জাফর শাহ গাড়ি থামালেন না কেন?

দু’দিন ধরে আমি আজহার জাফর শাহ’র কথা ভাবছি। তার মানসিক চরিত্রের কথা ভাবছি। তিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন। গাড়িটি একটা মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিলো। গাড়ি তো আর নিজে থেকে ধাক্কা দেয় না, চালকের কারণে ধাক্কাটা লাগে। অর্থাৎ ধাক্কাটা তিনিই দিয়েছেন। ইচ্ছা করে হয়তো দেননি, কিন্তু শেষ বিচারে ধাক্কার দায় তাকেই নিতে হবে। মোটরবাইকের পেছনের আসনে বসে ছিলেন রুবিনা আক্তার। ৪৫ বছর বয়স্ক নারী, স্বামী নেই, এক বাচ্চার মা। ধাক্কায় উনি মোটরবাইক থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যান। আটকে যান ধাক্কা দেওয়া জাফর শাহর গাড়ির বাম্পারে। জাফর শাহ যদি তখনই গাড়িটি থামাতেন, রুবিনা আক্তার হয়তো বেঁচে যেতেন। কিন্তু তিনি গাড়িটি থামাননি। বরং ওভাবেই, বাম্পারে আটকে থাকা ভদ্রমহিলাকে নিয়ে শাহবাগের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে টিএসসি হয়ে নীলক্ষেত এলাকা পর্যন্ত চলে গেছেন। এই পথটুকুর দূরত্ব কত হবে? দেড় থেকে দুই কিলোমিটার তো বটেই। এতটা পথ জাফর শাহর গাড়ি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে হতভাগ্য রুবিনা আক্তারকে। আর এই পুরোটা পথ, গাড়িটিকে অনুসরণ করে দৌড়ে গেছে পথচারীরা।

আমি দৃশ্যটা ভিজুয়ালাইজ করার চেষ্টা করেছি। পারিনি। একটা গাড়ি বেশ গতিতে পাকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, আর তাতে ঝুলে কংক্রিটের রাস্তায় ঘষা খেতে খেতে রক্তাক্ত হয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে একটা মানুষের শরীর- ভাবতেই কেমন ভয়ংকর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেহ-মনে। আমি দৃশ্যটি দেখিনি, দূরে বসে কেবল কল্পনা করার চেষ্টা করেছি। তাতেই এমন দুরবস্থা। যতদূর জানি, তখন ছিল বিকাল বেলা। এ সময় ওই এলাকায় প্রচুর লোকজন থাকে। ফলে তারা সবাই এই মর্মান্তিক দৃশ্যটা দেখেছেন। তাদের কি সেই রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়েছিল? আমার সন্দেহ হয়। আবার যারা গাড়ির পেছনে দৌড়ে গেছেন, গাড়িটি থামিয়েছেন, রুবিনা আক্তারকে উদ্ধার করেছেন, তাদেরই বা কেমন ছিল মানসিক অবস্থা। কিন্তু এত মানুষের চেয়ে আমার বেশি কৌতূহল ছিল গাড়িচালক আজহার জাফর শাহকে নিয়ে। এই যে দীর্ঘ পথ উনি রুবিনা আক্তারকে গাড়ির বাম্পারে আটকে টেনে নিয়ে গেলেন, কীভাবে পারলেন তিনি! তিনি কি পরিণতির ভয়াবহতাটা বুঝতে পারেননি? কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে কি সেটা না বুঝতে পারা সম্ভব? তিনি কি তাহলে মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন না? যদি সেটাই হয়, তাহলে তিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন কীভাবে?

এই ভদ্রলোক একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, আন্তর্জাতিক বিভাগের শিক্ষক। এর অর্থ– মেধাবী মানুষ। মেধাবী না হলে তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। কিন্তু তার আবার ২০১৮ সালে চাকরি চলে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইদানীং শিক্ষক হিসেবে চাকরি পাওয়া বা যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনীতি একটা বড় কারণ হয়ে থাকে। কিন্তু যতদূর জানতে পেরেছি, এই ভদ্রলোকের চাকরি গেছে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তার কারণে। অর্থাৎ তিনি নিয়মিত ক্লাস নিতেন না। বিনা নোটিশে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকতেন। শিক্ষক হয়েও কেন তিনি এরকম করতেন? তার কি কোনও পারিবারিক অথবা মানসিক সমস্যা ছিল?

পাঠক হয়তো বলবেন, আমি কেন একজন খুনির মানসিক সমস্যা খুঁজে বেড়াচ্ছি? তাহলে কি আমি তার প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল? আসলে বিষয়টা সেরকম কিছু নয়। আসলে শুরুতেই বলেছি, আমি এই জাফর শাহর মানসিক গড়নটা বোঝার চেষ্টা করছি।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেসব আমার কাছে অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে। আমি আরও কিছু জানতে চাই। যোগাযোগ করলাম মিজানুর রহমান সবুজের সঙ্গে। বাংলাভিশন টিভিতে সবুজ দীর্ঘদিন, প্রায় এক দশক, আমার কলিগ ছিল। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়তো। অত্যন্ত মেধাবী এই ছেলে, দারুণ ভালো রেজাল্ট নিয়ে সাংবাদিকতার মতো অনিশ্চিত পেশায় কেন এলো– সেটা আমার কাছে আজও এক রহস্য। সবুজ জানালো, এই জাফর শাহ তার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। ২০০৪-২০০৫-এর দিকে এই শিক্ষকের অনেক ক্লাস তাকে করতে হয়েছে। তার মতে, এই শিক্ষককে তাদের কাছে কখনোই স্বাভাবিক মনে হয়নি। খুবই আনস্টেবল ছিলেন তিনি। পড়ানোর ক্ষেত্রে প্রায়ই ধারাবাহিকতা থাকতো না, খেই হারিয়ে ফেলতেন। ক্লাসে এসে এমন সব কথা বলতেন, যা অনেক সময়ই অপ্রাসঙ্গিক, এমনকি মাঝে মধ্যে হাস্যকর বলেও মনে হতো। সবুজ বলে, ‘স্যারের একটা বিষয় আমরা ভুলতে পারি না। উনি ক্লাসে ঢুকে একবার বললেন, ‘তোমরা কি জানো, আই অ্যাম এ ভিকি বয়?’ আসলেই আমরা জানতাম না ভিকি বয় বিষয়টা কী? আমরা অজ্ঞতা প্রকাশ করতেই উনি বেশ একটা বিজয়ীর ভঙ্গিতে জানালেন বিস্তারিত।”

সবুজ বলল, “তখনই আমরা প্রথম জানলাম একসময় ভিকারুননিসা স্কুলে সহশিক্ষা ছিল, মেয়েদের সঙ্গে ছেলেরাও পড়তো। জাফর শাহ স্যার তখন ভিকারুননিসা স্কুলে পড়েছেন। সেই কারণে তিনি ভিকি বয়!”

সবুজের কাছ থেকেই জানতে পারলাম, এই ভদ্রলোকের পারিবারিক জীবনও স্বাভাবিক ছিল না। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল, খুবই লোনলি ছিলেন। বনেদি পরিবারের এই লোকটি অনেকটা একাই সময় কাটাতেন। এই যে গণপিটুনি খেয়ে এখন তিনি হাসপাতালে রয়েছেন, বাসার কাজের বুয়া আর সিকিউরিটির একজন লোক ছাড়া আর কেউ নেই তার পাশে।

এর মাঝে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস পড়লাম, জনৈক শাহ মহিউদ্দিন শাহীনের স্ট্যাটাস। এই লোককেও আমি চিনি না। তিনি লিখেছেন, এই জাফর শাহকে তিনি চিনতেন। মতিঝিলে তাদের নাকি বিশাল একটা ভবন ছিল। নাম ছিল জেড শাহ হাউজ। তার বাবা জাহাঙ্গীর শাহ ছিলেন সেটার মালিক। সেই ভবনে মহিউদ্দিন শাহীনদের পারিবারিক ব্যবসায় ছিল, শা’দ রেস্তোরাঁ নামে একটা খাবারের দোকান ছিল। জাফর শাহকে তিনি অভিহিত করেছেন, ‘বনেদি, ধনাঢ্য এবং আপাদমস্তক ভদ্রলোক’ হিসেবে।

ঠিক এই জায়গাটিতে আমার প্রশ্ন। এমন একজন ‘আপাদমস্তক ভদ্রলোক’ এমন ভয়ংকর নিষ্ঠুর আচরণ করলেন কেন? প্রথম যখন তার গাড়ি মোটরসাইকেলটিকে আঘাত করে, তখনই তিনি থামলেন না কেন? আমরা যদি উন্নত কোনও দেশের কথা বিবেচনা করি, সেখানে এমন ঘটনা হলে গাড়িচালক কী করতেন? তিনি গাড়ি থামিয়ে নিজের গাড়িতেই আহত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। এই স্বাভাবিক মানবিক আচরণের বিষয়ে জাফর শাহ কি অবহিত ছিলেন না? না থাকার তো কোনও কারণ নেই। তাহলে তিনি সেরকম কিছু করলেন না কেন? কেন তিনি একজন নারীর মৃত্যুর কারণ হলেন? কেন তিনি নিজেকেও একজন হত্যাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন? উনি কি তাহলে মানসিকভাবে স্বাভাবিক ছিলেন না? উনি বুঝতে পারছিলেন না, কীভাবে কী হয়ে গেছে?

বিষয়টাকে বরং একটু ঘুরিয়ে বলি। ধরা যাক, উনি মানসিকভাবে খুবই স্ট্যাবল, খুবই ধীরস্থির ছিলেন। কিংবা ধরা যাক, ওই গাড়ির চালক আপনিই ছিলেন। এরকম পরিস্থিতিতে আপনি কী করতেন? আমি জানি আপনার মন বলতো, গাড়ি থেকে নেমে ভদ্রমহিলাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার কথা। কিন্তু এ দেশের বাস্তবতা আপনার জানা আছে। তারপরও ওই মানবিক আচরণটি করার সাহস কি পেতেন আপনি? গণপিটুনির প্রবল ভয় কি একবারের জন্যও আপনার মনে ভর করতো না? অথবা পুলিশি হয়রানির ভয়? উনি কি সেই ভয়ের কারণেই দ্রুত পালাতে চেয়েছিলেন?

এখানে অবধারিতভাবেই আর একটা প্রশ্ন এসে যায়। সেটা হলো, যেকোনও দুর্ঘটনা হলে, তারপর চালককে হাতেনাতে ধরতে পারলে গণপিটুনির বিষয়টি মোটামুটি অবধারিত হয়ে যায় কেন? আমাদের জনগণ কি আসলেই এতটা নিষ্ঠুর যে অ্যাক্সিডেন্টের পর চালককে ধরতে পারলে পিটিয়ে মেরে ফেলতে চায়? রাস্তায় যখন চলি, আশপাশের মানুষকে দেখে কিন্তু আমার কাছে তেমন দয়ামায়াহীন কখনোই মনে হয়নি। এই নিরীহ শান্ত মানুষটিই মাঝে মাঝে এতটা হৃদয়হীন হয়ে ওঠে কেন? আমার মনে হয়, মানুষের এই ক্রোধটা তাদের সহজাত নয়। এই সমাজ, সমাজের বিচারহীনতার সংস্কৃতি, তাকে এরকম অসহিষ্ণু করে তুলেছে। সে দেখেছে, অ্যাক্সিডেন্ট কিংবা এমনকি খুনের ঘটনার পরও প্রভাবশালী লোকেরা কী অবলীলায় ছাড় পেয়ে যায়। তাই তারা হয়তো ভাবে, পুলিশের কাছে গেলে কোনও সুবিচার আর হবে না। টাকা বা ক্ষমতার জোরে অপরাধী ছাড় পেয়ে যাবে। তাই সাজা যা দেওয়ার, হাতেনাতেই না হয় দেওয়া যাক।

প্রভাবশালীদের ছাড় পাওয়ার উদাহরণ কিন্তু বিরল কোনও বিষয় নয়। প্রচুর উদাহরণ দেওয়া যাবে। একটা মাত্র ঘটনার কথা বলি। এরশাদ আমলের কথা, আমি তখন মাত্রই সাংবাদিকতা পেশায় এসেছি। তখনই বাপী শাহরিয়ার আহত হন। ইনি ছিলেন খুবই প্রতিশ্রুতিশীল এবং প্রতিভাবান ছড়াকার। একদিন তিনি সাইকেলে করে যাচ্ছিলেন, পিছন থেকে একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন সেই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. এম এ মতিনের ছেলে। যতদূর মনে পড়ে, এই ছেলের নাম মুহিত। এবং সে সময় মুহিতের কোনও ড্রাইভিং লাইসেন্সও ছিল না। উনি শখ করে প্রধান সড়কে গাড়ি চালিয়ে সাইকেলচালক বাপী শাহরিয়ারকে মারাত্মক আহত করেন। বাপী শাহরিয়ারের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। দীর্ঘদিন তিনি বিছানায় পড়ে থাকেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে, তাই পিতার দাপটে পুত্রের আর কিছুই হয়নি। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। অপরাধীর সাজা হয়নি, ক্ষতিগ্রস্তের প্রতি সহযোগিতার হাতও বাড়ায়নি কেউ। প্রতিভাবান কবি সাহিত্যিকদের মতো বাপী শাহরিয়ারেরও আত্মসম্মান বোধ প্রবল ছিল, ছিল অভিমান। সমাজের এই অনাচারের প্রতিবাদ হিসাবে শেষ পর্যন্ত তিনি ওই অসুস্থ অবস্থাতেই আত্মহত্যা করেন। এটা ১৯৮৯-এর ঘটনা। কোনও উন্নত দেশে এমন ঘটনা হলে হয়তো ব্যাপক আলোড়ন হতো। কিন্তু আমাদের এই অসুস্থ সমাজে তেমন কিছু দেখা যায়নি।

হয়তো এসব দেখে-শুনেই সাধারণ মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। তাৎক্ষণিক বিচারে তাদের আগ্রহ বেড়ে যায়। এসবই আসলে একটা চক্রের মতো, একটা অনিয়মের পেছনে আর একটা অনিয়ম কাজ করে। পুলিশ যদি দুর্নীতিপরায়ণ না হতো, ক্ষমতা বা অর্থের প্রভাবে যদি অপরাধী ছাড়া না পেয়ে যেতো, বিচার যদি ঠিকঠাক মতো চলতো, তাহলে হয়তো গণপিটুনির দরকারই পড়তো না। আবার গণপিটুনির ভয় না থাকলে হয়তো দুর্ঘটনার পর চালক পালানোর চেষ্টা করতো না। হয়তো রুবিনা আক্তারের মতো অনেককেই এভাবে মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করতে হতো না।

শেষ করার আগে আর একটা কথা বলা জরুরি মনে করি। সবুজ আমাকে যে সময়ের কথা বললো, সেটা ১৭-১৮ বছর আগের। ভদ্রলোক তখন থেকেই অস্বাভাবিক। “আই অ্যাম এ ভিকি বয়”- বলে তিনি যখন ক্লাসের মধ্যেই নৃত্যের ভঙ্গি করেছেন, তার সহকর্মীরা কি তাকে তখন মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেছেন? সম্ভবত নেননি। বরং তার এই আচরণকে রসিয়ে রসিয়ে বলে আসর জমিয়েছেন। মানুষের জীবনে কার কখন কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, সেটা আগেভাগেই বলা যায় না। কোনও কারণে কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলে, পরিবারের সদস্য বা সহকর্মীরাই সেটা সবার আগে বুঝতে পারেন। তখন তাদের একটা দায়িত্ব থাকে, দায়িত্ব থাকে তাকে সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে সাহায্য করা। আমরা কি তা করি? করি না। আমরা বরং পরস্পরের সঙ্গে নির্লিপ্ত থাকার একটা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই ।

আমরা সবাই যেন কেমন বিচ্ছিন্ন মানুষে পরিণত হয়ে যাচ্ছি!          

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক