত ১৬ বছরে আমাদের অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। ব্রিজ, সড়ক, মহাসড়ক, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, বন্দর ইত্যাদি অনেক কিছু হয়েছে। আরও অনেক কিছু হবে, হচ্ছে। এসব উন্নয়ন নিশ্চিতভাবেই আমাদের অর্থনীতি তথা জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এসব আমরা চাইও। কিন্তু উন্নয়নে অতি মনোযোগ দিতে গিয়ে হয়তো দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়টি এখানে গুরুত্ব হারিয়েছে।

জনগণের মাঝে একটা কথা এখন বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তা হলো– ‘যত উন্নয়ন তত দুর্নীতি’। উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতির এরকম সম্পর্ক রয়েছে কিনা সে বিষয়েও গবেষণা হওয়া দরকার। তবে মাঝে মাঝে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ও তহবিল নিয়ে যেসব সংবাদ গণমাধ্যমে আসে তাতে উন্নয়ন ও দুর্নীতির মাঝে একটা সম্পর্ক আছে বলেই মনে হয়। তবে, সে যা-ই হোক দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে আমরা জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করতে পারিনি সেটা স্পষ্ট। এভাবে দুর্নীতি চলতে থাকলে উন্নয়নের প্রকৃত সুফল থেকে আমরা বঞ্চিত হবো।

টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান ছাড়া সবার অবস্থান আমাদের ওপরে। অর্থাৎ আমরা শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছি। কিন্তু ওদিকে যে আমরা ভারত, পাকিস্তান এমনকি শ্রীলঙ্কার চেয়েও বেশি খারাপ অবস্থানে আছি সেটিও বিবেচনা করতে হবে। যারা কম দুর্নীতিগ্রস্ত তাদের গল্প এখানে করে লাভ লাই। তবে, দুর্নীতিতে নিচের দিক থেকে আমরা সোমালিয়া, সাউথ সুদান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলার সঙ্গে তুল্য।

টিআইবির ধারণাসূচকের এবারের প্রতিপাদ্য “দুর্নীতি ও অবিচার”। দুর্নীতির সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক আছে কিনা সেটা নিশ্চিত জানা না গেলেও দুর্নীতির সঙ্গে অবিচারের যে একটা সম্পর্ক আছে টিআইবির প্রতিবেদনে সেটা জানা গেলো। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৪৮টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় সিপিআই স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৮, ৩৬ ও ২৯। এদিকে আমাদের স্কোর আছে ২৪। এর মানে ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের স্কোরের (২৯) চেয়েও আমাদের অবস্থান নিম্নতর। অর্থাৎ হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের পরের ধাপে আমাদের অবস্থান। এছাড়া ফ্রিডম হাউজ তাদের এক সমীক্ষায় বলছে, নির্বাচনি গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রসমূহের গড় স্কোর ৩১। সেখানে বাংলাদেশের ২৪ স্কোর। কাজেই প্রতিবেদনে বোঝাই যাচ্ছে যে দুর্নীতির সঙ্গে শুধু অবিচারের সম্পর্ক নয়, নির্বাচন ও গণতন্ত্রেরও সম্পর্ক রয়েছে।

দুর্নীতি এক দুষ্ট চক্র। এর সঙ্গে ন্যায়বিচারের সম্পর্ক আছে। দুর্নীতি করে যদি কেউ পার পেয়ে যায় তবে সেখানে জিরো টলারেন্স প্রদর্শন করা হয় না। রাষ্ট্রক্ষমতা, অর্থবল, বাহুবলের মাধ্যমে সমাজে দুর্নীতি প্রসারিত হয়। বিচারহীনতাও এক বড় অবিচার। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে, কিন্তু তাদের আইনের আওতায় আনা তো পরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে একটা রাষ্ট্রীয় ‘ধমক’ও শোনা যায় না। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা কী তা গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই স্পষ্ট। ঋণখেলাপিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে অবিচার এভাবেই বাড়তে থাকে। আর সমাজে অবিচার থাকলে দুর্নীতি আরও নতুন মাত্রা পায়। আমরা এখন সে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থায় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, তদন্ত করা তো পরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলাও কঠিন। আমরা প্রায় সেই অবস্থায় পৌঁছেছি। এ অবস্থায় দুর্নীতিবাজদের নিয়ন্ত্রণ করার আর কোনও হাতিয়ার থাকে না।

টিআইবির প্রতিবেদনে এটা প্রতীয়মান যে যেখানে গণতন্ত্র কার্যকর, যেখানে নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো রক্ষিত হয়, সেখানে দুর্নীতিও কম অথবা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকে।

দুর্নীতি দমনে ‍দুর্নীতি দমন কমিশন কাজ করছে। গণমাধ্যমে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হলে, সরকারি সংস্থার তদন্ত শেষ হলে একপর্যায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও সেখানে শামিল হয়। তারাও ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে যায়। এছাড়া কমিশনের তেমন কোনও কার্যক্রম চোখে পড়ে না। দুর্নীতি দমনের বিরুদ্ধে কমিশনের নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত থাকার কথা। সে লক্ষ্যে তাদের কার্যতালিকাও থাকার কথা। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে কারও দুর্নীতির খবর ছাপা হলেই কমিশন তখন তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন তৈরি করা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যায়। এভাবেই তারা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। সরকারি অফিসের নিয়মিত ঘুষখোর, বড় বড় প্রকল্পের তহবিল তছরুপকারী, অর্থপাচারকারী, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দুদকের কর্মোদ্যোগ কোথায়?

আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রম ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য দুর্নীতি দমন করতেই হবে। তা না হলে একসময় গণতন্ত্র ও উন্নয়ন উভয় চাকাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পরস্পরবিরোধী নয়, বরং টেকসই গণতন্ত্র ও টেকসই উন্নয়ন পরস্পর সহযোগী। আমরা অবিচারের কারণে দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হয়ে উন্নয়ন হলে দুর্নীতি হতেই পারে এমন সব অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছি। এসব করে দুর্নীতির লাইসেন্স দিয়েছি। এতে দুর্নীতি আরও প্রশ্রয় পেয়েছে, অবিচার আরও বিস্তৃত হয়েছে।

দুদক, আমলাতন্ত্র, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ইত্যাদি নানা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা দুর্নীতি দমনে সহায়ক। স্বাধীন গণমাধ্যম ও স্বাধীন বিচার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। এগুলোর অভাব দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে।

টিআইবি প্রতিবছরই দেশের দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রকাশ করে আর প্রতিবছরই সরকার টিআইবির প্রতিবেদনের সমালোচনা করে। সরকার সমালোচনা করতেই পারে। সব সরকারই টিআইবির প্রতিবেদন উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা সে রকম হলে জনগণই সবচেয়ে বেশি খুশি ও লাভবান হতো। এর আগে বিএনপির আমলে বাংলাদেশ চারবার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বিএনপি তখনও টিআইবির বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছিল। কিন্তু তাতে দেশের দুর্নীতি কমেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সব সরকারের আমলেই টিআইবি বিরোধী দলের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। জনগণ চায়, টিআইবি ‘সরকারের এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করুক। দেশের জন্য একটি উত্তম ধারণাসূচক তৈরি করুক। সেজন্য যা যা লাগে সরকার করুক। আমরা চাই দুর্নীতি দমন হোক। দুর্নীতিবাজদের দমন করা হোক।

লেখক: আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রেশনে পণ্য চান শ্রমিকরা
রেশনে পণ্য চান শ্রমিকরা
অশ্রুসিক্ত হয়ে চেলসি ছাড়ার ঘোষণা ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারের
অশ্রুসিক্ত হয়ে চেলসি ছাড়ার ঘোষণা ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডারের
বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-রিসোর্সের ব্যবহার বাড়ানোর আহ্বান ইউজিসি’র
বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-রিসোর্সের ব্যবহার বাড়ানোর আহ্বান ইউজিসি’র
নগরের তীব্র উত্তাপ কি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মনকে ছুঁতে পারে?
নগরের তীব্র উত্তাপ কি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মনকে ছুঁতে পারে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