X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৫০-এ নতুন বছরের বোধোদয়!

করভী মিজান
২২ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:১২আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:১২

প্রতি বছর না আমি ঘটা করে নিউ ইয়ার রিজোলিউশান লিখি। শুধু লিখে ফেলে রাখার জন্য না কিন্তু! বছর শেষে নিজে নিজেই রীতিমতো গবেষণা-হিসাব-নিকেশ করে ফেলি। মাঝে মাঝে তো ১০/১২ সংখ্যাও হয়ে যেত। কিছু শেষ করতে পারতাম। অসম্পূর্ণ কিছু পরের বছরে ঢোকাতাম। কিছু একেবারেই বাদ দিতাম। বা হতো না। হয়নি।

এসব করেছি কারণ জীবনটা শুধু আমারই। জীবনযুদ্ধটাও আমারই একার। সঙ্গী কেউ নেই। একবার পড়লে আমার হাত ধরে টেনে তোলারও কেউ নেই। আমার মতো, আমার বয়সের সিঙ্গেল নারীদের বোঝার ক্ষমতা এই সমাজের নেই। কিছুটা বদলেছে হয়তো আমাদের মতো শিক্ষিত ঢাকাবাসী অল্প কিছু প্রিভিলেইজড নারীর জন্য। তার বেশি কিছু না। আমার বড় ভাই বহু আগে একবার আমাকে বলেছিলেন– ৫ বছরে তুই কি চাস লিখে রাখবি। প্রতি বছর মিলাবি তোর মঞ্জিলের কত কাছে গিয়েছিস।’ খুব কাজে দিয়েছিল কথাটা। খাঁটি কথা ছিল।

এবারও ২০২৩-এ ডায়েরিতে নিউ ইয়ার রিজোলিউশান লিখতে বসলাম। কী আশ্চর্য! ২টার বেশি কিছু লিখতেই পারলাম না। এর মানে এই নয় যে আমার জীবনে আমি সব পেয়ে গেছি। কেউই তার জীবনে সবকিছু পেতে পারে না। সম্ভব নয়। হয়তো বা সেটাই এখন বুঝতে পেরেছি। আমি আসলে বদলে গেছি। ফেসবুকে বছর ধরেও ডিপি বদলানোর তাড়া নেই। যে দাওয়াতে যাবো সেটারই ছবি আপলোডিংয়ে আগ্রহ নেই। ইউটিউবে ভিডিও ব্লগ বানাচ্ছি বেশ অনেক দিন। আবার সেটার ভিউয়ার বাড়ানোরও বুদ্ধি নেই। গ্রামের বাচ্চাদের জন্য কাজ করি। বই পড়া। গ্লাসপেইন্টিং এর পর। অবশ্য সম্প্রতি ফেসবুকে রিল বানাতে বেশ মজা লাগছে।

প্রথম

ডায়েরি পাতার মধ্যে ২০২৩-এ জীবনে প্রথম লিখলাম– স্বাস্থ্য। দুনিয়া এদিক যাক, ওদিক যাক। সুনামি আসুক। বা কোভিড। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হবে আমার। ছোটবেলায় যা পড়েছিলাম– ‘health is wealth’ (স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল)। আর ঢিলেমি না। আলসেমি না। ব্যায়াম। যোগ আসন। সঠিক খাওয়া। পরিমিত খাওয়া। সবই। আগেও করতাম। সবসময়ই করেছি। কিন্তু এবছর থেকে ‘নিবেদিত’ভাবে। কী আছে কপালে জানি না। কিন্তু নিজের দোষে শেষ বয়সে বিছানায় পড়তে চাই না। বাচ্চাদের ঘাড়ে চাপতে চাই না। যতদিন বাঁচবো নিজে হেঁটে-চড়ে কাজ করেই বাঁচতে চাই।

