মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ীর নির্বাচন কমিশনার হওয়ার স্পর্ধা!

ডা. জাহেদ উর রহমান‘ধূমপান ত্যাগের জন্য আপনার ইচ্ছাই যথেষ্ট’– ছোটবেলায় ধূমপানের বিরুদ্ধে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে এই বাক্যটি ব্যবহৃত হতো খুব। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে ডামাডোলের মধ্যে বাক্যটি আমার খুব মনে পড়ে। কেন মনে পড়ে সেই ব্যাখ্যায় যাবার আগে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যা যা হচ্ছে সেটা নিয়ে কয়েকটি কথা বলে নিই।

দেশবাসীর সামনে অপেক্ষা করছে এক বিরাট কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক। এই কলাম যখন লিখছি, তখন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য গঠিত সার্চ কমিটি তার কাজ শেষ করে এনেছে প্রায়। খুব দ্রুতই তারা তাদের নির্বাচিত দশ জন মানুষের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবেন এবং এরপরই গঠিত হবে নির্বাচন কমিশন। এই নির্বাচন কমিশনে যারা থাকবেন, তাদের নিয়ে এত বিতর্ক সমাজে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং এটাকেই আমি অপ্রয়োজনীয় বলছি।

আসলে এই অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক চলছে বেশ আগে থেকেই, যখন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের কথা শুরু হয়। এরপর আইন তৈরি করার সিদ্ধান্ত হয়। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইনটি পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সমাজের নানা জায়গা থেকে খুব স্পষ্টভাবে প্রমাণ করা হয়েছে কেন এই আইনের অন্তর্নিহিত সমস্যার কারণেই কোনোভাবে একটা স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব না। এরপর সার্চ কমিটি গঠনের পরও দেখা গেলো, এখানে অন্তত দুজন সদস্য ক্ষমতাসীন দলের হয়ে সংসদ নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। আর এই দেশের সাংবিধানিক পদগুলোর নিয়োগ কীভাবে হয়, কাদের সেখানে পদায়ন করা হয়, সেটা সবাই জানেন।

যারা এই আইন এবং সার্চ কমিটি নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন, আমাদের অবাক করে দিয়ে অনেককেই দেখলাম কলাম লিখে, টকশোতে বলে সার্চ কমিটিকে দিকনির্দেশনা দিতে শুরু করলেন। এরপর দলে দলে ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিরা’ সার্চ কমিটির ডাকে তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। সেই কমিটিকে তারা কী বলেছেন, সেটা নিয়ে মিডিয়ার সামনে কথা বললেন, কলামও লিখলেন। কীভাবে সার্চ কমিটির কাজ করা উচিত, কীভাবে তারা একটা সঠিক নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন ইত্যাদি।

‘বিশিষ্ট ব্যক্তিরা’ মোটা দাগে যেসব মানুষকে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে বিবেচনার বাইরে রাখতে বলেছেন, তাদের মধ্যে আছে বিভিন্ন সরকারের আমলে বিশেষভাবে পছন্দনীয় হিসেবে যাদের চাকরি, পদোন্নতি বা পদায়ন হয়েছিল, যারা প্রকাশ্যে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, যাদের সঙ্গে সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক ছিল/আছে, যাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনকালে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ছিল ইত্যাদি।

পাঠক এইমাত্র যে শর্তগুলোর কথা পড়লেন সেগুলো কি আপনি আমি জানতাম না? যে সদস্যদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড, কারও কারও রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি কিন্তু তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি কম এই অভিযোগ নিশ্চয়ই আমরা করি না। তাহলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাদের বাদ দিতে হবে কিংবা কাদের নিতে হবে সেই জ্ঞানের কোনও ঘাটতি তাদের থাকার আদৌ কারণ নেই। তাহলে আগের সার্চ কমিটিগুলো কেন রাকিব কিংবা হুদা কমিশনের মতো নির্বাচন কমিশন তৈরি করেছিল? কিংবা সেই কমিশনগুলো, বিশেষ করে নুরুল হুদা কমিশন কেন এত যাচ্ছেতাই মানের নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে?

এবার সার্চ কমিটির কাছে বিভিন্ন দল এবং ব্যক্তির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ৩২২ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। নামগুলো মিডিয়ায় আসার পরপরই সেগুলো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ হয়েছে। এই তালিকায় কারা আছেন, এরমধ্যে কতজন কোন শ্রেণিতে পড়েন (অবসরপ্রাপ্ত আমলা, বিচারক, শিক্ষক ইত্যাদি) এসব নিয়ে মিডিয়াগুলো দীর্ঘ রিপোর্ট করেছে। কেউ কেউ যুক্ত করেছিল চমৎকার গ্রাফিক্সও।

প্রস্তাবিত নামগুলোর মধ্যে একজন মানুষকে নিয়ে আলাদা করে রিপোর্ট করা হয়েছে। তিনি হলেন একজন মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ী। এটা নিয়ে মূল ধারায় যেসব রিপোর্ট এসেছে তাতে বিস্ময়ের সঙ্গে এক ধরনের তাচ্ছিল্যও ছিল। সেই সংবাদ আমরা যারা সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছি তারা তো কোনও রকম রাখঢাক না করে যাচ্ছেতাই বলেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ী কেন নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন না?

কেউ কেউ মনে করতে পারেন নির্বাচন কমিশনার হওয়ার জন্য নির্বাচনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা কিংবা অনেক ভালো ধারণা থাকা জরুরি। তাহলে নির্বাচন কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা কিংবা পুলিশ এবং প্রশাসনের আমলা ছাড়া কারও সেই যোগ্যতা থাকার কথা না। প্রায় সব নির্বাচন কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা ছিলেন, নিম্ন আদালতের বিচারকরা ছিলেন, এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতিরা। এখন তো একজন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তাকে কমিশনে রাখা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। এসব মানুষজন তো কখনও নির্বাচনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে কোনও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি। কিন্তু আমরা কী প্রশ্ন করি সেটা নিয়ে?

এবার যে ৩২২ জন মানুষকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন বহু নাগরিক সমাজের মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এদের তো নির্বাচন করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকার কথা না। তাদের নাম প্রস্তাবকে নিয়ে আমরা হাসাহাসি করিনি কেন?

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত নির্বাচন কমিশনটি হচ্ছে যেটা এইমাত্র তার মেয়াদ শেষ করলো। জনাব নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন সেই কমিশনের সদস্যদের প্রোফাইলটা একটু দেখে নেওয়া যাক। কে এম নুরুল হুদা ছিলেন অতিরিক্ত সচিব, অতিরিক্ত সচিব ছিলেন মাহবুব তালুকদারও, সচিব ছিলেন মো. রফিকুল ইসলাম, বেগম কবিতা খানম ছিলেন রাজশাহীর জেলা ও দায়রা জজ, আর শাহাদত হোসেন ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।

নিশ্চয়ই যথেষ্ট বড় প্রোফাইলের লোকজন এখানে ছিলেন কিন্তু তার ফল দেশের সংসদ নির্বাচন তো বটেই, স্থানীয় সরকারের ক্ষুদ্রতম ইউনিট ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও কী হয়েছে সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই।

শুরুতে বলেছিলাম দেশের নির্বাচন কমিশন গঠন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলে আমার ধূমপানবিরোধী বিজ্ঞাপনের স্লোগানটির কথা মনে পড়ে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি নির্বাচন কমিশন গঠন এবং একটা সঠিক নির্বাচনের জন্য ধূমপান ত্যাগের মতো ইচ্ছাই যথেষ্ট।

সার্চ কমিটি একটা সঠিক নির্বাচন কমিশন তৈরি করতে পারবেন না। কারণ, তাদের ইচ্ছেই নেই। কীভাবে সেটা করতে হয় সেটা তারা জানেন যদিও। আবার এটাও হতে পারে তাদের ইচ্ছা ছিল কিন্তু সরকারের সেই ইচ্ছে নেই, তাহলেও হবে না। আবার খুবই সঠিক একটা নির্বাচন কমিশন তৈরি হলো কিন্তু সরকারের ইচ্ছে না থাকলে একটা খুব ভালো নির্বাচন হওয়াও অসম্ভব।

কাগজে-কলমে নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান এবং আইনে তার বেশ কিছু ক্ষমতাও আছে। কিন্তু সরকার না চাইলে একটা সঠিক নির্বাচন হতে পারে না। কিন্তু এটাও ঠিক, যথেষ্ট আন্তরিক এবং কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ যদি হন এবং তারা যদি দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নেন তাহলে সরকারের সঙ্গে অন্তত কিছুটা লড়াই তারা করতে পারেন। এক-এগারোর সময় গঠিত শামসুল হুদা কমিশন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরকম লড়াইয়ের ইতিহাস আমরা জানি।

আসলে নির্বাচন কমিশনে যারা থাকেন তাদের নিয়ত কতটা সহি, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ী কিংবা এই রকম আরও কিছু পেশার মানুষকে নিয়ে তৈরি হওয়া একটি নির্বাচন কমিশন সদ্যই বিদায় নেওয়া নুরুল হুদা কমিশনের চাইতে হাজারগুণ ভালো নির্বাচন করতে পারবে যদি তাদের সহি নিয়ত থাকে। একটা কথা জেনে রাখি, নির্বাচন কমিশন সরকারের সাহায্য ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচন তো বটেই, জাতীয় নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে নির্বাচন কমিশন।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট