X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাটেল উইথ গ্রিফ

করভী মিজান
২৬ এপ্রিল ২০২১, ১১:৫৮আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২১, ১১:৫৮

করভী মিজান আজকে এপ্রিলের ২৬ তারিখ। এ বছর জানুয়ারি ২৬-এ আমার নাতি দাভিয়ার মিজান ওয়েবস্টার মাত্র ২ বছর ২৪ দিন কয়েক ঘণ্টা বয়সে দুপুরে ঘুমের মধ্যে মারা যায়। আজ ৩ মাস। মনে হয় এই তো সেদিন। এখনও যুদ্ধ চলছে আমার শোকের সঙ্গে। যাকে বলে ‘ব্যাটেল উইথ গ্রিফ’। এই মাসে এত সন্তানদের মৃত্যু শুনছি কোভিডের কারণে। আমার শোকও মূহ্যমানতাদের শোকের কাছে। সন্তান হারানো মানে তার সঙ্গে নিজেদের স্বপ্ন, আশা, প্ল্যান, ভবিষ্যৎ সবকিছুরই কবর দেওয়া।

কেন লিখছি
আমি সিঙ্গেল গ্র্যান্ডমাদার। কথায় বলে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। মা’য়ের কাছে সন্তানের কবরে মাটি দেওয়া। আমার আজকের এই লেখাটি ডেডিকেটেড টু অল দোজ প্যারেন্টস এবং গ্র্যান্ড-প্যারেন্টসদের জন্য, যারা তাদের সন্তানদের হারিয়েছেন যে বয়সেরই হোক না কেন। যে কারণেই হোক না কেন। যারা অ্যান্ডলেস গ্রিফের মধ্য দিয়ে এখনও চলেছেন। প্রিয় সন্তান হারানো মানে  “ওয়ান-ওয়ে রোড”। ফিরে যাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। সমস্যা হলো আমরা প্রিয় সন্তানের মৃত্যুর মতো “গ্রিফ” নিয়ে কথা বলি না। অন্যরা সমবেদনা জানাতে এসে কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়ে যাই। দেশে কাউনসেলর কতজন? তাও আবার “গ্রিফ” স্পেশালিস্ট? বাবা-মায়েরাও নিজ সন্তানের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে চান না।

কিন্তু আমি হাতজোড় করে বলছি, আমি কারও সমবেদনা চাই না বা নিজের শোকগাথাও লিখতে বসি নাই। লেখক বলেই হয়তো- এই পথের যারা পথিক তাদের সঙ্গে আমার “ব্যাটলউইথ গ্রিফ” শেয়ার করতে চাচ্ছি। আমার শক/ ডিনায়েল স্টেজ/ ক্ষোভ/ গিলটি ফিলিংস/ পাগলামি। সবশেষে একসেপ্ট করে নেওয়া মহা সত্যকে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের সঙ্গে সমঝোতা। শান্তি খুঁজে নেওয়া।
আমার এই লেখায় সন্তানহারা কেউ একজনও যদি ন্যূনতম উপকার পায়, সেটাই আমার পরম পাওয়া।
 
বালি জানুয়ারি ১, ২০২০
একটা কথা আছে- নেভার টেক থিংস ফর গ্র্যান্টেড। বাট আই টুক ইট। হোয়াট এ ইয়ার স্টার্টিং! গত বছরের কথা বলছি। ২০২০ নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন ইন বালি। আমার ২ মেয়ে আমেরিকা থেকে যোগ দিলো। ওরা দু’জনেই জন্মগত আমেরিকান। জানুয়ারির ১ তারিখ বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে আমার ছোট মেয়ে লাগেজ ঠেলতে ঠেলতে পিঠে বাঁধা একটা ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে যখন বের হলো দেনপাসার, বালি এয়ারপোর্ট থেকে। আমি হাঁ করে চেয়ে আছি। ‘ও মাই গড ইটস মাই ওনলি গ্র্যান্ডসান!’ ওকে কোলে নিলাম। তুলতুলে নরম ছোট্ট একটা মানুষ। এত লম্বা জার্নিতেও মিনিমাম সে বিরক্ত না। এই তো সেদিনই। মনে হয় যেন মাত্র গতকাল। মাত্র হাঁটতে শিখেছে তখন। টলে টলে পড়ে যায়। এরপর রাতে ল্যান্ড করলো বড় মেয়ে। পরদিন জানুয়ারি ২-এ ওর ১ বছরের জন্মদিনে আমরা চলে গেলাম উবুদে। সব প্ল্যান করে রেখেছিল বড় মেয়ে। চীনের করোনার খবর অল্প অল্প আসছে। কিন্তু আমাদের ৪ জনের মানে আমি মা ও ২ কন্যা এবং নাতির ফুর্তি দেখে কে? আমেরিকার ঠান্ডা বন্ধ রুমের থেকে বের হয়ে সব নতুন কিছু দেখে খিলখিল তার হাসি। প্রতিটা দিন আর ক্ষণের কথা এখনও বলে দিতে পারি। এরপর সিটের ঝামেলায় আমার ছোট মেয়ে আর দাভি ঢাকায় আগে এলো। তারপর আমি। বড় মেয়ে বালি থেকেই চলে গেলো ওর ইউনিভার্সিটি ইউপেন। ফিলাডেলফিয়া।
 
সাউথ ক্যারোলাইনা, জানুয়ারি ২, ২০১৯ সকাল সাড়ে আটটার সময় “স্পার্টানর্বাগরেজিওনাল হসপিটাল”-এ মেয়ের লেবার চলছে। আমার ৩ বাচ্চাই সিজারিয়ান। এ এক আমার নতুন অভিজ্ঞতা! সিনেমায় কি দেখি আর আমার মেয়েকে একটা চিৎকার বা দাপাদাপি না করে ডাক্তার আর নার্সের কথা মতো ‘পুশ’ করে করে বের হয়ে এলো প্রথমে মাথাভর্তি চুল তারপর সেকেন্ডের মধ্যে পুরো শরীর। বাপ ব্ল্যাক-আমেরিকান। বাচ্চার চুল একদম সোজা। বারাক ওবামার মা ও তার নানি বাড়ি পরিবারের ২০০ বছরের ইতিহাস সাদা রেইস, ওয়েলস। তারপরও কেউ বলবে ওর চুল সোজা? বা রঙ সাদা? আমার নাতি জন্মালো বাঙালি গায়ের রঙ আর সোজা সিল্কি চুল নিয়ে। চোখ চাইনিজ ধাঁচের আর ওজন মাত্র ৩ কেজিরও কম। অবশ্যই জেনিটিক্যালি ঝামেলা ছিল। ডাক্তার বললো কোনও ব্যাপার না। লুকিয়ে আমি কিন্তু ওর হাত-পা’য়ের আঙুল গুনে ফেললাম। এটা মনে হয় সবাই করে। ইন্সটিংক্ট। প্রথম দেখা আর প্রথম কোলে নেওয়ার অনুভূতি কেউই বোঝাতে পারবে না। অঝোর ধারায় শুধু কাঁদলাম। আনন্দে!
 

২০২০
অনেকেই বলে ‘বিশে বিষ’। পুরো পৃথিবীতে করোনা ছেয়ে গেছে। ইতালি মৃত্যুপুরী। ঢাকায় সাধারণ ছুটি মার্চ থেকে। তাতে কী! স্বার্থপরের মতো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সাল ২০২০। মার্চের ২০ তারিখ থেকে আমি ঘরবন্দি। কোথাও যাই নাই। কারণ, আনন্দ যে ঘরে। বন্ধুরা বলে, কী হয় একটু বাইরে গেলে। আমি বলি, না। মাঝে মধ্যে কিছু বন্ধু এসেছে প্রিকশন নিয়েই। আড্ডার মধ্যমণি কিন্তু আমার নাতিই। সবাইকে চিনে গিয়েছিল। ভীষণ খুশি হতো ওদের দেখলে। জুনে গরম পানিতে আমার পা পুড়ে যায়। তিন দিন হাসপাতাল থেকে আসার পর আমাকে দেখে তার আনন্দ যেন সীমাহীন। ব্যান্ডেজ বাঁধা পা আমার, তবু নানুর কোলে থাকা চাই। আমার মেয়ে বললো- আম্মু এই কয়দিন দাভি প্রতিদিন তোমার রুমের দরজার সামনে দাঁড়ায় থাকতো। ও কথা বলতো কম। কিছু শব্দ হয়তো। যার জন্য অপেক্ষায় থাকতো দাঁড়িয়ে। বলতে পারতো না। এরপর  অক্টোবর থেকে ঢাকা শহরে যে  হারে পার্টি শুরু হলো। আমি টোট্যালি “নো”। দাভিকে কোলে জড়িয়ে দিন কাটতো।  মার্চের আগে ওর মা ব্র্যাকেও ১ সেমিস্টার শেষ করে ফেললো। সেই সুযোগে আমাদের নানু-নাতি বন্ডিং যুতসই হতে লাগলো।
ওর মা বাইরে যেতো গ্রসারিতে। দাভির ২ বছর জন্মদিনের পরেও প্রতিবার ওকে ঘুম পাড়ানোর আগে ব্রেস্ট ফিডিং করতো আমার মেয়ে। আমি ভাবতাম ওই বয়সে এত অ্যামেজিং মা তো আমিও ছিলাম না। আমাদের সময় বাচ্চার জন্য দুটো করে আয়া প্লাস নানি-দাদিরা তো থাকতোই। কিন্তু এই কোভিডে সম্পূর্ণ আয়া বিবর্জিত আমার দাভি বড় হতে লাগলো তার মা আর নানির সঙ্গে। আমার মেয়ে রাগ করতো- আম্মু তুমি ওকে স্পয়েল করছো। আমি বলতাম- এটাই আমার কাজ। এরপর ওর গার্লফ্রেন্ডগুলোকে জ্বালাবো! স্বপ্নে বিভোর হতাম নাতিকে নিয়ে। ওকে কোলে নিয়ে আমার জন্মদিনের কেক কাটলাম। জুনে আমার মেয়ে তার কেক কাটলো। দাভি তার মামা’র বিয়ে খেলো ডিসেম্বরে। বাসায় আমি আমার মেয়ে আর নাতি মিলে নিজেদের অদ্ভুত এক আনন্দময় জীবন শুরু করেছিলাম। আমার বহু বছরের একা জীবনের শূন্যতা কোনায় কোনায় ভরিয়ে দিলো। আগে জানতামই না আমার জীবন যে এত একাকীময় ছিল। সত্যিকারের ভালোবাসা কি- নাতির কাছ থেকে শিখলাম। ওর মেন্যু ঠিক করো, খাবার বানাও। ডাল-ভাত চটকে লংকায় লংকায় দাভি খেতো। প্রতিদিন তার ভাত চাই-ই চাই। কৌশলে মা’র থেকে ওর গোসল করানোটাও নিয়ে নিলাম। অনলাইনে চলতো ওর শপিং। গাড়ির পাগল ছিল। যেকোনও সাইজের। টিভিতে তার প্রিয় কার্টুনগুলো চললেই সে দাঁড়ায় দাঁড়ায় আগেই অ্যাক্টিভিটিসগুলো করতে থাকতো তালে তালে। ভালোবাসতো আমার সঙ্গে সাইকেল চালাতে। আমাদের দু’জনের প্রতিদিন কয়েকবার লুকোচুরি খেলা ছিল মাস্ট। বারবার আমিই লুকাবো। সে খুঁজে বের করবে। তারপর কি খিলখিল হাসি। মারা যাওয়ার আগের দিন টিভির কার্টুন দেখতে দেখতে পরিষ্কার বললো “স্কাই”। আমার জান, সোনা বাচ্চা, বেঙু, গুল্লু বাচ্চা ছিল। ওকে ডাকতাম “এই যে আমার হানড্রেড ইয়ারস ওল্ড বুড়া”!
 
