সাহসী নেতার প্রত্যাবর্তন

খুশবন্ত সিং’য়ের ‘দ্য কোম্পানি অব ওম্যান’ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়ে ওঠা একজন ব্যক্তির জীবন নিরীক্ষণ ও আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রমঞ্চ। জীবনকে রোমাঞ্চ হিসেবে ভোগ করতে গিয়ে শেষমেশ এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে উপন্যাসের চরিত্র মোহন কুমারের মৃত্যু হয়। উপন্যাসের আচরণ ও প্লট অনুসরণীয় নয়, তবে শেষটা উপলব্ধির। ভোগের অসম লাগাম যাকে কিছুতেই দমাতে পারেনি একক ‘লজ্জা’র কারণে সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। অর্থাৎ জগৎ সংসারের কাছে নিজেকে ব্যভিচারীর মতো ‘লজ্জাকর’ নয়; বরং হতাশ ও নিঃস্ব একজন প্রাণ হিসেবে মৃত্যুর গল্প দিয়ে যেতে চেয়েছেন।

নিপীড়িত, নির্যাতিত প্রলেতাড়িয়েত শ্রেণির চিন্তক কার্ল মার্কসও মত প্রকাশ করেছেন, লজ্জা এক ধরনের বৈপ্লবিক অনুভূতি। খুশবন্ত সিংয়ের উপন্যাসে মোহন কুমার চরিত্রটি একেবারে শেষে হলেও সেই অনুভূতি অনুভব করেছেন, তাতে সাড়া দিয়েছেন।

বাস্তবতা হলো, এই অনুভূতি প্রত্যেক স্তরে ও রন্ধ্রে বহাল রাখা জরুরি। এতে বহু অন্যায়, অন্যায্য পন্থা বন্ধ হবে। এখানকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর ফলাও বিস্তার আবশ্যক। রাজনৈতিক মেরুকরণে একজন নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর এত এত আক্রমণ, এতবার হত্যাচেষ্টা হয়েছে যে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, ডিসকোর্সে পক্ষ-বিপক্ষ সকলের ‘লজ্জা’ নামক এই অনুভূতির চর্চা ও আলোচনা প্রয়োজন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ভাগ্যের ফেরে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা বাঙালির গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মুক্তিদূত শেখ হাসিনার দেশে ফেরার পট, পদক্ষেপে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের আচরণ নাট্যের হরেক রূপের এক রূপ প্রহসনের মতো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। শেখ হাসিনার সাহস ও সঞ্জীবনী শক্তি সব কূটকৌশল, ষড়যন্ত্রকে পদানত হয়েছে। জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

দেয়ালে চিকা মেরে সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এমন সুড়সুড়ি কিংবা আচমকা উসকানি যে কেউ দিতে পারেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামান্য সংকট অনুভূত হলে মজা দেখার তালেও হাঁটতে পারেন। কিন্তু দিনশেষে মানুষ হিসেবে নিজেকেও প্রশ্ন করারও একটা জায়গা থাকা আবশ্যক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না থাকলে এখানকার সন্তানেরা পাকিস্তানি, তালেবানি কায়দায় সুইসাইড বোম্বার কিংবা রক্তাক্ত হয়ে মরে পড়ে থাকতে হতো। কারণ, তাঁর শাসনের অবর্তমানে ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ এমন স্লোগান ধ্বনিত হতে দেখা গেছে। আজকে বাবা-মারা কন্যাসন্তান হলে যেভাবে অনুভূতি অনুভবের সুযোগ পান সেটা কখনোই হতো না। কারণ, তখন কন্যাসন্তান হতো শুধুই সন্তান উৎপাদনের জমিন। অর্থনৈতিক, সামাজিক নিরাপত্তায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেত না। ইতিহাস অন্তত তাই বলে।

ভুলে যাওয়া মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য, কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ভিন্ন ও অনন্য বৈশিষ্ট্য। সেই কৃতজ্ঞতাবোধকে জাগ্রত করা জরুরি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারী ও এর সুবিধাভোগীরা পবিত্র বাংলাকে পাকিস্তানি-তালেবানি কায়দায় রূপান্তরিত করতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনার কল্যাণে সেই অন্ধকারকে বাঙালি রুখে দিয়েছে। বৈশ্বিক পরিসংখ্যান ও উন্নয়ন কাঠামো দেখলে বোঝা যায়, শেখ হাসিনা তালেবানি-পাকিস্তানি কায়দা থেকে বাঁচিয়ে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গেছেন। ওই দুটি দেশই এখন বৈদেশিক ঋণ, মন্দা, সাম্প্রদায়িকতা, নারী নির্যাতন, বৈশ্বিক নিরাপত্তা সূচকে তলানিতে। অন্যদিকে বাংলাদেশের গল্প বৈশ্বিকভাবে আলোচনার, অনুসরণের।

অপ্রতিরোধ্য শেখ হাসিনার সৌন্দর্য ওইখানটায় যে তিনি কাগজে কিংবা সেমিনার কথায় আবদ্ধ নন। বরং নারী উন্নয়ন ও তাঁর স্বাধীনতাকে প্রায়োগিক পদক্ষেপে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। নারীকে অর্থনীতির অংশীদার হিসেবে উপার্জন থেকে শুরু করে নেতৃত্ব পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। যার প্রমাণ দেশের পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে বাণিজ্য সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব প্রদান।

লজ্জার বিষয় শেখ হাসিনার এমন অর্জন ও পথচলাকে অনুকরণ করে কিছু ষড়যন্ত্রকারী, সুবিধাভোগী, বুদ্ধি ব্যবসায়ীরা যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক বেগম জিয়াকে তাঁর সমকক্ষ, সমধর্মী হিসেবে প্রকাশ, প্রচার করতে তৎপর। যেমন, শেখ হাসিনা জননেত্রী বিধায় তাকে দেশনেত্রী, শেখ হাসিনা আপসহীন নেত্রী বলে তাকেও আপসহীন বলে প্রচার। এককথায় এসবই স্রেফ হীনম্মন্যতা। অথচ সামান্য বিপদে এরা মুচলেকা দিয়ে দেশ ছাড়তে তৎপর হয়ে যান। একজন তো দেশের বাইরেই। তবে এসব বাদ দিয়ে তারা আদর্শিকভাবে অবশ্যই শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করতে পারেন।

বাংলার মানুষের জন্য আক্রমণ ও হত্যাচেষ্টাকে শেখ হাসিনা বারবারই পদানত করেছেন। বুলেট, গ্রেনেডকে ভালোবাসার কবিতায় রূপান্তরিত করেছেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে জানিয়েছেন, ‘বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’

বাঙালির শান্ত সাহস শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনকে মানুষ নানা ঢং, আচারে পালন করে, করবে। কিন্তু তাঁর সংগ্রামের গল্পকে কেউ যেন গিলে খেতে না পারে সেজন্য সর্বস্তরে সতর্কতা জরুরি। সেক্ষেত্রে ছাত্রসংগঠন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের কেউ-ই যেন নেতৃত্বে সেশনজট ও কর্মীদের অবমূল্যায়ন করতে না পারে এবং কর্মীদের মাঝে সিদ্ধান্তহীনতা, বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। কারণ, ধারাবাহিকতা নতুন কর্ম ও কর্মী সৃষ্টি করে। উল্টো দিকে ফুরিয়ে যাওয়া সময়কে কূটকৌশল কিংবা ষড়যন্ত্রের দামামায় টিকিয়ে রাখার খেলা ও পুনরাবৃত্তির চেষ্টা কর্মবিমুখতা, একঘেয়েমিপনা ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণকে তোষণ-পোষণ করে। কাজেই সময়ের আহ্বান গ্রহণ আবশ্যক।

লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।

haiderjitu.du@gmail.com