যে ৩৫টি দেশ ভোট দেওয়ায় বিরত ছিল এদের অধিকাংশ দেশে হয় গণতন্ত্র নেই, না হয় দুর্বল গণতন্ত্র বা ধর্মীয় গণতন্ত্র। বাংলাদেশ সবসময়ই দাবি করে আসছে বাংলাদেশ তার গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করে গড়ে তুলছে। আর তার ভিত্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭২-এর সংবিধান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অন্য রাষ্ট্রের আগ্রাসন থেকে নিজের ভূখণ্ডকে মুক্ত করা। যে কাজে দেশের সব নাগরিক অস্ত্র ধরে ছিল। যার সঙ্গে ভিয়েতনামের মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সে দেশের জনগণ যা করেছিল, এখন ইউক্রেনের রুশ হামলার বিরুদ্ধে সে দেশের জনগণ যা করছে– বাংলাদেশের জনগণ সেই কাজটিই ১৯৭১ সালে করেছিল। তাই যেকোনও রাষ্ট্র বা ভূমি আগ্রাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে ও অস্ত্র হাতে নিয়ে স্থির করেছে। বাংলাদেশে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, ১৯৭১-এর জনগণের ওই অবস্থান স্বীকার করলে তাকে যেকোনও আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই থাকতে হবে। আর তা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তিনি সেদিন প্রবল প্রতাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেমন ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ বা মুক্তির যুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন, তেমনি সমর্থন করেছিলেন ভিয়েতনামিদের প্রতিরোধ বা মুক্তির যুদ্ধকে।
আর ১৯৭১ সালের এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা বাংলাদেশের সংবিধানের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সংবিধানের আর্টিক্যালে ২৫-এ স্পষ্ট করে বলা আছে, বাংলাদেশ যেকোনও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিপক্ষে থাকবে। এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিপক্ষে থাকবে। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিন ও ভিয়েতনামের জনগণের সংগ্রামের পক্ষে থেকে আমেরিকার আগ্রাসনের বিপক্ষে ছিলেন। ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান তাই ভিয়েতনাম ও ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু যেমনটি নিয়েছিলেন, তার বিপরীত কিছু হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দর্শন ও সাংবিধানিক নীতি ছাড়াও বর্তমান পৃথিবীর ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্যে কখনোই ভারত, চীন, পাকিস্তান যে নীতি গ্রহণ করছে, সেই নীতি গ্রহণ করার কোনও সুযোগ নেই। প্রথমত ভারতের সেই আগের গণতান্ত্রিক নীতি এখন আর নেই। যে ভারত একসময়ে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে অনেক রাষ্ট্রনায়কের থেকে বেশি সম্মান দিতো, সেই ভারত এখন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল প্রশ্নে ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ভারতের সেই উদার গণতন্ত্র এখন অনেকখানি ক্ষয়িষ্ণু। অপরদিকে চীন নীতিগত ও চরিত্রগতভাবে রাশিয়ার মতোই একটি দেশ। যদিও প্রচার করা হয় চীন এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক শক্তি ও অর্থনৈতিক কলোনি তৈরিতে ব্যস্ত। সরাসরি কোনও আগ্রাসনে তারা যাবে না। বাস্তবে ইতিহাস কি তা-ই বলে? চীন কি একের পর এক তার পেটের ভেতর থাকা ছোট দেশ বা বেলি স্টেটগুলোর দিকে হাত বাড়াচ্ছে না। তারা তিব্বতকে অনেক আগেই নিয়ে নিয়েছে। ম্যাকাউ তাদের সঙ্গে যেতে বাধ্য হয়েছে। সে স্বাধীন থাকার কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি। হংকংকে যে গণতন্ত্র দেওয়ার কথা ছিল তা না দিয়ে সেখানে পুরো কর্তৃত্ববাদ চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া ইতোমধ্যে ইউক্রেনে তার সামরিক হাত ঢুকিয়েছে আর চীন তাইওয়ানে সে হাত দেওয়ার জন্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বস্তুত পূর্ব এশিয়ার সব দেশকেই বা বিশেষ করে সাউথ চায়না সি সংলগ্ন দেশগুলোকে চীন তাদের বেলি স্টেট বানাতে চাচ্ছে। যেমন, রাশিয়া কাজাখস্থানে অবৈধ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করেছে আর ইউক্রেনে কী করছে তা তো গোটা বিশ্ব দেখছে।
বিশ্বের এই বড় শক্তির বিশেষ করে অটোক্র্যাটিক শক্তিগুলোর হাত থেকে তাদের পাশে থাকা ছোট দেশগুলোর স্বাধীন ও সার্বভৌম থাকার পথ কখনোই সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে নয়। কারণ, একটি ছোট দেশ যতই সামরিকভাবে শক্তিশালী হোক না কেন, সে কতই বা শক্তিশালী হতে পারে! তাই এই এ ধরনের দেশগুলোর নিরাপত্তা সবসময়ই নির্ভর করে জনগণের শক্তির ওপরে আর গণতান্ত্রিক শক্তির ওপরে। বর্তমানের এই গ্লোবালাইজেশনের মধ্যে এখন সামরিক শক্তির বিপরীতে অর্থনৈতিক শক্তি ও গণতান্ত্রিক শক্তি যে বড় হয়ে উঠেছে, তা যে সমানে সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে জোটবেঁধে যুদ্ধ করতে পারে তা ইউক্রেন যুদ্ধে কিছুটা হলেও পরিষ্কার হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুদ্ধের এই নতুন গতিপথের কথা পৃথিবী চিন্তা করে এবং আজ তা অনেকখানি বাস্তব।
তাই এমন অবস্থায় ছোট দেশ বা কোনও দেশের বেলি স্টেটের সার্বভৌমত্ব এখন দেশের জনগণ, রাষ্ট্রের জনগণতান্ত্রিক নীতি ও গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক কতটা গভীর তার ওপর নির্ভর করছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ দুটো বড় শক্তির বেলি স্টেট। এক. ভারত, দুই. চীন।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের পেটের মধ্যেই। তবে তারপরে চীন ও ভারতকে বিশ্লেষণ করলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যে চীন বেশি হুমকির। কারণ, ভারতের গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু হলেও সে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাছাড়া তার গণতন্ত্রকে সংস্কার করার জন্যে সবসময়ই একটা চেষ্টা সে দেশের মধ্যে চলছে। তাই এ ধরনের একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অন্য দেশের ওপর সামরিক হস্তক্ষেপ চালাতে গেলে তাকে দেশ ও দেশের বাইরে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। তাছাড়া গণতান্ত্রিক বিশ্বের অর্থনৈতিক অবরোধের কাছে চীনের তুলনায় ভারত অনেক বেশি দুর্বল রাষ্ট্র। সর্বোপরি ১৯৭১ সালে ভারত একতরফা পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ বন্ধ করে এবং দ্রুত বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে প্রমাণ করেছে তারা ভূমি আগ্রাসে যাবে না।
অন্যদিকে চীনের অবস্থান ভারতের মতো বাংলাদেশের একেবারে সীমান্তে না হলেও সে কিন্তু মূলত বাংলাদেশের সীমান্তে এসে গেছে। কারণ, মিয়ানমার মূলত চীনের একটি বাফার স্টেট। তাই চীনের সীমান্ত ধরতে হবে মিয়ানমার অবধি। সে হিসেবে বাংলাদেশ তার বেলি স্টেট। তাই ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধে জেতার জন্যে বিশেষ করে ভারতের শুধু লাদাখে, অরুণাচল সীমান্তে না থেকে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত অবধি পৌঁছানোর চিন্তা যেকোনও সময়ে চীনের মাথায় আসতে পারে। আর সে সময়ে প্রথমেই খড়গ নামবে বাংলাদেশের ওপর। এ ধরনের কোনও বিপদ এলে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারবে তিনটি শক্তি: এক. বাংলাদেশের জনগণ, দুই. বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চরিত্র। তিন. গণতান্ত্রিক বিশ্বের সর্বোচ্চ সমর্থন। যে সমর্থন এখন ইউক্রেন পাচ্ছে।
তাই কোনও বিচারেই বাংলাদেশের ইউক্রেন প্রশ্নে ভোটদানে বিরত থাকা সঠিক হয়নি। বাংলাদেশকে ইউক্রেনের পক্ষে অর্থাৎ রাশিয়ার অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে যে প্রস্তাব এসেছিল জাতিসংঘে, ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে হতো।
অনেকে বলবেন, রাশিয়ার সঙ্গে তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের ক্ষতি হবে। তা মোটেই নয়। বাংলাদেশের চেয়ে ইউরোপের অনেক দেশের অনেক বেশি বাণিজ্য রাশিয়ার সঙ্গে, সিঙ্গাপুরেরও বেশি বাণিজ্য রাশিয়ার সঙ্গে। তারাও যুদ্ধ বন্ধের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। কারণ, কূটনীতিতে কোনও একটি বিষয়ই সব বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলে না। আর কূটনীতিতে কখনোই নিজ দেশের মৌলনীতি থেকে সরতে নেই।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক