রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট ও সংশয়

রাশেক রহমানবড় অস্থির ও অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্ব-ব্যবস্থা। প্রতিদিন আমাদের চিন্তা ও চেতনার বড় অংশে প্রভাব ফেলছে রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান সংকট। এসময় হঠাৎ মনে পড়লো বিবিসিকে দেয়া সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং-এর একটি সাক্ষাৎকারের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব একটি বৈচিত্র্যময় স্থান। গুণ বা প্রজ্ঞার ওপর কারও একচেটিয়া অধিকার নেই।’ 

বিবিসি হার্ডটকের স্টিফেন স্যাকুরকে দেয়া সেই সাক্ষাৎকারে তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘আপনি আমেরিকানদের দিকে তাকান। তাদের নৈতিক বিষয়সমূহের প্রতি উৎসাহের অভাব নেই। তারা গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা, নারী ও সমকামীদের অধিকার, এমনকি ট্রান্সজেন্ডার অধিকারকেও প্রচার করে। কিন্তু সেসব আপনি তাদের সমস্ত মিত্রদের সাথে বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনভাবে প্রয়োগ করতে দেখছেন না।’ 

আমার কাছে মি. লি সিয়েন-এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে এই অভিব্যক্তি দু’টি এখনও যুগোপযোগী মনে হয়। বিশেষ করে ইউক্রেন প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাগৈতিহাসিক আধিপত্যবাদী মানসিকতা ও বৈদেশিক নীতির কারণে আজ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা কাজ করছে। ফিলিস্তিনে বিরাজমান দীর্ঘকালের সংকটের মূল অনুঘটক যুক্তরাষ্ট্র। এটি চরম সত্য। ২০২১ সালের ১৬ মে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা তাদের দায় নিক, একটি স্পষ্ট অবস্থান নিক। এ সংকট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মহল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সঙ্গে কাজ করুক যুক্তরাষ্ট্র।’ 

বৈঠকে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ আল-মালকি বলেন, ‘প্রতিবারই ইসরায়েল একজন বিদেশি নেতাকে ডেকে তাদের পক্ষে কথা বলায়। এর মধ্যে দিয়ে ফিলিস্তিনি হত্যার বিষয়ে আরও উৎসাহ পায় ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা এই সংকট ও সংঘাতগুলোকে ত্বরান্বিত করে ও করছে।’ খোদ মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করে স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন বক্তৃতায় বলেছেন যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ছিল বাইডেনের ব্যর্থ নীতির ‘সরাসরি ফলাফল’। তিনি এটিকে জো বাইডেনের নেতৃত্বে হোয়াইট হাউসের ‘বিপর্যয়কর ভুল’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।  
  
ফিরে আসি মূল আলোচনায়। মি. পুতিন ফরাসি রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাথে এক ফোনালাপে বলেছেন, ‘ইউক্রেন শান্তি আলোচনায় যত সময় নষ্ট করবে, রাশিয়া তাদের শর্তের সংখ্যা ততো বাড়াবে।’ ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে তার যুদ্ধ অভিযান ঠিক পথে ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে গত বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছেন। ইউক্রেনে রাশিয়ান বাহিনীর সমর অভিযানের সাফল্যের মাত্রা নিয়ে নানা রকমের মতামত ও বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই বক্তব্য দিয়েছেন। পুতিন ইউক্রেনের বাহিনীকে ‘নব্য-নাৎসি’ আখ্যায়িত করে এ যুদ্ধে রুশ সেনাদের ‘বীরত্বের’ প্রশংসাও করেছেন। পরাক্রমশালী রুশ বাহিনী এক সপ্তাহে ইউক্রেনের দক্ষিণের কৃষ্ণসাগরের কাছে বন্দর শহর খেরসন পুরো নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছে। শহরের প্রশাসনিক সদর দফতরও রুশ সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে। 

অনেক সামরিক বিশ্লেষকের মতে, নিপাহ নদী তীরবর্তী খেরসনের নিয়ন্ত্রণ রুশদের সামরিক কৌশলের দিক থেকে অনেক সুবিধা দেবে। কারণ এরপর সাগরপথে সৈন্য, অস্ত্র, সরঞ্জাম, রসদ নিয়ে এসে এই শহরকে ভিত্তি করে ইউক্রেনের ভেতরে ঢোকা সহজ হয়ে যাবে তাদের জন্য। এছাড়া দেশটিতে তিন দিক থেকে আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়েছে রাশিয়া। রুশ সাঁজোয়া সমরযানের ৪০ মাইল দীর্ঘ বহর কিয়েভের খুব কাছে। 

এ-যুদ্ধকে ঘিরে সমরাস্ত্র ও সমরযানের দামামা যেমন বাজছে, তেমনি বাকযুদ্ধও চলছে। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র ও সংস্থা প্রধানরা বিভিন্ন রকমের প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ হুমকি দিচ্ছেন, সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, ‘রাশিয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের একমাত্র বিকল্প উপায় হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।’ সেসবের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়াও কম যাচ্ছে না। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেরগেই লাভরভ বলছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলে তা পরমাণু যুদ্ধে মোড় নেবে।’ এর আগে মি. পুতিন তার দেশের নিরাপত্তা স্বার্থ ও শর্তগুলোর বিষয়ে বলেন, ‘ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে, ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ ও নাৎসিবাদের প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং দেশটির নিরপেক্ষ অবস্থান (পশ্চিমাপ্রীতি কাটানো) নিশ্চিত করতে হবে।’

ইউক্রেনে রুশ হামলার মুখে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউরোপের নেতাদের বলেছেন, ‘আপনারা যে আমাদের পাশে আছেন, তার প্রমাণ দিন।’ এই কথার গভীরতা অনেক। এই কথার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। জেলেনস্কি হয়তো প্রত্যাশা করছেন, ইউরোপের রাজনৈতিক নেতারা সম্মিলিত নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থনে একত্রিত হোক। তার ভাবনায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ যথেষ্ট নয়। তিনি চাচ্ছেন, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো জাতিসংঘের সিস্টেমটিকে সেভাবে ব্যবহার করুক যেভাবে এটি মূলত যুদ্ধোত্তর যুগে কাজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, আগ্রাসনের ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে এবং সিদ্ধান্তমূলকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে। মি. জেলেনস্কি হয়তো চাচ্ছেন, যদিও রাশিয়ান ভেটো দ্বারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পদক্ষেপ অবরুদ্ধ, তথাপি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ‘শান্তির জন্য ঐক্য’ নীতির মাধ্যমে কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে। যা নিরাপত্তা পরিষদ ব্যর্থ হলে আগ্রাসনের সমন্বিত প্রতিক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির ওপর একটি দায়িত্ব আরোপ করে, সে পথে রাষ্ট্রগুলো হাঁটুক। 

আরেকটি বিষয় আমরা খালি চোখে দেখছি না বলে হয়তো ভাবছি না। তা হলো, স্পেস সিকিউরিটি। রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান সমস্যা মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ ও সহ-কার্যক্রমে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। কেননা স্পেস এখন উইপোনাইজড এবং মিলিটারাইজড। মহাকাশে রাশিয়ার শক্ত অবস্থান খর্ব করতে চলমান বহুপাক্ষিক প্রচেষ্টা লাইনচ্যুত হয়েছে। এই সমস্ত বিষয় নিয়ে ভাবার কারণ হচ্ছে, একবার রাশিয়া একটি অ্যান্টি-স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় যা মহাকাশের প্রতিটি ব্যবহারকারীকে বিপন্ন করেছিল। চীনও একইভাবে মহাকাশে অ্যান্টি-স্যাটেলাইট লেজার এবং গ্রাউন্ড ব্রেকিং হাইপারসনিক মিসাইল পরীক্ষা করেছে অতীতে। মহাকাশের লড়াই পৃথিবীতে উত্তেজনা খুব প্রবলভাবে প্রসারিত হতে পারে এবং সেখানে যা ঘটবে তার তীব্র প্রতিকূল প্রভাব থাকতে পারে। মহাকাশে একটি যুদ্ধ প্রত্যেকের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে এবং বেসামরিক জীবন ও সমাজের ওপর ধ্বংসাত্মক হবে, যা অকল্পনীয়। 

শেষান্তে এটাই প্রত্যাশা, আমাদের অনুমান ও সংশয়গুলো মিথ্যা হোক। বহুপাক্ষিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বাস্তবসম্মত কালচার তৈরি হোক। মানবিকতা ও মানবাধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে বৈশ্বিক উত্তেজনা দ্রুত হ্রাস পাবে এবং পৃথিবীতে ও মহাকাশে আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় থাকবে এই আশা করি।

লেখক: রাশেক রহমান, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য