ফেব্রুয়ারি ২০২১
দাভির কবর দেওয়ার পর বুকে ক্রনিক পেইন নিয়ে পরদিনই আমি হাসপাতালে ২ দিন কাটিয়ে এসেছি। ডাক্তাররা বললেন এটা ট্রমা শক। এতদিন আমার মেয়ে আমার ছেলের বাসায়। প্রথমেই মনে হলো ওকে আনতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো সবচেয়ে প্রথম কাজ ওর রুমের ইনটিরিওর পাল্টানো। খালি রুম ও সহ্য করতে পারবে না। দুপুরের মধ্যে ওর খাট বদলালাম। বাইরের বড় সোফাসেট ওর রুমে বসালাম। আমার রুমের বেডসাইড টেবিল দিলাম। দু’দিনের মধ্যে সনি ব্র্যাভিয়া ওয়ালে দিয়ে দিলাম। আমার ছেলের বন্ধু তার পিএস ফোরটা দিয়ে গেলো। আলাদা ওয়াইফাইও এসে গেলো। এর মাঝে আমার ছেলের কথায় বাসায় মিলাদ পড়িয়েছি। আর যারা এই কয়দিন দিন-রাত আমাদের সাহায্য করেছে তাদের বলেছিলাম আসতে। সবাইকে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম আমি- “প্লিজ কেউ সাদা কাপড় পরে এসো না। আর আমার মেয়ের জন্য পারলে গিফট নিয়ে এসো”।

ও বাসায় আসার পর থেকে পুরো ১ মাস প্রতি রাতে পালা করে আমার মেয়ের বন্ধুরা ওর রুমে মাটিতে ঘুমিয়েছে। আবার সকালে আরেক গ্রুপ থেকেছে। না। আমার সঙ্গে আমার মেয়ের মাত্র দুই একটা কথা হতো। মনে হতো সহ্যই করতে পারতো না আমাকে প্রায়। একদিনও একে চিৎকার করে কাঁদতে দেখলাম না। ও অ্যাপিটাইট হারালো। রুম থেকে বেরই হতো না। ওকে আমার ছেলে প্রথম সপ্তাহ থেকেই কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ঘণ্টায় ১০ হাজার টাকা ফি। অথচ আমার কোনও ফোন বা মেসেজের রিপ্লাই দিতে ভদ্রলোকের সময় হয়নি। ওই সময়টা আমার ছেলে আর ছেলের বউ ওকে সামলেছে। আর আমি? দিনে অদ্ভুত সব কাজ করা শুরু করলাম। স্টোর রুম থেকে আন-প্যাক কার্টন বের করে বাসা সাজিয়েছি। সব আলমারি গুছিয়েছি। শাড়ি বের করে প্রিয় মানুষদের বাসায় বাসায় পাঠিয়েছি। পুরো মাস ধরে প্রতিদিন বন্ধুরা আসতো। কেউ রান্না করে। কেউ বা ফুল। কেউ গিফট। এমন সব মানুষরা এসেছে আমি ভাবিই নাই ওরা আমাকে নিয়ে ভাবে। আবার খুব কাছের মানুষ স্কুলফ্রেন্ডস বা অন্যদের যাদের আশা করেছিলাম তারা আসেইনি। রাত বাড়তে থাকে। আমি ৮ এমজি রিভোট্রিল বা ৯ এমজি টেনিল খেয়েও সারা রাত জাগি। অন্ধকারে রুমে রুমে ঘুরি আমার নাতির হাসির শব্দ শোনা যায় কিনা শুনতে। আমার ব্রেইন আর অ্যাপিটাইট কমিউনিকেশন করা বন্ধ করে দিলো। এক মাসে আমার ওয়েট কমলো ৬ কেজি।

প্রতিদিন কবরে যাচ্ছি। কান্নায় ভেঙে পড়ছি। বাসায় আসছি। ওর খেলনা, ওর সাইকেলগুলো দেখছি। এ সময় আমার সিনিয়র এবং জুনিয়র বন্ধুরা যদি এমনভাবে সময় না দিতো, নির্ঘাত পাগল হতাম। আমার এক সিনিয়র আপা সেই মরচুয়ারিতে রুমে দাভির পাশে বসে কোরআন শরিফ পড়েছে। ওই আপাই পরদিন গোলাপ নিয়ে এসেছিল দাভির কবরে দেওয়ার জন্য। পুরো সময় ধরে আমাকে কাছের বন্ধুরা  
কঠিন হাতে আগলে রেখেছে। কাছের-দূরের সব বন্ধুরাই। আমার বন্ধুভাগ্য নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়।
 
ভিসেরা রিপোর্ট
ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখে ভিসেরা রিপোর্ট পেলাম। ডেথ অব কজ ন্যাচারাল। ঘুমের মধ্যে মৃত্যু। আমার কয়েকজন ডাক্তার বন্ধুরা বললো- দিস ইজ এ একুয়েট কেস অব এস ইউ ডি সি (SUDC- sudden unexplained death in childhood)। পাগলের মতো google আর YouTube দেখে দেখে কেস স্টাডি করেছি। সুস্থ বাচ্চাকে ঘুম থেকে ওঠাতে গিয়ে দেখে শরীর ঠান্ডা বরফ। বলা হয়েছে- ..... অ্যাজ কোল্ড অ্যাজ আইস। সঙ্গে সঙ্গে দাভিকে ধরার ওই অনুভূতি মাথা থেকে সরাতে পারি না। এই অ্যাটাকের টার্গেট ২ থেকে ৪ বছর শিশুরা বা কিছু বেশি বয়স। First born এবং mixed-race. আরে দাভি দু’টোই। কেন এই কথা কখনও আমার মাথায় আসেনি। একে বলে- immature heart failure or loss of breathing during sleep. বছরে ৩৫ হাজারেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয় এই কারণে। লাখে ১.১৪ পার্সেন্ট বাচ্চা মারা যায় এই কারণে। তবে এশিয়ায় খুবই কম। অনেক SUDC Foundation তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
শুধু গিলটিতে ভুগেছি- কেন আমি দিলাম ওকে ঘুমাতে। আমার মেয়ে তো আমাকেই বিশ্বাস করে বাচ্চা রেখে গিয়েছিল। একদিন আমার মেয়ে আমাকে বললো- তুমি তো মানা করেছিলে ঘুম পাড়াতে। কেন তোমার কথা শুনলাম না। এটা একটা গিল্ট ট্র্যাপ। এতে পা দিলেই শেষ। “হোয়াট ইফ”-এর উত্তর নেই। পৃথিবীতে তাহলে কোনও অ্যাকসিডেন্ট হতো না বা কেউ মারা যেতো না।
 
ফুলের পাপড়িতে পোকা
দাভি চলে যাওয়ার কিছু দিন পর ইনবক্সে একজন লিখলো- আপা কবরে এত ফুল দিয়েন না। পোকা হয়। কোনও উত্তর দেইনি। আজ বলছি- তুমি তো ফুলের পাপড়ির পোকা নিয়ে চিন্তিত। কখনও কি ভেবেছো বা ভাবার সাহস আছে যে- ওই ফুলের নিচে মাটি। তার মাঝে আমার নরম শরীরের ছোট্ট নাতি শুয়ে। প্রতিদিন সারাক্ষণ কত পোকা ওর শরীরটাকে খেয়ে যাচ্ছে? ভেবেছো কখনও কি? আমি ভাবি। প্রতিদিন ভাবি। এই কষ্ট যে কি কষ্ট সন্তান যারা হারিয়েছে তারাই শুধু বুঝবে। আরেক সিনিয়র ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে বললো- তোমার স্ট্যাটাস দেখে সবাই জানো  ক্রিটিসাইজ করে। তোমার বন্ধুরাই করে। আমি অবাক হয়ে কথাটা শুনলাম। আচ্ছা- ফেসবুক কি শুধু ভালোবাসা-প্রেম বা পার্টি বা সব ভালো কিছুর? ফেসবুক এক ধরনের আউটলেট। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে, শিশুটিকে সদ্য হারিয়েছি। সেই লেখা পড়েও কোনও বিবেক ক্রিটিসাইজ করতে পারে? এত নির্মম কীভাবে হতে পারো? আমার তো মাথারই ঠিক নাই তখন। আর হ্যাঁ, ভালো না লাগলে ফেসবুকে অনেক অপশন আছে ব্লকিং ছাড়াই অফ করার। চোখের সামনে নিজের নাতিকে কবরে যেতে দেখেছি। পাশে শোকে পাগলের মতো আমার ছোট মেয়ে, বাচ্চার মা। বড় ছেলে খাটিয়া কাঁধে নিয়ে তার নতুন ভালোবাসার ভাগ্নেকে কোলে করে কবরে শুইয়েছে। আমি শুধু দেখছি। নিজের নাতি কবরে। ছেলের মাটিতে বসে চিৎকার করে কান্না। আমার মেয়ে সন্তানহারা পাগলের মতো। সব দেখছি। বড় মেয়ে আমেরিকা থেকে আসতেও পারলো না। কি কান্না! আর তোমাদের কাছে আমার ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে ক্রিটিসিজম? আমার জুতায় তোমাদের পা রাখো না একটু! তারপর জীবনটা দেখো? তোমাদেরও তো সন্তান আছে। তাই না?
 
মার্চ ২০২১
আশ্চর্য ! দাভি নাই ৪০ দিন হয়ে গেলো? সত্যি ও নাই। সত্য স্বীকার করতে পারি না। পারি না মেনে নিতে। চোখের পানি যে এত হতচ্ছাড়া হতে পারে জানা ছিল না। ওই দিনে আমার জানের টুকরো দাভির কবরের সামনেই ৫ জন হাফেজ কোরআন খতম দিলেন। শুক্রবার জুমার পর আমার আব্বু আর দাভির জন্য ইমাম সাহেব দোয়া ধরেছিলেন। এটা পুরোটাই আমার সিনিয়র বন্ধুপত্নি আর্কিটেক্ট ও শিল্পী তার সাহায্যে ও উপদেশে হয়েছিল। রাতে বাসায় প্রায় শ’খানেক মেহমান। সবাই চলে গেছে। শুধু খুব ক্লোজ কয়েকজন বন্ধু উঠি উঠি করছে। রাত বাজে প্রায় ১টা। কি কথায় কথায় হঠাৎ আমার মেয়ের আউটবার্স্ট হলো। চিৎকার আর কান্না আর রাগ। “দাভি তোমাদের কি হয়? ও আমার পেটের বাচ্চা! কই আম্মু তোমার তো সব বাচ্চা আছে। আমার বাচ্চা কেন নাই?” আমার বন্ধুরা ওকে বোঝাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আমার মেয়ে পাগলের মতো কাদঁছে আর একই কথা বারবার বলে যাচ্ছে। আমি একেবারে চুপ। আর মনে মনে বলছি- আলহামদুল্লিলাহ!  এ ঘটনার কিছু পরে এক বন্ধু বললো- তোমার ধৈর্য। তুমি চুপ করে থাকলে কেমনে। তখন আমি বললাম- “এই প্রথম আমার মেয়ের ভেতরের ক্ষোভ কান্না চিৎকার শুনলাম। ডিনাইল থেকে রিয়ালাইজেশনে আসছে। কেন ওকে থামাবো? সন্তান হারানোর কষ্ট এই প্রথম সবার সামনে প্রকাশ করলো। এখন ও বদলাবে। দেখো তোমরা।”

আশ্চর্য! এরপর থেকে আমার মেয়ে বদলাতে লাগলো। খাবারে রুচি এলো। আমার সঙ্গে গল্প করে। বাইরে যাওয়া শুরু করলো। মেয়েকে হাতে-পায়ে ধরে ইমোশনাল সব অস্ত্র ব্যবহার করে রাজি করালাম। হ্যাঁ, ও যাবে আমার বন্ধুর রিসোর্টে ঢাকার কাছে ৩ দিনের জন্য। সঙ্গে বন্ধু। দেখলাম প্রায় ৭ দিনের প্যাকিং করে সে রওনা দিলো। সারাক্ষণ ছবি পাঠাচ্ছে। ঘুমাচ্ছে। বন্ধুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাচ্ছে। চাইনিজ/ কন্টিনেন্টাল যা যা পেয়েছে। বাট ওই ভাত মুখে দেয় নাই। ও যখন ফিরে এলো এক নতুন মানুষ। হাসি-খুশি।

মার্চের ২৮ তারিখে বন্ধুদের নিয়ে আমাকে চমকে দিয়ে বার্থডে সারপ্রাইজ দিলো। নিজের হাতে কার্ড বানালো আমার আর দাভির ছবি দিয়ে। এত সুন্দর কয়েকটা প্রমিজ করলো নোটস লিখে। এবার আমার কাঁদবার পালা। মার্চের ৩০ তারিখ ছিল শবে বরাতের রাত। কবরস্থানে গেছি রাতে। কি অপূর্ব দৃশ্য! কানে কোরআনের আয়াতের সুর। অবশেষে আমি নিজে থেকে বললাম- ফ্লাই দাভি ফ্লাই। ফ্লাই টু হেভেন। আমি আর আটকাবো না তোমাকে। মেনে নিচ্ছি আমি আমার অদৃষ্টের লিখন। আই একসেপ্ট!
 
এপ্রিল ২৬, ২০২১
আজ ৩ মাস আমার বাসায় ভাত রান্না হয় না। কারণ, আমার মেয়ে এখনও তার ছেলের প্রিয় খাবার খেতে পারে না। আর আমিই বা কেমনে খাবো? এমনকি নিজের ছেলের প্রিয় কোনো ফল বা অন্য খাবারও না। আমার মেয়ে আমার বন্ধুর অ্যাড এজেন্সিতে কপিরাইটার হিসাবে ইন্টার্ন করছে। এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরে। ভালো করেই বুঝি ও ভালো নেই। তারপরেও চেষ্টা করছে। আমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করছে। কম বয়সেই জীবনের একটা বড় অংশ হারিয়েছে। আমার আগের মেয়ে বদলে গেছে একদম। বললো- আমেরিকায় ফিরে যাবে না ওর ছেলেকে এই মাটির বুকে রেখে। বুঝি ওর কষ্টগুলো। এটাও বুঝি ওর বয়স কম। ইউনিভার্সিটি শুরু করবে। জীবনে অনেক দূর যাবে।

আর আমি? যেমন এই লেখাটি লিখতে গিয়েই চোখের পানি টপটপ করে পড়েছে। লেখা বন্ধ করেছি। আবার দু’দিন পরে লিখেছি। এই লকডাউনে একদম একা। গত বছরের লকডাউনের কথা ভাবি। আমাকে অনেকেই, বেশিরভাগ বন্ধুরাই বলেছে- “রিভি জাস্ট লিভ। কোথাও থেকে ঘুরে আয় মেয়েকে নিয়ে।” কিন্তু আমি বাসা ছাড়বো চিন্তাই করতে পারি না। সব বই-এও কিন্তু লেখা ট্রমার পর “চেঞ্জ প্লেস”।বন্ধুরাও ঠিক ছিল। কিন্তু ৫৫ আর ২৩ বছরের শোকের রিলিফ ভিন্ন। আমি পারি নাই বাসারমেমোরিজ ছেড়ে যেতে। বহু বছরের ইয়োগা আর মেডিটেশনের কারণে এটা আমি জানতাম- শান্তি আমাকে নিজের মধ্যেই আবিষ্কার করতে হবে।একা থাকি। মনের জোর হয়তো একটু বেশিই। নামাজ শুরু করেছি নাতির জন্য। রোজা করছি। শান্তি পাচ্ছি। ডেইলি আবার হাঁটা শুরু করেছি ছাদে। আবারও বই পড়ছি। এখন টিভি দেখি। আবার লিখবো ভাবছি। আমার YouTube চ্যানেল আবার চলছে। বের হতে এখনও ভালো লাগে না। আর এখন তো প্রশ্নই আসে না লকডাউন। জীবনটা যেন শূন্যের ওপর ভাসছে।
 
শোকের স্তর
বিশ্বাস করবেন শোকেরও স্তর আছে। প্রথম ধাক্কাতেই মনে হবে- এটা সত্য না। যাকে বলে ডিনাইল। আমিও গেছি এর মধ্য দিয়ে। মনে হয়েছে সব নাটক। সব মিথ্যা। আমার নাতি ফিরে আসবে। হয়তো বাইরে গেছে। এমন চলেছে অনেক দিন। তারপর পরই আসে প্রচণ্ড ক্ষোভ। রাগ। হোয়াই মি? আমার প্রিয় সন্তানটিরই কেন চলে যেতে হলো। কে দেবে উত্তর? কারণ, এর কোনও উত্তরই নাই। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। “হয়তো বা” এটা করলে বাচ্চাটি বেচেঁ যেতো। “হয়তো বা” ওটা করলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না। প্লিজ প্লিজ এই ট্র্যাপে বা ফাঁদে পড়বেন না। আমিও পড়েছিলাম। মেনে নিতেই হবে আপনার করার কিছুই ছিল না। মৃত্যুর ডাক আমরা কেউই রুখতে পারবো না। মানুষ বলে- নিজের জীবন সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু বিশ্বাস করেন আমাকে হাফ সেকেন্ডের জন্যও যদি অপশন দেওয়া হতো, আজরাইলকে আমি দৌড়ে গিয়ে বলতাম, আমার নাতির না। আমার জীবন কবজ করো খুশি মনে। কারণহীন অনুতাপ, প্রায়শ্চিত্যসহ বহু কিছুই মনে ঘুরপাক খেতে থাকবে। নিজেকে দোষারোপ। স্ট্রেস, পেইন আর এনজাইটির কথা তো বাদই দিলাম।
 
সত্যকে স্বীকার
যতই উপদেশ দেই এমন একটা দিন পার করতে পারি না চোখের পানি ছাড়া। তবে একটা কথা বলি- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহাসত্যকে স্বীকার করে নিন। প্রিয়জনের মৃত্যু বা সন্তানের মৃত্যু- দিজ ইজ ফেইট। যত তাড়াতাড়ি এটা স্বীকার করতে পারবেন ততই বেটার। যত খুশি কাঁদুন। যা মনে চায় করুন। তবে anti-depressant ওষুধে ঝুঁকতে যাবেন না। কে কি বললো- সেটাও শুনতে যাবেন না। আমাদের দেশে- না কোনও পত্রিকায় বা টিভি চ্যানেলে স্পেশিফেক্যালি এই বিষয় নিয়ে কথা বলে বা কোনও অনুষ্ঠান হয়। হাউ টু ব্যাটেল উইথ গ্রিফ। প্রচুরজনকে চিনি যারা শয্যা নিয়ে নেয় সন্তান হারানোর ব্যথায়। বা চলে যায় ডিপ্রেশনের অতল গভীরে। আবার অনেক বন্ধুদের দেখেছি- সন্তান হারিয়েও জীবন সংগ্রামে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে। অসহনীয় কষ্ট নিয়েও মুখে হাসি থাকতে।

আমি বলছি, সত্যর সামনাসামনি করুন। একসেপ্ট করুন। জন্ম-মৃত্যু কারও হাতে নাই। আমরা চাইলেও কিছুই বদলাতে পারতাম না। এটাই জীবন। গড’স প্ল্যান। আমরা ভাবি। স্বপ্ন দেখি। আর হয় অন্য কিছু। কথায় বলে না- মেন প্রপোজেস গড’স ডিসপোজেস। এটাই মহা সত্য। সন্তান হারানোর কষ্ট সারা জীবন বইতে হবে সত্যি।  YouTube-এর একটি চ্যানেল আছে- “in loving memories of”! দেখার চেষ্টা করবেন একবার হলেও। আমি দেখেছি। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর জীবনের শেষ গল্পগুলো। কারও হয়তো ব্রেন টিউমার, কারও বা ক্যানসার, কারও দুরারোগ্য মরণ ব্যাধি, কেউ বা অ্যাকসিডেন্টে। বাবা-মা’র সামনে ধুঁকে ধুঁকে বাচ্চাগুলো মারা গেছে। কিছু করার নাই। ডাক্তাররা অসহায়। এদের কষ্টের কাছে দেখবেন আপনার/ আমার কষ্ট হয়তো কিছুই না। কাঁদতে কাঁদতে বলেছি, আল্লাহ মেহেরবান, আমার নাতিকে শান্তির মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছো। ওর হায়াত যে অতটুকুই ছিল। এখন তো ঢাকাতেই কত ঘটনা শুনছি যুবক সন্তান কোভিডে চলে যাচ্ছে। বাবা-মা মৃত সন্তানের শেষ গোসলও ঠিকমতো করাতে পারছেন না। কাজেই সন্তান হারানোর শোকে শুধু আমি বা আপনি একলা নই। এই পথের পথিক আমরা অনেকে। নিজেকে একা ভাববেন না এই শোকের সাগরে।
 
ভালো লাগে না কিছু
কিছু ভালো লাগার কথাও না। একটু ভাবুন তো, আপনার সন্তান হারানোর কোনও কারণ যদি খোদা রেখে থাকেন। তবে আপনাকে বাঁচিয়ে রাখারও কারণ আছে নিশ্চয়? কাজেই নিজের জীবনকে ‘না’ কেন বলবেন? সুতরাং যা মনে চায় তাই করুন না। লকডাউন শেষ হলে ঘুরে আসুন। বারান্দায় বা ছাদে বাগান করুন। আরও বেশি দান করুন। আরও বেশি মানুষের সঙ্গে মিশুন। ইগো বাদ দিয়ে বন্ধুদের বাসায় আসতে বলবেন। বেহায়ার মতো আমি বলেছি। তা না হলে বাচঁবো কেমনে? বাইরে বেড়াতে যান। বাকেট লিস্ট বানান। আপনার সন্তানের জিনিস দেখলে যদি কষ্ট লাগে তা কার্টন বাক্সে তুলে রাখুন। আপনার ইচ্ছে। আমি যেমন আমার নাতির খেলনা/ জিনিস যা যেমন ছিল তেমনই রেখেছি। কারণ আমার ভালো লাগা। ভালোবাসা। কমিউনিটি সার্ভিস করুন। ওর জন্মদিনে কোরআন খতম দিন। গরিবদের খাওয়ান। গরিবদের সাহায্য করুন। ওর বন্ধুদের ডেকে বাসায় ওর জন্মদিনের কেক কাটুন। ওর বন্ধুদের খোঁজ রাখুন। ওরাও কিন্তু ভালো নেই। আপনার মনে যা শান্তি আনতে পারবে তাই করা শুরু করুন। ভেবে দেখুন- আজ আপনার সন্তান বেঁচে থাকলে বাবা-মা’কে কেমন দেখতে চাইতো। ঠিক তেমন থাকুন। দাভি কখনও আমাকে কাঁদতে দেখেনি। ভীষণ চেষ্টা করি না কাঁদবার। হয়তো একসময় ওর ছবি দেখে গর্বের সঙ্গে হেসে কথা বলতে পারবো। পারতে আমাকে হবেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার নিজের সঙ্গে “সমঝোতা” করা। শান্তি খুঁজে নিন। বহুদিন পর আমি নামাজ শুরু করেছি। শান্তি পাই। টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার। নিজেকে সময় দিন। আপনার অন্য বাচ্চারা তো দোষ করেনি। তাদের জন্য বাঁচুন। ওর স্মৃতি নিয়ে বাঁচুন। ভালোভাবে বাঁচুন। মানুষের জন্য বাঁচুন।
 
অন্যদের বলছি
কারো পক্ষেই সদ্য সন্তানহারা মানুষের কষ্ট বোঝা সম্ভব না। প্লিজ দোহাই লাগে শোকতপ্ত একজন মানুষকে ক্রিটিসাইজ করবেন না। কিংবা এ ধরনের কথাই বা কেন বলবেন? কোনও লজিক তখন কাজ করে কি? বরং তার পাশে দাঁড়াবেন। অনেককে বলতে শুনেছি- রিভি আপার সামনে গিয়ে কি বলবো! ওরা আসেনি। নিজ বাড়িতে কেঁদেছে। অথচ হয়তো ওরা জানেই না আমি আশা করেছিলাম ওরা কবে আসবে। একজন শোকাহত মানুষের পাশে দাঁড়ানো যে কত বড় ব্যাপার। বোঝানো সম্ভব না। কিছুই বলতে হবে না। বা করতে হবে না। জাস্ট বি দেয়ার। কিছুদিন পর যান। তবু যাবেন। ফোন ধরছে না? ধরার কথা না। মেসেজ করবেন। বারবার। একদিন পড়বেই। রান্না করা খাবার পাঠাবেন। আচমকা সাথে নিয়েও যাবেন। মনে রাখবেন বন্ধু বা পরিচিতদের উপস্থিতি তখন মনে অনেক সাহস জোগায়। যা হয়তো আপনি বুঝবেনই না। ধর্মের ভয়। বা কোনও কুসংস্কার বলা না হয় বাদ দিন। সদ্য সন্তানহারা মানুষটিকে বিশ্বের যেকোনও টপিক নিয়ে গল্প করুন। জীবনে বাঁচবার সাহস দিন। বাট বি দেয়ার।
 
শেষে
শেষ করার আগে একটা ইংরেজি কবিতার কিছু লাইন না দিয়ে পারছি না-  আপনি কাঁদতে পারেন এই ভেবে যে, সে চলে গেছে। কিংবা হাসি মনে ভাবতে পারেন যে, সে বেঁচেছিল। চোখ বন্ধ করে ভাবতে পারেন সে যেন ফিরে আসে। অথবা চোখ খুলে দেখতে পারেন সে যা কিছু রেখে গেছে। আপনার মন শূন্যতায় ভরতে পারেন যে তাকে ছুঁতে পারছেন না। কিংবা মনে করতে পারেন যে আপনি ভাগ্যবান যতটুকু ভালোবাসার পরশ আপনাকে সে দিয়ে গেছে। আপনি অতীতকে আঁকড়ে ধরে ভবিষ্যৎকে পারেন অস্বীকার করতে। কিংবা আপনি অতীতের সাথে সুখের সময়ের কথা ভেবে ভবিষ্যৎকে আলিঙ্গন করতে পারেন। আপনি শুধু মেমোরিজ নিয়েই বেঁচে থাকতে পারেন যে সে আর নেই। অথবা আপনি তার আনন্দের মেমোরিজ স্মরণ করে বাঁচতে পারেন। আপনি শোকে চোখের পানির শূন্যতায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারেন। অথবা আপনি হাসিমুখে ভালোবাসায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন, যা আপনার সন্তান চেয়েছিল।
 
ইচ্ছে করেই আমার লেখায় কারো নাম উল্লেখ করি নি। যেহেতু আমার পরিবারের ৭০%  ইমিগ্র্যান্ট। বন্ধুরাই আমার সব। তাদের ছাড়া এই শোকের সাগর পাড়ি দেয়া অসম্ভব ব্যাপার।সবাইকে প্রাণঢালা কৃতজ্ঞতা।

লেখক: সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
হজ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার শঙ্কা এজেন্সি মালিকদের
হজ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার শঙ্কা এজেন্সি মালিকদের
তীব্র গরমে উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা
তীব্র গরমে উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা
হিজবুল্লাহর ৪০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি ইসরায়েলের
হিজবুল্লাহর ৪০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি ইসরায়েলের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