ইমরান খান কি বেশি খেলে ফেললেন?

ডা. জাহেদ উর রহমানদেশটি পাকিস্তান বলেই ‘সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে’ যুক্ত করে বলতে হবে– পাকিস্তানে ৯০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন হবার কথা। আমরা জেনে গেছি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অনুরোধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনটি হচ্ছে কিনা, হলে সঠিক সময়ে হবে কিনা কিংবা হলে সেটা কেমন হবে এসব প্রশ্ন এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তান আবার সরাসরি সামরিক শাসনের অধীনে চলে যায় কিনা, উঠছে সেই আশঙ্কাও।

একটা বিষয় আলোচনার শুরুতেই স্পষ্ট করে রাখা ভালো নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পেছনে নানারকম খেলোয়াড় আছে। কিন্তু আস্থা ভোটের দিনের আগ পর্যন্ত সেখানে যা যা ঘটছিল সেটা ছিল সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চৌহদ্দির মধ্যেই। কারও পক্ষ না নিলে ‘গ্যালারিতে বসে খেলাটি দেখলে’ সেটাকে বেশ রোমাঞ্চকর বলেই মনে হচ্ছিল।

আপাতদৃষ্টিতে অসাধারণ নিরাপদে ছিলেন ইমরান খান। মনে হচ্ছিল ইতিহাসে প্রথমবার কোনও পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদ পূর্ণ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু না, সেটা হলো না। ইমরানের চাওয়া মতো নতুন নির্বাচন হোক কিংবা হোক ‘অন্য কিছু’; ইমরান তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারছেন না, এটা প্রায় নিশ্চিত। অর্থাৎ মেয়াদ পূর্ণকারী পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর জন্য পাকিস্তানিদের অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হচ্ছে।

গত ৮ মার্চ অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও ভুল পররাষ্ট্রনীতির অভিযোগে ইমরান খানের জোট সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে বিরোধী দলগুলো। তারপর সেটা নিয়ে নানা চাপান-উতোর চলে। তারপর কয়েক দিন আগে ইমরান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) বিরোধী শিবিরে যোগ দিলে জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় সরকার। অর্থাৎ অনাস্থা ভোটটি যদি হতো তাহলে ইমরানের পরাজয় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আস্থা ভোট হতে দিলেন না পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার।

সংসদে ঘটা এই ঘটনার পরপরই ইমরান প্রেসিডেন্টকে সংসদ ভেঙে দিতে বলেন এবং প্রেসিডেন্ট সেটাই করেন। ক্রিকেটার ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে ইমরানের ক্ষেত্রে ক্রিকেটীয় শব্দ ব্যবহার করা হয় প্রচুর, তাই আমাদের দেশের অনেকেই বলছেন তিনি একটি অসাধারণ রিভার্স সুইং কিংবা গুগলি বল করলেন।

ইমরান নিজে তার এই পদক্ষেপে অসাধারণ আনন্দিত হয়েছেন, ভেবেছেন তিনি চূড়ান্ত বিচারে জিতেই গেছেন। সংসদে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব ডেপুটি স্পিকার বাতিল করে দেওয়ার পর ইমরান খান এক ‘শিশুতোষ’ কাজ করেন। নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে তিনি আনন্দ আর তাচ্ছিল্য মিশ্রিত এক হাসি দেওয়া নিজের একটি ছবি পোস্ট দেন।

পাকিস্তান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ দেখিয়ে এই অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিককে নিজ দেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতেই হবে। ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ-এর দাবি ‘বিদেশি দেশের প্ররোচনায়’  যেহেতু এই অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছে তাই অনাস্থা প্রস্তাব আনয়নকারীরা দেশের প্রতি অনুগত নন। তাই এই প্রস্তাব সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫-এর পরিপন্থী। ডেপুটি স্পিকার সেটা মেনে প্রস্তাবটি খারিজ করে দেন।

সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দেওয়ার কাজটি ইমরান অনেক আগেই করতে পারতেন। বোধ করি তিনি ভেবেছিলেন তার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া দলগুলোর সংসদ সদস্যদের তিনি আবার ম্যানেজ করতে পারবেন। অথবা তিনি চেয়েছিলেন সংকটটাকে দীর্ঘায়িত করে তিনি তার দেশের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে আমেরিকার হস্তক্ষেপ নিয়ে যথেষ্ট শোরগোল করে মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদ উসকে দেবেন।

কোনও সন্দেহ নেই, ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরুর দিন রাশিয়ায় পুতিনের সঙ্গে ইমরানের বৈঠক পশ্চিমাদের ক্ষুব্ধ করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো এ ব্যাপারে লিখিতভাবে অসন্তোষ জানিয়েছিল। এর জবাবেও ইমরান উসকে দিতে চেয়েছিলেন জাতীয়তাবোধ, বলেছিলেন পাকিস্তানিরা কারও দাস নয়। মজার ব্যাপার, তখনই অনেকেই বলেছিলেন কথাটায় ভুল আছে, তিনি অন্তত চীনের দাসে পরিণত হয়েছেন।

ইমরান যতই বিদেশি শক্তির প্রভাবের কথা বলুন না কেন, একটা সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে না রাখতে পারলে সরকারের পতন হবে, এটাই নিয়ম। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থাকলে এটা মেনে নিতে হয়। তাই শেষে এসে ইমরান যা করলেন, সেটা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক কলঙ্কের উদাহরণ হয়েই থাকবে।

পাকিস্তানের সংকট এখন কোর্টে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্পষ্টভাবে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেগুলোর ব্যাপারে মতামত দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের আছে এবং সেটা দেবেন তারা। কথাটা সঠিক। যেহেতু সংবিধানের একটি ধারাকে দেখিয়ে যাবতীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেই ধারা এই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সঠিক হয়েছে কিনা সেটা সুপ্রিম কোর্ট বলবেন। আমরা নিশ্চয়ই জানি, সুপ্রিম কোর্টই সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকারী।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টির সুরাহা হওয়া পর্যন্ত বিরোধীরা অপেক্ষা করেনি। তার আগেই  বিরোধীরা সংসদে প্রতীকী অধিবেশন করেছেন, এবং সেই অধিবেশনে শাহবাজ শরীফকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেছেন। এই পদক্ষেপ একটা জিনিস স্পষ্ট করছে, পাকিস্তানের সরকার আর বিরোধীদের সংকট চরম পর্যায়ে চলে গেছে। এর খুব বড় প্রভাব পড়বে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সময়। যদি সত্যিই একটি নির্বাচন হয়, তাহলে সেটা হবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ক্ষেত্রে যে সরকার এবং বিরোধী দলের ঐকমত্যের দরকার হয়, সেটা হওয়াকে এখন কার্যত অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

ওদিকে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-  যদি সুপ্রিম কোর্ট অনাস্থা প্রস্তাব নাকচ করাকে অবৈধ ঘোষণা করে অনাস্থা প্রস্তাব সংসদে আনতে বলেন, তাহলে সেই রায় কি ইমরানের দল মেনে নেবে? না নিলে মাঠে দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে তীব্র সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে। কী হবে তখন?

পাকিস্তানে সেনাবাহিনী হচ্ছে ‘ভাসুর’, যার নাম সরাসরি মুখে আনা যায় না; ইঙ্গিতে বলতে হয়। সেখানে সেনাবাহিনীকে সবাই বলেন এস্টাব্লিশমেন্ট। এই এস্টাব্লিশমেন্টের আশীর্বাদ ছাড়া কারও পক্ষে ক্ষমতায় আসা ভীষণ কঠিন, আর এরা পুরো বিপক্ষে চলে গেলে ক্ষমতায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। ইমরান যখন ক্ষমতায় আসে তখন সেটা প্রায় প্রকাশ্য ছিল, তিনি সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ নিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন। কয়েক মাস আগে তিনি নিজের পছন্দের সামরিক গোয়েন্দা (আইএসআই) প্রধান নিয়োগ করা নিয়ে সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। অবশ্য শেষে জয় হয় বাজওয়ারই। কিন্তু এটাই বোধ করি সেই ‘রেড লাইন’ যেটা অতিক্রম করে ইমরান তার চরমতম বিপদ ডেকে এনেছেন।

ইমরানকে নিয়ে সংকট চলার মধ্যেই, সংসদে অনাস্থা ভোটের ঠিক আগে বাজওয়া ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে প্রকাশ্যে নিন্দা এবং অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত নই কোন উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তিনি এটা বললেন। তবে আমি এতে নিশ্চিত, যদি পাকিস্তানে একটি নির্বাচন সত্যিই হয় তাহলে সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য ইমরানের দলের অস্ত্রে পরিণত হবে। সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে একেবারে প্রকাশ্যভাবে খুব শক্ত কথা বলা কঠিন, কিন্তু আকারে-ইঙ্গিতে তারা নিশ্চিতভাবেই বলবেন, বিদেশি শক্তি সেনাবাহিনী এবং বিরোধী দলের মাধ্যমে তাকে পদচ্যুত করেছে। এটা কিছু মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধ উসকে দিয়ে তার ভোট বাড়াতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে আদৌ নির্বাচনটি হচ্ছে কিনা। হতেই পারে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হলো, তাহলে তো নির্বাচন হচ্ছে না এখন। আর সেটা যদি হয়ও সেটার গতি প্রকৃতি কারা ঠিক করবে সেটা নিশ্চয়ই বুঝি আমরা।

পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সামরিক অভ্যুত্থানের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এটাকে মাথায় রেখে অনেকেই ভাবছেন মাঠে একটা গোলযোগ সৃষ্টি হলে কিংবা নিজেরাই সেটা সংঘটিত করে সেনাবাহিনী নিজে ক্ষমতা নিয়ে নেবে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, সেটা হচ্ছে না। সেনাপ্রধান যেভাবে প্রকাশ্যে পশ্চিমাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাতে তিনি ক্ষমতা নিলে তার পক্ষে পশ্চিমাদের সমর্থন পাওয়া কঠিন হবে। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে উদার গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উচ্চকিত আছেন, তার পক্ষে পাকিস্তানের মতো একটা দেশে সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান হতে দেওয়া প্রায় অসম্ভব।

আখেরে এস্টাব্লিশমেন্ট অর্থাৎ সেনাবাহিনীই ঠিক করবে ঘটনা কোনদিকে যাবে। এরা এতই শক্তিশালী যে ইমরান তার সাম্প্রতিক প্রতিটি বক্তৃতায় সেনাবাহিনীকে ভীষণ তোয়াজ করে কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে কি লাভ হবে খুব? আমি বিশ্বাস করি, এই ইনিংসে অন্তত তিনি অনেক বেশি খেলে ফেলেছেন।

পাকিস্তানে দুর্নীতি দূর করা আর সুশাসন নিশ্চিত করার অনেক আশা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান। চীনা বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ এর ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রকল্প চীন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের (সিপিইসি) চরম দুর্নীতি নিয়ে ক্ষমতায় আসার আগে খুবই উচ্চকিত ছিলেন। বলেছিলেন ক্ষমতায় গেলে এই দুর্নীতির তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি দেবেন। ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের মতো ওই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করেছিলেন তদন্তের জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হেঁটেছিলেন পূর্বসূরিদের পথেই- পাকিস্তানের চরম অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করা প্রকল্পটি চলেছে আগের মতোই।

এছাড়াও তার পুরো শাসনামলে অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে পাকিস্তান বেশ খারাপ অবস্থায় ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমে যাবার কারণে কখনও চীন, সৌদি আরব, আর কখনও আইএমএফের কাছে নিয়মিত হাত পাততে হয়েছে। বলা বাহুল্য, সাম্প্রতিক ঘটনা তার শাসনকালীন সব ব্যর্থতাকে আপাতত ধামাচাপা দিয়েছে।

ইমরানকে যেভাবে যেতে হচ্ছে তাতে স্বল্প মেয়াদে তার জন্য সুখবর থাকার সম্ভাবনা নেই প্রায়। কিন্তু তিনি যেভাবে বিদেশি শক্তির হতে পতনের বয়ান তৈরি করছেন সেটা তার পরবর্তী রাজনৈতিক পুঁজিতে পরিণত হবার খুব ভালো সম্ভাবনা আছে। এটা সামনের নির্বাচনে তো বটেই, ভবিষ্যতের রাজনীতিতে ইমরানকে অনেকের কাছে একজন শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী নেতার আসন দেওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে।
 
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট