রাজনৈতিক শিক্ষায় নজর নেই কারও

মোস্তফা হোসেইন

রাজনীতিবিদদের গুণাবলি তাদের বিশিষ্টজনে পরিণত করে। তাই তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য থাকে জ্ঞাননির্ভর। তাঁরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন, বর্তমান থেকে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদদের কতজন এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী?

উঁচু দরের অনেক নেতার মধ্যেও পাঠাভ্যাস নেই, এমন কথাও শোনা যায়। এই পরিস্থিতি কেমন? জানার জন্য আমরা যদি বিভিন্ন দলের ১০০ কর্মী বাছাই করি তাহলে দেখতে পাবো, ১০ জনও পাওয়া যাবে না, যারা দলীয় নীতি আদর্শ, দলের ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে লেখাপড়া করেছেন।

মনে আছে জিয়াউর রহমানের দেওয়া ১৯ দফা বিষয়ে প্রচলিত প্রবাদতুল্য একটি কথা। তখন বলা হতো, বিএনপি নেতাদের মধ্যে ১৯ জনও পাওয়া যাবে না, যারা ১৯ দফার ৫/১০টি দফার কথা জানেন। রাজনীতি দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, দলীয় নীতি আদর্শ প্রণেতা শীর্ষস্থানীয়রা। বাকি সবাইকে তা জানতে হয় পড়ালেখা করে। জ্ঞান অহরণের জন্য বাড়তি বিষয়ে পড়া থাক দূরের কথা, নিজ দলীয় বিষয়গুলোও না জানা নেতাকর্মীরা কীসের ওপর ভিত্তি করে রাজনীতি করবেন? বাস্তবতা হচ্ছে, দলীয়ভাবে কর্মীদের রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করার কোনও কার্যক্রম বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেই।

যারা ১৯ দফার কথা উদাহরণ দেওয়ায় অতীতের বিষয় বলে মনে করছেন তাদের অতি সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ দেই। মাত্র ৮ জানুয়ারির ঘটনা। বরিশাল জেলা ও মহানগর যুবলীগের  বর্ধিত সভায় কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক স্থানীয় নেতাদের যুবলীগ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে কারও কাছ থেকেই সদুত্তর পাননি। এমনকি যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মনি সম্পর্কেও তাদের তেমন কোনও ধারণা নেই। ওই সভায় উপস্থিত শীর্ষ পদ প্রত্যাশীদের কাছ থেকেও জবাব পাননি কেন্দ্রীয় নেতা।

এই যদি হয় আমাদের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পড়ালেখার অবস্থা, তাহলে সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি আমরা কোথা থেকে আশা করতে পারি। অথচ রাজনৈতিক ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় রাজনীতির অপরিহার্য অংশ হচ্ছে জ্ঞান আহরণ। অন্তত নিকট অতীতের রাজনীতিবিদদের জীবনাচার থেকে আমরা সেই শিক্ষাই পাই। বিশ্ব রাজনীতিতে উজ্জ্বল তারকা হিসেবে চিহ্নিত নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের লব্ধ জ্ঞানকে ব্যবহার করতেন। তারা সেই জন্য পড়াকে অপরিহার্য মনে করতেন।

শুধু তা-ই নয়, তাদের অনেককেই দেখা গেছে রাজনীতিই শুধু নয় দর্শন থেকে শুরু করে সাহিত্য বিভিন্ন বিষয়ে তারা লেখাপড়া করতেন।  

যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর লেখা ‘ডিসকভার অব ইন্ডিয়া: লেটার্স ফ্রম ফাদার টু ডটার’ ভারতীয় জাতীয় নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান প্রমুখের বইয়ের খবর কমবেশি সবাই জানেন।  বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ কিংবা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ দুটি বই একজন রাজনৈতিক নেতার চিন্তার বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। জীবনের দীর্ঘসময় কারাগারের অন্তরালে থেকে শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে লেখাপড়ার চর্চা করতেন, বোধ করি তার রাজনৈতিক সীমানাকে বিশালত্ব দিতে এই অভ্যাসটুকুও অনেক সহযোগিতা করেছে।

আমাদের রাজনৈতিক কর্মীদের কি এই বই পড়ার অভ্যাস আছে? কিংবা তারা জাতির জনকের দর্শন সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন? অথচ মহান এই ব্যক্তি ছিলেন পড়ার মানুষ। নিজে শুধু ‘আমার দেখা নয়াচীন’ লিখেছেন তাই নয়, তার পাঠস্পৃহা সম্পর্কে অনেক বিজ্ঞজনই মন্তব্য করেছেন। তাদের লেখায় উদ্ধৃতি দিয়েছেন।

৩২ নম্বরের পাঠাগারের কথা বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদের স্মৃতিকথায় প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণকারীদের প্রায় সবাই কোনও না কোনোভাবে বঙ্গবন্ধুর পাঠাভ্যাস সম্পর্কে বলেনই। এই মুহূর্তে কয়েকজন স্মৃতিচারণকারীর কথা বলতে পারি। সদ্য প্রয়াত শামসুজ্জামান খান এই নিবন্ধকারকে দেওয়া স্মৃতিচারণে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের একটি বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘তাঁকে সুন্দর আর প্রাণবন্ত লাগছিল। তিনি উঠলেন। ধীরে ধীরে এগোলেন ডান দিকে তাঁর পাঠকক্ষের দিকে। আমরা তাঁকে অনুসরণ করছি সম্মোহিতের মতো। পাঠকক্ষের ভেতরে এসে একটা আলমারির সামনে দাঁড়ালেন এবং অভ্যস্ত হাতে বের করলেন মাও সেতুংয়ের একটা বই। তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন ড. ইসলামের দিকে। মুচকি হাসতে হাসতে বললেন, ‘শুধু রবীন্দ্রনাথ না, আমি নজরুল, সুকান্ত এমনকি মাও সেতুংয়ের রচনাও মনোযোগ দিয়ে পড়ি।’ শামসুজ্জামান খানের সঙ্গী একজন, চীনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার পর বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, ‘মাও একজন নেতা। জীবনে বহু সংগ্রাম করেছেন। তাঁর জীবন ও চিন্তাটা জানা বোঝা দরকার’।

(স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু: সম্পাদক-মোস্তফা হোসেইন। প্রকাশক-আহমদ পাবলিশিং হাউজ)

বঙ্গবন্ধুর পাঠচর্চায় সাহিত্য ও রাজনীতিই শুধু নয়, বিভিন্ন বিষয় থাকতো। তবে তিনি নিজে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত। মুক্তিযুদ্ধকালীন আনন্দবাজার পত্রিকার  প্রতিবেদক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত নিবন্ধকারকে দেওয়া স্মৃতিচারণের একটি অংশ উল্লেখ করা যায়। ‘...বঙ্গবন্ধু এলে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। তিনি বললেন, হ্যাঁ আপনাদের ব্যাপারে শুনেছি। আসুন আমার সঙ্গে আমার লাইব্রেরি রুমে। ঢুকেই বললেন, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আমার রবীন্দ্রনাথকে পুড়িয়ে দিয়েছে। তিনি একটা পোড়া বই উঠিয়ে আমার হাতে দিলেন।

আমরা ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফিরে কলকাতায় যোগাযোগ করলাম। বললাম, কলকাতা থেকে যেন রবীন্দ্র রচনাবলি পাঠানো হয় ঢাকায়। দুদিনের মধ্যে রচনাবলি তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সেখান থেকে রবীন্দ্র রচনাবলি সংগ্রহ করে আমি আর অরূপ ৩২ নম্বর রোডে আবার গেলাম বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু তখন বাড়িতেই ছিলেন। লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই। বইয়ের প্যাকেটটি তাঁর সামনে রাখতেই তিনি বেশ খুশি হলেন। সেই সুবাদে তিনি আমাদের দুপুরের খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন।’ (স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু: সম্পাদক-মোস্তফা হোসেইন। প্রকাশক-আহমদ পাবলিশিং হাউজ)

