একটি লাইভ, ভাইরাল, ডিপ্রেশন এবং আমরা

করভী মিজানএকটা ঘটনা ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আবু মহসিন খান লাইভে সামনে কাফনের কাপড় রেখে পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর। আত্মহত্যা করার আগে দায়ী করেন তার পরিবার, নিঃসঙ্গতা, বারবার প্রতারিত হওয়া, নিজের জীবনে সন্তানদের অনুপস্থিতি ইত্যাদি। সত্যি সারা রাত ঘুমাতে পারিনি এই ঘটনা জানার পর।

এক কথায় ভদ্রলোক সিভিয়ার ডিপ্রেশনে ছিলেন। ঘটনা একটা। কিন্তু আমাদের সবাইকে, সরকার, সমাজকে কী একটা বিরাট প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় না? এর দায়ভার কি আমাদের সবার ওপর বর্তায় না?

কোভিডে ভারতেই বলিউড তারকা-মডেল আত্মহত্যা করেছে বেশ কয়েকজন। ভারত ডিপ্রেশনের তালিকায় বিশ্বে ২ নম্বর স্থানে আছে। কী ভাবছেন? আমরা নেই? বিশ্বে বাংলাদেশ আছে পাঁচ নম্বরে এবং এটা নিয়ে কারও কোনও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না।

ফেসবুক লাইভে এসে সুইসাইড- এটা চিন্তারও বাইরে। মাসখানেক আগে গুলশানে আমার চেনা একজন ফ্যাশন ডিজাইনারের ১৬ বছরের মেয়ে নয়তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তার আগে আমার বান্ধবী একজন সুগৃহিণী লাইভে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। আমার আরও ২ জন বান্ধবী তাদের স্টুডেন্ট কন্যাদের হারিয়েছে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। কারণ একটাই, ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা। এসব তো আমি টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো বলছি। বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। নিজেরাই anti-depressant ওষুধ কতজন খাচ্ছেন তার সংখ্যা ভয়াবহ। ডিপ্রেশনের সঙ্গে ঢুকছে ড্রাগস। কী ভাবছেন? বাচ্চাদের সব দিচ্ছেন। কিন্তু ওদের কোনও ডিপ্রেশন নেই?

রিহ্যাবগুলোতে একটু  খোঁজ নিয়ে আসুন। অন্যদের কথা শুনলে টিটকারি বা কমেন্ট করতে ২ সেকেন্ডও আমাদের লাগে না। খোঁজ নিয়ে দেখুন, হয়তো বা আপনারা স্বামী বা স্ত্রী বা সন্তান বা বাবা-মা’য়েরাই চরম বিষণ্নতায় ভুগছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ডিপ্রেশন জাতি হিসেবে বিশ্বের পঞ্চমতম দেশ বাংলাদেশ। আমরা কয়জন এই কথাটি জানি? এমন একটা নির্মম সত্য?

আমাদের পুরো জাতির ৪% ডিপ্রেশনের শিকার। বিশেষত কোভিডকালে এটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭.৯%, স্ট্রেস ৫৯.৭% এবং এনজাইটি ৩৩.৭%। এবং অ্যাডাল্ট পপুলেশনে এই রেট ভয়াবহভাবে বেশি। এটা ২০২১ সালের প্রতিবেদন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন, ভারত, আমেরিকা, ব্রাজিলের পরেই বাংলাদেশ ডিপ্রেশন জাতি।

আপনার কি মনে হয় দেশের সরকার ব্যাপারটি জানে না? একটি দেশের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব যদি সেই জাতির মানসিক স্বাস্থ্যের এই হাল হয়?

দেশের মানসিক ডাক্তার সংখ্যা

২০০৬ সালের একটা রিপোর্টে দেখলাম, ১৬ কোটি মানুষের জন্য ৭৩ জন সাইক্রিয়াটিস্ট ছিলেন! এখন ২০২২ সাল চলছে, বর্তমানে ঠিক কতজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আছেন সেই তথ্য জানা নেই আমার। কিন্তু ২০০৬ সালেও মাত্র ৭৩ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন? হাসবো না কাঁদবো! বুঝতে পারছি না।

৫০০ বেডের পাবনার মানসিক হাসপাতাল ছাড়া এখন পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগে আর কোনও হাসপাতাল হয়নি। তবে কিছু প্রাইভেট ক্লিনিক আছে। তবে এসবই ‘মাথা খারাপ’দের জন্য। ডিপ্রেশনের জন্য আলাদা করে কিছুই নেই বললে চলে।

ডিপ্রেশন এবং ‘পাগলামি’র তফাৎ

ডিপ্রেশন বা ডিপ্রেসভ ডিজঅর্ডার একটি কমন এবং তার সঙ্গে সিরিয়াস মেন্টাল অসুখ। যা কিনা একজন মানুষকে ধীরে ধীরে নেগেটিভলি গ্রাস করতে থাকে। বিষণ্নতায় আপনার চিন্তা, অনুভূতি বা আপনার কাজ ইফেক্ট করতে থাকে। নিস্তেজ করতে থাকে। ক্রনিক ডিপ্রেশনে আত্মহত্যার প্রবণতা বা বেঁচে থাকার ইচ্ছেও চলে যায়। অথচ এই মনের অসুখ নিরাময়যোগ্য। আমরা আমাদের পরিবারের মানুষকে ‘পাগল’ না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করাই না। আসলে বুঝি-ই না। নিঃসঙ্গতা কতখানি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে সেটা সম্পর্কে আমাদের ভাবনার সময় কই? সবাই ব্যস্ত। নিজেকে নিয়ে। পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ কী জিনিস আবার?

ডিপ্রেশনের প্রধান কারণ

পারিবারিক সূত্রতা, নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব, ড্রাগস, দীর্ঘদিনের অসুস্থতা, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ। ওনারা কেউই কিন্তু ‘পাগল’ নন। প্রায় ৪০ শতাংশ জেনেটিক্যাল। কিন্তু ৬০ শতাংশ পরিস্থিতির শিকার।

শেষে

জীবনযাত্রা বদলাচ্ছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কোভিডের কারণে আরও বেশি। স্ট্রেস লেভেল হাই। এনজাইটি। দুশ্চিন্তা এবং একাকিত্ব। ২ ফেব্রুয়ারি লাইভে আত্মহত্যা যেন চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিয়ে গেছে আমাদের পারিবারিক জীবন এবং সামাজিকতা কতখানি ঠুনকো রূপ ধারণ করেছে। সন্তানরা বিদেশে সেটেলড। টাকা পাঠিয়ে বা মাসে ২-১ বার ফোন করেই দায়িত্ব শেষ। কেউ কেউ তো তাও করে না। যারা দেশে নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। কিটিপার্টি অ্যাটেন্ড করা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাচ্চাদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর চাইতে। বাবা-মায়ের খোঁজ নেওয়া? আমাদের সময় নেই। সবাই দৌড়াচ্ছি। মাঝখান থেকে নিজেদের পরিবারের, সমাজের সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে অজান্তেই। কাউন্সিলরের কাছে যাবো? হায় হায়! বন্ধুরা জানলে কী বলবে? How pretentious we are! কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাচ্চাদের বিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু বিয়ে টেকানোর দায়ভার কোনও পক্ষেরই নেই। আজকাল বিয়ে টিকছেই বা কয়দিন! হ্যাঁ, এসবের সঙ্গেও ডিপ্রেশন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

সুইসাইড রেট বাংলাদেশে বছরে ১০ হাজারেরও বেশি। এখন আরও বেড়েছে। ধনী বা গরিব, ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে এই সংখ্যা বেশি। সত্যি দুঃখজনক। দুঃখজনক পরিস্থিতি!

লেখক: সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব