আধুনিকতাকে ধারণ ও লালন

হায়দার মোহাম্মদ জিতুআওয়ামী লীগের চলমান ১৩ বছরের শাসনামলে গত দুই বছরে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ, এই অতিমারিতে অর্থনীতির প্রায় সবকিছুকেই ধীর পায়ে চলেছে। কিন্তু আশার কথা হলো, বৈশ্বিক এই অতিমারিতেও যেখানে উন্নত এবং শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর অর্থনীতি মন্থর ছিল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের নিচে ছিল, সেখানেও বাংলাদেশ প্রায় ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে।

প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই পথচলাকে তুলনামূলক অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করলে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ব পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা হবে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। জাপানের মতো দেশেরও প্রবৃদ্ধি কমবে বলে শঙ্কা রয়েছে। সেখানেও বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে ধরে রাখতে সক্ষম হবে।

বৈশ্বিক এই মন্দার বাজারে সবাই যখন টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে একসময়ের অপবাদ পাওয়া ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। এটাই এখন অনেকের গাত্রদাহের কারণ। এক্ষেত্রে রাজনীতিকে নিরীক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা জরুরি। সম্প্রতি আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অস্ত্র রফতানির বাজার হারিয়েছে। বিশ্ব জানে এদের অর্থনীতির একটা বড় অংশজুড়ে আছে অস্ত্র রফতানি খাত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেদের জাতিগত সংঘাত এবং বিভাজন পাশ কাটিয়ে বৈশ্বিক বন্ধুত্ব, ব্যবসা নিয়ে এগোতে তৎপর হয়েছে। এতে আরও অনেক দেশেরই অস্ত্রের বাজার হুমকির মুখে পড়বে।

শিক্ষার বৈশ্বিক আদান-প্রদানের কারণে এখন অনেক দেশই নিজস্ব প্রযুক্তি ও প্রয়োজনীয় অস্ত্র উৎপাদনে মনোনিবেশ করেছেন। মৌলিক চাহিদা পূরণের বাস্তবতাকে পূরণ করে মহাকাশে কর্তৃত্ব স্থাপনে উঠেপড়ে লেগেছে। তাছাড়া রোবটিক সাইন্সের কারণে আগামীতে যে অস্ত্রের ধরন, ব্যবহার ও যুদ্ধ কৌশল বদলে যাবে সেটাও স্পষ্টতর। এ কারণেই স্বার্থে টান পড়া দেশগুলো অন্যদের এগোবার পথ, চিন্তার পথ রুখতে বিশ্বব্যাপী নিত্য নতুন সংকট সৃষ্টিতে তৎপর।

কেউ কেউ অবশ্য শুধু ক্ষমতার খাতিরে নিজেদের দেশকে বিশ্বের কাছে হেয় করে প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেন না। সম্প্রতি ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তা বাস্তবায়নে যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়েছে। দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে আমদানি-রফতানি বন্ধ তাগিদ দিয়েছে। অথচ ভৌগোলিক সীমানা অনুযায়ী দেশের গুরুত্ব বুঝলে নিজ দেশের প্রশ্নে তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। আর যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলবে তার আগে ২০২০ সালে নিজেদের ১০০৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করুক। ৮৭ হাজার ৭৮৫টি ধর্ষণের বিচার শেষ করুক।

আশার কথা হলো, বৈশ্বিক নজরবন্দির খপ্পর হটিয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন-দর্শনে দেশ এগিয়ে চলছে। বিশ্ব অর্থনীতির উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে নিজেদের দারিদ্র্যের হার ১ শতাংশ হলেও কমবে এমন প্রচেষ্টায় পথ চলছে। আর এটা সম্ভবও। কারণ, ২০২১ সালের পরিসংখ্যানে যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্যের হার ১৩.৪%, সেখানে বাংলাদেশের ২০.৫%। কাজেই বাংলাদেশ যেভাবে এগোচ্ছে তা যদি আগামী দশ বছর ধরে রাখতে পারে তাহলেই এটা সম্ভব।

প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কপবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি বাস্তবায়ন হলে উন্নয়ন ও অগ্রগতি আরও দৃশ্যমান হবে। এসবই আগামীর অর্থনৈতিক জয়ের ইঙ্গিত।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেকোনও জাতির মৌলিক চাহিদা পূরণের সহায়ক। কিন্তু এই উন্নয়নকে টেকসই ও মর্যাদাসম্পন্ন করতে সংস্কৃতির জাগরণ প্রয়োজন। প্রথাগত পেশা-কর্মসংস্থানের বাইরেও যুগের প্রয়োজনে নতুন শিল্পভিত্তিক উদ্ভাবনী আয়োজন প্রয়োজন। এসব কিছু এককভাবে সরকার কিংবা রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিশ্ব পরিমণ্ডল হিসেবে দেখা যায়, বৈশ্বিক চালকের বহু কিছুই বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে।

এই উন্নয়ন ও এগিয়ে যাওয়ার মিছিল সম্পর্কে আরও সচেতনতা যুক্ত করতে হবে। কারণ, এই যে ভবিষ্যৎ শিরদাঁড়া পোক্ত করে দাঁড়ানো, তাতে দিনে দিনে উঠতি দেশ হিসেবে বহু সুবিধা বাতিল হতে শুরু করবে। যেমন, বহু দেশে শুল্ক সুবিধা তুলে নেবে। অবকাঠামো উন্নয়ন শেষ হলে প্রকৌশলী-শ্রমিকের একটা অংশ কর্মহীন হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। কাজেই বহুমাত্রিকতা যুক্ত করার পরিকল্পনা জরুরি।

এর বাইরে দেশের সব উন্নয়ন আরও জোরালো হয়ে উঠবে যদি রাজধানীকে জনগণকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে যানজট থেকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলোয় জনগণ রাজধানীর বাইরে থেকে কর্মসংস্থানে যান এবং কাজ শেষে ঘরে ফিরেন। বাংলাদেশের মেট্রোরেল ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণকে সেই সুবিধার পথে নিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা রাজধানীর বাইরে পরিকল্পিতভাবে শহর-উপশহর গড়ে তুললে তা আরও সহায়ক হবে।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বুকে বিস্ময়কর এবং উদাহরণসূচক রাষ্ট্র। কাজেই একে ঘিরে বৈশ্বিক চিন্তা ও বন্ধুত্বের আহ্বান হবে এটাই বাস্তবতা। আবার সে নিজের উন্নয়ন কাঠামো ধরে রেখে নিজের পলিসিতে এগোবে সেটাকে বুঝতে পারা ও বোঝাতে পারাটাও বৈশ্বিক আধুনিকতা হবে। বাংলাদেশ এই আধুনিকতাকে ধারণ, লালন এবং সঙ্গে করেই এগোবে। এটাই শেখ হাসিনার চিন্তা-বাস্তবতা।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।

haiderjitu.du@gmail.com