শরীর ও মন

আমাকে প্রচুর মেয়েরা/বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে– এই বল তো, কী করবো, মোটা হয়ে যাচ্ছি। আমিও স্টুপিডের মতো সিরিয়াসলি বলা শুরু করি– হাঁটা মাস্ট। পারলে জিমে যা। ভাত বাদ দে। সবজি-লাল আটার রুটি খা। লেবুর রস। গরম পানি। নো সুগার। এমনই অনেক কিছু। সব শুনে প্রত্যেকেরই একটাই উত্তর– ‘ধ্যাত এত কিছু পারবো না’। আবারও দেখা হবে আবারও একই প্রশ্ন। আবারও একই উত্তর। এখন বুদ্ধিমান হয়েছি। নিজেকে বদলেছি। বলি– ভালোই তো আছিস। ব্যস খুশি হয়ে বিদায় নেয়। আমি বলছি না আমি সবচেয়ে হেলদি লাইফ লিড করি। তবে চেষ্টা সবসময়ই ছিল। প্রতি বছর চেকাপ। এসব বাদ দেই না।

আমার নানাভাই সেই যুগে সবসময় বলতেন– ‘পুরো পেট ভরে খাবি না রে বুঝলি। পেটকে ৩ ভাগে ভাগ করবি। ১ ভাগ খাওয়া। ১ ভাগ পানি। আরেক ভাগ খালি’।

ছোট্টবেলায় কিছু না বুঝলেও মনে আছে কথাগুলো। আর এখন তো দেখি জাপানিদের একটা কথাই আছে– ‘হারাহাচি বু’। মানে ৮০ শতাংশ খাও। বাকিটা খালি রাখো। আর ২০২৩ সালে তো বললামই স্বাস্থ্য প্রথম প্রায়োরিটি।

কিন্তু খারাপ লাগে আমার বয়সের পুরুষ বা নারী নিজের শরীরের প্রতি ভীষণ উদাসীন। আমি বডি শেমিং করছি না প্লিজ। কিন্তু কারণটা বুঝি না। ৯০ শতাংশ অবশ্যই ওভার-ওয়েট। ভুগতেও হয় অনেক। কিন্তু কোনোভাবেই শরীরের যত্ন নিতে নারাজ। আর এখন তো চেনা-জানার মধ্যে ‘stomach staple’ এত বেশি বেড়েছে যে বলার মতো না। আর এটার সাইড ইফেক্ট বয়সের বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক। শর্ট কাটে শরীর কমাবে। কিন্তু শরীরের যত্ন নিয়েন। বাই দ্য ওয়ে– আমরা কিন্তু মেন্টাল হেলথ নিয়েও মিনিমাম চিন্তিত না। বা এটা ঠিক রাখা যে কতখানি জরুরি। সেটা কেউ বোঝে বলেও মনে হয় না। কারণ, এসব বিষয় নিয়ে কাউকে আমি কথা বলতেই শুনি না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্যানিটি ঠিক রাখা একটা যুদ্ধের মতোই। মনের মানুষ বিট্রে করলেও জীবন চলে। কিন্তু শরীর বা মন বসে গেলে সব শেষ!

দ্বিতীয়

দ্বিতীয়টা অটোমেটিক্যালি কি লিখলাম জানেন? একটা শব্দ। ‘শান্তি’! সত্যি বলতে কি আর ভালো লাগে না– বন্ধুদের ড্রামা দেখতে। স্কুলবন্ধুরাও যখন স্থূলকায় ঠাট্টা-রসে মাতে। আগে বুঝলেও চেপে যেতাম। এখন নিজের রেসপেক্টটা জরুরি মনে হয়। জাস্ট বের হয়ে আসি। না। কোনও ঝগড়া না। অভিযোগও না। জাস্ট চলে যাওয়া। বদলে গেছি। গ্রুপ লিভ করি। বুঝে গেছি- আমার চাওয়া নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। হাতের মুঠোয় গুগল থাকার পরও সবার মধ্যে ‘আমিই সব জানি’, ‘আমিই সব দেখেছি’ শুনতে এখন আর ভালো লাগে না। সময় নষ্ট মনে হয়। চলুক ওদের ভ্যানিটি নিয়ে। জিতে যাক। আগে বাগড়া দিতাম। তর্কের ফুলঝুরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করতাম। জিততে হবে। জিততে চাই। এখন বদলে গেছি। জাস্ট সরে আসি। নিজের কাছে নিজের শান্তিটা এখন অনেক বড় প্রায়োরিটি। ফলস আইল্যাশ আর মেকাপ-গেটাপ করে দাওয়াতে যাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছি বহু আগেই। এখন কাজ কমিয়েছি। কিন্তু ‘সময়’-এর দাম বেড়েছে নিজের কাছে অনেক। আগে মানসিকতা ছিল ‘taken for granted’! শুধু কাজ। সব করতে হবে। সব পেতে হবে। এ কারণে জীবনে কম ‘বাঁশ’ও খাইনি। কিন্তু এখন বদলে গেছি। জাস্ট ওই রাস্তা থেকে সরে এসেছি। এখন স্ট্রেস বদলে বরং peace বেড়েছে।

ডিপ্রেশন নয়

মোটেও মনে করবেন না যে আমি ডিপ্রেশনে আছি। ওটা আমার ধনী বিবাহিত বান্ধবীদের জন্যই বরং থাক। যাদের কখনও ইলেকট্রিসিটি বিল পে করতে হয়নি। বিদেশের ট্রিপের টাকা কয়েক মাস ধরে জমাতে হয় না। ইনফ্যাক্ট বাচ্চাদের বিদেশে পড়ালেখার খরচ। বা মাসের বাজারের টাকার কোনও চিন্তাই নেই। ডিপ্রেশনটা মনে হয় ওদের জন্যই। নিজ ফ্ল্যাট বিক্রি করে বাচ্চার পড়ার খরচ জোগানো। গয়না বিক্রি করে ইমার্জেন্সি কাজ পার করে আসা। বা নিজের সেইভিং থেকে হিসাব করে ছেলের রিসেপশন দেওয়া যেসব নারীর জীবন। আমাদের কাছে ‘ডিপ্রেশন’ একটা লাক্সারি শব্দই বটে।

কী চলছে

সবাই জানি জীবনে প্রয়োজন ‘শান্তি’! এসব শো-অফ। ‘winter roof top parties’। ‘Fat elephant wedding’। ‘Facebook কে Fakebook’ বানানো। ঢাকার বাইরে একটা ফার্মহাউজ। সব দাওয়াতে যেতেই হবে। ফটো পোস্ট করতে করতে নিজেকে নার্সিসিস্ট বানিয়ে ফেলা। সিরিয়াসলি! এসব আসলেই কোনও কাজে কি আসে? বোঝেও না। বোধেও আসে না। একসময়ের বিশ্বের বিলিয়নিয়ার মিত্তাল প্যারিসে নিজ কন্যার বিয়ে বিশ্বের ব্যয়বহুল বিয়ের মধ্যে লিস্টে এসেছিলেন। তো না ওই বিয়ে টিকলো, না মিত্তাল বিশ্বে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারলো। কিংফিশারের অবস্থা তো দেখলামই। আম্বানিদের অর্থের অপচয় তো অসুস্থতায় গেছে। এমন উদাহরণ হাজার-হাজার। অথচ টাটা-বিরলাদের আমরা দেখি না। বা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস-এর ফাউন্ডেশন। কিন্তু ঢাকার সো-কলড সমাজ তো ওই অন্য পথেই হাঁটছে। সরি! দৌড়াচ্ছে।

সমাজ টপিক্স

স্বাধীনতার পর থেকেই ঢাকায় বাস। বড় হয়েছি। মিডিয়াতে কাজ করি। কাজেই আরও বেশি মানুষ চিনি। হাই-সোসাইটি তো বটেই। এখানে এখনও কোনও নারীর হাতে মদের গ্লাস বা সিগারেট/ কে আবার হিজাব নিলো/ কার গাড়ির মডেল কি পালটালো/ লুই ভুট্যোন ব্যাগ নয়, জুতা কার পায়ে/ নেটফ্লিক্সে কি এলো/ প্রাইমটা এখন বেটার নাকি/  কোন ক্লাবে ইন্ডিয়ান বেটার কোন আর্টিস্ট এলো/ কার নামে আবার ইউটিউবে কী বের হয়ে গেলো/ কার দাওয়াত কে পেলো/ কার বাচ্চার বিয়ের ডেকোরেশন কতখানি বেটার হলো/ কার বিয়ে কত বছর পর ভাঙলো/ কেন ভাঙলো/ কে বোটক্স ফেইস লিফ্ট করে এলো/ বডি শেপিং stomach staple/ রিচ বন্ধুরা ওমরাহটা শেষ করে নিচ্ছে নাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি ঢাকার হাই সোসাইটির অনেক চিন্তা। অনেক স্ট্রেস! আহা!

ইকিগাই

এখন বলি কম। হাসি বেশি। বদলে গেছি। নতুন ব্যবসা করছি– মাইন্ড ইয়োর ওউন বিজনেস। জাস্ট রিল্যাক্স অ্যান্ড ওয়াচ। চিল। সুপার এনটারটেইনমেন্ট। তাও বিনে পয়সায়। জাপানিদের মধ্যে একটা শব্দ আছে- ইকিগাই।

এখন অনেকেই এটা জানে। এরা কিছু জিনিস প্র্যাকটিস করে। যার জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখি এবং দীর্ঘায়ু জীবন তাদের। ইকিগাই এর সবকিছু প্র্যাকটিস আমাদের পক্ষে সম্ভবই না। যেমন– বিশুদ্ধ পানি/ বাতাস/ খাবার।

কিন্তু অন্যগুলো করতে পারি। কিন্তু কয়জন করে? কারই বা মাথাব্যথা করার। ইকিগাই-এর যে ১০টা স্তম্ভ আছে– যেমন– অবসরে যেও না। কিছু না কিছু সারা জীবন করতে থাকো। তাড়াহুড়ো নয়। পেট ভরে খেও না। ভালো কিছু বন্ধুর সঙ্গে থাকো। তোমার পরের জন্মদিনের জন্য শরীর ঠিক রাখো। হাসো। প্রকৃতির সঙ্গে থাকো। ধন্যবাদ শব্দটা অনেক বেশি বলো। এই মুহূর্তের জন্য বাঁচো। নিজের প্যাশনকে বাঁচিয়ে রাখো। আসল কথা- নিজেকে জানো। যেটা হাজার বছর আগেই সক্রেটিস বলে গিয়েছিলেন। নিজের প্যাশনকে জানা। প্রকৃতির কাছে থাকা। আচ্ছা আপনার ইকিগাই কি?

যত তাড়াতাড়ি যে এটা বুঝবে মনে হয় তাতেই মঙ্গল। তবে শান্তির পেছনে দৌড়ালে কিন্তু আবারও ব্যাক টু স্কয়্যার ওয়ান। যখনই শরীর ঠিক থাকবে, মন ঠিক থাকবে, শান্তি ঠিকই আপনাকে খুঁজে বাসা বানিয়ে নেবে। তবে বদলে নিতে হবে নিজের অনেক কিছুই। ঝেড়ে ফেলতে হবে নিজের ভেতরের অনেক আবর্জনা। ভুল বুঝবেন না। আমার পরম প্রাপ্তি কিছুই ঘটে নাই। নিউ ইয়ার রিজোলিউশান হিসেবে সেই পথে সবে হাঁটতে শুরু করেছি। বা দিক নির্বাচন করেছি। আমার মঞ্জিল এখন যেন জীবনানন্দ দাশের লেখা কিছু শব্দই!

‘আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,

পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।’

লেখক: সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