শুধু তা-ই নয়, তিনি কারাগারে থাকা অবস্থায় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন বই পাঠানোর জন্য। এমনও জানা যায়, বইয়ের অভাব হওয়ায় একই বই  একাধিকবারও পড়েছেন।

লেখাটা আসলে বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়া নিয়ে নয়, রাজনীতিবিদরা যে পাঠ থেকে দূরে থাকতে চাইছেন সেই বিষয়ে। আবারও আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গই আনতে চাই। আওয়ামী লীগের কোনও নেতাকর্মী কি বঙ্গবন্ধুকে না জেনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক হতে পারেন? অবশ্যই না, এমনটা যে কেউই স্বীকার করবেন। এই প্রসঙ্গে আমার মনে আসছে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কথা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বই বিক্রির ইতিহাসে এটি হয়তো বা সর্বাধিক গ্রন্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সংখ্যাটা কত। সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। একটা সাধারণ হিসাব ধরা যাক। ইউনিয়ন, উপজেলা, নগর-মহানগর, জেলা ও কেন্দ্রীয় শাখাগুলোর নির্বাহী কমিটির সদস্যরা যদি একটি করে আত্মজীবনী ক্রয় করে তাহলে বর্তমান বিক্রি অনায়াসে দ্বিগুণ হয়ে যেতো। বাস্তবচিত্র যে অন্যরকম তা সহজেই অনুমান করা যায়।

দলীয় নেতাকর্মীদের লেখাপড়ার বিষয়ে একসময় এই আওয়ামী লীগই কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতো তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ষাটের দশকে ছয় দফা আন্দোলন যখন ছয় ও এগারো দফা আন্দোলনের রূপ লাভ করলো, তখন নিভৃত পল্লিতে থেকে পুস্তিকা পেয়েছিলাম। সত্তরের নির্বাচনের আগে দলীয় পুস্তিকাগুলো কর্মীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল গ্রামে গ্রামে। আমার মনে আছে, কুমিল্লা শহর থেকে পুস্তিকার প্যাকেট ট্রেনে করে আনতেন নয়নপুর কিংবা সালদা নদী রেল স্টেশন পর্যন্ত । তারপর  ৬/৭ মাইল কাঁধে বয়ে নিয়ে যেতেন সেসব পুস্তিকা। বিতরণ করা হতো কর্মীদের মাঝে। যাতে তারা অন্যদের ৬ দফা সম্পর্কে বলতে পারে। এখন সেই অবস্থা নেই। ৬ মাইল হেঁটে গিয়ে কাউকে ট্রেন কিংবা বাসে চড়তে হয় না। ঢাকা থেকে প্যাকেট কোনও গ্রামে পাঠাতে হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার হাতে পৌঁছে যায়। জানি না বাংলাদেশের কোন কোন রাজনৈতিক দল তাদের কর্মীদের রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করার জন্য এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক কর্মীদের শিক্ষিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কর্মীরাও তা গ্রহণ করতো স্বেচ্ছায়।

হ্যাঁ, কেউ বলতেই পারেন এখন কাগজে মুদ্রিত বই পড়ার বিকল্প আছে। প্রশ্ন হচ্ছে সেই বিকল্প পথেও কি পড়ার অভ্যাসটুকু আছে? থাকলেও তাদের সংখ্যা কি উল্লেখ করার মতো? রাজনীতি তো শুধু প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করাই নয়, শুধু রাজপথে মিছিল করার নামই কি রাজনীতি? রাজনীতিকে জেনে যারা রাজনীতিতে নামেন তারাই তর তর করে শীর্ষে যান, যারা পড়েন না, দল ও রাজনীতি সম্পর্কে জানেন কম, তাদের দৌড়ও হয় তেমনি কম। বই-বহির্ভূত রাজনীতিবিদদের এখনই ভেবে দেখা দরকার।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক