একটি ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ এবং একটি প্রশ্ন

কথাটা যদি শ্রদ্ধাভাজন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের না হতো তাহলে হয়তো গুরুত্বই পেতো না। কথাটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কমেন্টস ঘরে একটি বানরের কৌতুকপূর্ণ হাসিমুখ জুড়ে দিয়েছেন জনৈক হাজী মো. আসলাম উদ্দিন। আতাউর রহমান দর্জি নামে একজন লিখেছেন– কেয়ামত-এর লক্ষণ... আব্দুল খালেক রানা নামে আরেকজন লিখেছেন, ২০২২ সালের শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী...।

নিশ্চয়ই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগছে, আসলে কথাটা কী? কেন এই কথা নিয়ে এত আলোচনা? কথাটা হলো... বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। একটি ভিডিও ক্লিপে তাকে এমন কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। ভিডিওটি কবে, কোথায় ধারণ করা হয়েছে এরকম কোনও তথ্য নেই। ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, ‘পদ্মা সেতুর প্রথম উদ্বোধন... মানে ফাউন্ডেশন অর্থাৎ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। মাওয়াতে এবং ওই পাড়েও...।

ভিডিওটি কয়েকবার দেখলাম। ছবি ঠিক আছে। কিন্তু কণ্ঠ কী আদৌ মির্জা ফখরুলের? নাকি নকল কণ্ঠ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্ন জাগলো মনে? একবার মনে হলো, এই কণ্ঠ মির্জা ফখরুলের নয়। কারণ, তাঁর মতো দায়িত্ববান রাজনৈতিক নেতা এমন ভুল তথ্য দিতে পারেন না। পরক্ষণেই প্রশ্ন জাগলো, কণ্ঠ যে মির্জা ফখরুলের নয় এ ব্যাপারে কি তিনি কোনও বক্তব্য দিয়েছেন? না দেননি। তার মানে ধরে নিতে হবে কণ্ঠটি মির্জা ফখরুলেরই। যদি তাই হয় তাহলে তাঁর এই বক্তব্যের ভিত্তি কী? এতদিন পদ্মা সেতু নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতানেত্রী কত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপই না করেছেন। বেগম খালেদা জিয়া দেশের মানুষের উদ্দেশে বলেছিলেন, আপনারা ওই সেতুতে উঠবেন না। সেতু যদি হয়ও, দেখবেন একদিন ভেঙে পড়ে যাবে... পদ্মা সেতু নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার ব্যঙ্গবিদ্রুপ সবাই শুনেছেন। এর রেকর্ডও রয়েছে। এদিকে মির্জা ফখরুল দাবি করছেন, বেগম খালেদা জিয়া নাকি পদ্মা সেতুর প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? খালেদা জিয়া যদি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেই থাকেন তাহলে তার প্রমাণ কোথায়? নিদেনপক্ষে খালেদা জিয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছেন এমন ছবিও কি দেখাতে পারবেন মির্জা ফখরুল? আরেকটি জিজ্ঞাসা- এতদিন পর মির্জা ফখরুল কেন এমন হাস্যকর দাবি করছেন?

প্রচার মাধ্যমে দেখলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের প্রমাণ চেয়েছেন। কথাটা যেহেতু মির্জা ফখরুলের, কাজেই এর ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকা দরকার। এতদিন স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে কতই না নেতিবাচক কথা হয়েছে। এখন যখন দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম একটি সেতু উদ্বোধন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার, তখন বোধকরি যেকোনও উপায়ে ইতিহাসের অংশ হতে চাইছেন ইতিপূর্বে কঠোর সমালোচনাকারী অনেকেই। স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কের সাথে মির্জা ফখরুলের সাম্প্রতিক বক্তব্যের কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ইতিহাস জানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রেডিওতে এই ঘোষণা দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে পাঠ করেছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। এতে কি প্রমাণ হয় জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক?

একটা গল্প মনে পড়ছে। গ্রামের একজন গরিব মেধাবী ছাত্র এসএসসি পরীক্ষা দেবে। পাশের বাড়ির ধনাঢ্য প্রতিবেশীর কাছে দোয়া চাইতে এসেছেন। প্রতিবেশী গ্রামের মাতব্বর টাইপের মানুষ। তার ছেলেও এসএসসি পরীক্ষা দেবে। গরিব ছেলেটিকে দেখে তিনি অনেকটা অবজ্ঞার সুরে বললেন, তুমিও পরীক্ষা দিচ্ছো? পরীক্ষা দিয়া কী করবা? পাস তো করতে পারবা না? এসএসসি পরীক্ষা এত সোজা না...।

মেধাবী ছেলেটি পরীক্ষা দিলো এবং জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাসও করলো। মাতব্বরের ছেলে পরীক্ষায় ফেল করেছে। চামচারা মাতব্বরকে বললো, মাতব্বর সাব, গরিবের পোলা তো একটা খেল দেখাইলো? কিছু একটা করেন।

মাতব্বর তাদের বললেন, ঝড়ে বক মরছে, কথাটা বোঝোস নাই? আরে এসএসসি পাস করা সহজ। দেখিস ওই ছেলে আর আগাইতে পারবে না। কিন্তু মেধাবী ছেলেটি কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করলো। এবার মাতব্বরকে জেঁকে ধরলো তার চামচারা। মাতব্বর সাব, এইডা কী হইলো? পোলায় তো দেহি আবারও পাস দিলো? মাতব্বর আরও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ইন্টারমিডিয়েট পাস করা খুবই সহজ। দেখিস ওই পোলা আর আগাইতে পারবো না।

কিন্তু মেধাবী ছেলেটি ঠিকই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো! চামচারা আবার প্রশ্ন করলো মাতব্বরকে, পোলা তো ভার্সিটিতে ভর্তি হইছে। এইবার কি কইবেন! মাতব্বর আবারও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, আরে মিয়া ভার্সিটির লেখাপড়া এত সোজা না। ভর্তি হইছে। কিন্তু শ্যাষ পর্যন্ত পাস দিতে পারবো না। কাগজ কলম আনো, আমি লেইখ্যা দিতেছি।

কিন্তু এবারও মাতব্বরের কথা ভুল প্রমাণিত হলো। মেধাবী ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে একপর্যায়ে বিসিএস পরীক্ষা দিল এবং পরীক্ষায় টিকেও গেলো। নিজের জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবে পোস্টিং হয়েছে তার। এবার মাতব্বর ভোল পাল্টাতে শুরু করলেন। গ্রামের যাকেই পান তাকেই মেধাবী ছেলেটির ব্যাপারে গর্ব করে বলেন। বলেছিলাম না, এই ছেলে একদিন শুধু আমাদের এলাকা নয়, গোটা দ্যাশের মুখ উজ্জ্বল করবে? কী, আমার কথাই তো সত্যি হইলো নাকি?

প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই গল্পটির মূল সুর ধরতে পেরেছেন। কথায় আছে, সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকেই হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারও নয়। তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর ব্যাপারে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তখন অনেকেই খুশি হয়েছিলেন। সেতুটি যাতে না হয় এ ব্যাপারে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রও শুরু হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনও ষড়যন্ত্রের কাছেই মাথা নত করেননি। বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, লাগবে না কারও টাকা। আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাবো। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কথাকে অনেকেই গুরুত্ব দিতে চাননি। বরং কেউ কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। কিন্তু মোটেও দমে যাননি আমাদের দেশপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ঐকান্তিক দৃঢ়তায় একটা বিষয় প্রমাণিত হয়েছে, ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। হ্যাঁ, আমরাও পারি...।

এখন শুধুই ২৫ জুনের জন্য অপেক্ষা। কোনও ভুল তথ্য না দিয়ে আসুন সবাই মিলে মনে-প্রাণে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আনন্দকে উপভোগ করি। জয় হোক প্রিয় মাতৃভূমির। জয় বাংলা...।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।