প্রাথমিক হিসাবে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বিদ্যাপীঠের কথা উঠলেই এখানে ঢাউস আয়তন, অবকাঠামোর ভাবনা জুড়ে আসে। বিস্তৃত করে বললে– ১০০, ২০০ একরের প্রকাণ্ড ভূমিসম্পন্ন ক্যাম্পাস না হলে সেটা নাকি বিদ্যাপীঠ হিসেবেই নজরে আসে না। এ ধরনের চিন্তা গবেষণামুখী শিক্ষার অন্তরায়। কারণ, এই ব্যাপক আয়তনের ক্যাম্পাস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনেক জনবল এবং অর্থ খরচ করতে হয়, যা শুধুই অপচয়। এর চেয়ে একে প্রয়োজনীয় আয়তনে ও অবকাঠামোয় রেখে ওই পয়সায় গবেষণামুখী শিক্ষার্থীদের জন্য খরচ করা যায়। আয়তন রক্ষণাবেক্ষণের এই কেরানি কেন্দ্রিক আয়োজনের খপ্পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বের করতে হবে।
দেশে শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে বেসরকারি খাতগুলোর ভূমিকাও প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু এখানেও শূন্যতা আছে। এই খাতের প্রতিনিধিদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মান উন্নয়নের জন্য যতটা না চাপাচাপি করতে দেখা যায় তার চেয়ে ঢের বেশি তাগিদ দেখা যায় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে। ফলে সনাতনী চিন্তার স্রোতে এরাও ভূমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামোগত ব্যয়ে ব্যস্ত থেকে যায়।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চালানোর ক্ষেত্রে প্রায়শই প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। এ নিয়ে যতই বলুন না কেন এখানে দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বাড়ির চাকর-ব্যবহার থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজনদের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের মতো দুর্বৃত্তায়ন আছে। উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এই ব্যবস্থাপনাকে প্রশাসন এবং অ্যাকাডেমিক দুই শ্রেণিতে রাখা হয়। দক্ষ প্রশাসক নিয়োগ করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাজীবনকে সামনে এগিয়ে নেওয়া হয়।
উল্টোদিকে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আঞ্চলিক সমিতি, কমিটি, বাণিজ্য কেন্দ্রিক ক্ষমতার এত এত লেয়ার ও লেজ যে এর মেরুদণ্ড খুঁজে পাওয়া মুশকিল। স্বভাবতই এসব করে উঠতে উঠতে পয়সা, কর্মক্ষমতা, এনার্জি ক্ষয়ে যায়। এর মাঝে আবার কারও কারও এ সমস্যাগুলোকে জিইয়ে রেখে মিষ্টি ও মুখস্থ কথায় ফায়দা লোটার পরিকল্পনা তো থাকেই। তাছাড়া এখানকার শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও জটিল।
বিস্তৃত অর্থে, যে মানদণ্ডে একে বিবেচনা করা হয় তা নিতান্তই প্রতিবন্ধকতার। ব্যাখ্যা করে বললে, দেশীয় প্রেক্ষাপটে শৈশব-কৈশোরের স্বপ্ন হুবহু যৌবনে পরিণতি পেয়েছে এমন মেলা ভারি দায়। সেই জায়গা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক পড়াশোনা ও পদচারণায় নতুন করে অনেকেই শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশায় অনুপ্রাণিত হতে পারেন। কাজেই এক্ষেত্রে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ অবান্তর। আর যোগ্যতার বিষয় নিয়ে বললে কেউ অযোগ্য হলে নিশ্চয় বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পড়াশোনার সুযোগ দিতেন না।
জেনেছি এই ব্যবস্থা আর থাকছে না। তবু এর বাস্তবায়ন মারাত্মক মন্থর। তাছাড়া এখানে এখনও একটি মিশ্র শিক্ষা কার্যক্রম চালিত। শৈশবে-কৈশোরে কোরআন শিখেও বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা, আর্ট, গবেষণায় পড়ছেন শিক্ষার্থীরা, ভালোও করছেন। কাজেই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিকের ফলাফল যাচাই অযৌক্তিক, অপরিকল্পিত। আদতে এসব কায়দা-কানুন শিক্ষক সন্ধানের কার্যক্রমকে সীমিত প্রতিযোগিতার মাঝে নিয়ে আসে।
সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। কাজেই মিষ্টি কথার ফাঁকা বুলি বা টার্গেট না ছুড়ে অপরাধ জায়েজ করতে বিভাগ কেন্দ্রিক যে সিন্ডিকেট ও নৈরাজ্য সেগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। জবাবদিহির আওতায় সকল ক্ষমতাকে বৃত্তভূত করতে হবে। গবেষণা, নাম্বারপত্রের মতো টেম্পারিং, ব্যবস্থাপনায় চুরির মতো কর্মে কমিউনিটি সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে কেউ যেন পার না পায় সেদিকটা সকল সচেতন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অভিভাবকবৃন্দকে নিশ্চিত করতে হবে। সাথে এও মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থী জীবন ব্যতীত কেউই শিক্ষকতা পেশায় আসেননি।
কাজেই কোনও সিদ্ধান্তই যেন শিক্ষার্থীদের ওপর অযাচিত না হয় সেদিকে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। এসব করতে পারলে শিক্ষা কার্যক্রমসহ সকল গবেষণা, সমালোচনা, দায়িত্ববোধ আরও যৌক্তিক ও ফলপ্রসূ হবে।
লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।
haiderjitu.du@gmail.com