X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নীতি আর নেতা কি সমার্থক?

মাসুদ কামাল
০৬ নভেম্বর ২০২২, ২১:১৩আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২২, ২১:১৪

‘জনগণ খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া উভয়কেই গ্রহণ করেছে। আপনের প্যাক প্যাক করার দরকার নাই। বুঝেছি, জনগণ বিএনপির দিকে ঝুঁকে যাওয়াতে আপনার মাথা ঝিমঝিম করছে।’ এটা একজন পাঠকের মন্তব্য। আর এই যে “আপনি”—এটা হচ্ছি আমি। আমাকে লক্ষ্য করেই তিনি এই কথাগুলো বলেছেন।

গেলো সপ্তাহে বাংলা ট্রিবিউনে ‘মঞ্চে খালি চেয়ার ও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ এই শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। সেই লেখা থেকে কয়েকটা লাইন তুলে এনে বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক পেজে একটা স্ট্যাটাস দেওয়া হয়। স্ট্যাটাসের নিচে প্রথম কমেন্টে আমার লেখার লিংকটাও দেওয়া ছিল। সেই স্ট্যাটাসে পাঠকরা অনেক মন্তব্য করেছেন। বেশিরভাগই গালাগালি। গালাগালির ভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এতটাই অশ্রাব্য ও আপত্তিকর যে এখানে উদ্ধৃত করা সম্ভব নয়। ভাষাগতভাবে সবচেয়ে যেটি শোভন, সেটাই শুরুতে উল্লেখ করলাম।

আমার এই লেখাটি ছিল খুলনায় বিএনপির গণসমাবেশের পর। সেখানে মঞ্চে খালেদা জিয়ার জন্য একটি খালি চেয়ার রাখা হয়েছিল। এটাকে কেন্দ্র করে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা চেহারা আমি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি সে লেখায়। সেখানে বিএনপির কিছু কর্মকাণ্ড যেমন উল্লেখ করেছি, তেমনি আওয়ামী লীগের আচরণের কথাও বলেছি। লেখায় আমি সমালোচনা বিএনপির যতটা করেছি, তার চেয়ে কিছুমাত্র কম করিনি আওয়ামী লীগের। প্রধানমন্ত্রীর মানহানি বা তাকে অবমাননা করা হয়েছে বলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে মামলা হয়, সে বিষয়েও অসারতা নিয়েও লিখেছি। পুরো লেখাটা পড়লে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে যেতো। লেখার লিংকটা সেখানে দেওয়াও ছিল। কিন্তু অতটা কষ্ট করার ধৈর্য বোধকরি আমার সমালোচক পাঠকদের ছিল না। সম্ভবত কেবল স্ট্যাটাসটা পড়েই তারা হামলে পড়েছেন আমার ওপর। তারা ধরেই নিয়েছেন, আমি সরকার সমর্থক একজন ‘পেইড লেখক’। কেবল ধরে নিয়েই থামেননি, সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ মেরামত করারও চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ আমার মূল্যও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এই কাজটা তারা করেছেন যার যার কালচারাল স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী।

আমার এই মন্তব্যটা সম্ভবত একটু পরিবর্তন করতে হবে। আসলে এটা ‘কালচারাল স্ট্যান্ডার্ড’ হবে না। বলতে হবে—মন্তব্য করেছেন তারা যার যার পলিটিক্যাল কালচার অনুযায়ী। যে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নিয়ে আমি আসলেই উদ্বিগ্ন, এখন মনে হচ্ছে সেটির মাত্রা ও বিস্তৃতি বোধকরি আমার চিন্তার চেয়েও বেশি হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে আছে।  আমি ভেবেছিলাম, অন্ধ আনুগত্য বুঝি কেবল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এখন দেখা যাচ্ছে সেই অন্ধত্ব আরও অনেক দূর ছড়িয়ে গেছে। কর্মী অথবা সমর্থকরাও কোনও ভিন্নমত বা সমালোচনা সহ্য করতে পারছেন না।

বাংলা ভাষায় ‘দলকানা’ বলে একটা শব্দ রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে—দল যা বলবে সেটাকেই কানা’র মতো মেনে নেওয়া, কোনও প্রশ্ন না করে অনুসরণ করা। এই প্রবণতাকে আমার কাছে ততবেশি ক্ষতিকর বলে মনে হয় না। ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো তো এভাবেই চলে। কিন্তু সমস্যাটা হয়ে যায় তখন, যখন অন্ধ আনুগত্যটা দলের পরিবর্তে নেতার প্রতি হয়ে যায়। তখন নেতা আর দল হয়ে পড়ে সমার্থক! নেতাই দল, দলই নেতা। এ এক উদ্ভট সমীকরণ। দল মানে তো একটা সমষ্টি, আর নেতা হচ্ছে একটা একক অস্তিত্ব। একজন ব্যক্তি কীভাবে একটি সমষ্টির প্রতিশব্দ হতে পারে? কিন্তু আমাদের দেশের হচ্ছে তা-ই।

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেই দৃশ্যই দেখতে পাবেন। শেখ হাসিনা মানেই আওয়ামী লীগ, খালেদা জিয়া (অনুপস্থিতিতে তারেক রহমান) মানেই বিএনপি, জি এম কাদের (আগে এরশাদ) মানেই জাতীয় পার্টি। সন্দেহ নেই এরা সবাই সম্মানিত, সবাই প্রজ্ঞাবান। কিন্তু যতই প্রজ্ঞাবান হোন না কেন, তারা তো আর দলের সমার্থক হতে পারেন না।

এই যে ব্যক্তির প্রতি অন্ধ আনুগত্য, ব্যক্তির কাছে শর্তহীন আত্মসমর্পণ—এটা নিয়েই আমার উদ্বেগ। মানুষ মাত্রেই ভুল করতে পারে—এটা একটা স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত। কিন্তু আপনি যখন আপনার দলের শীর্ষ নেতার সব কথাই অন্ধের মতো মেনে নেবেন, যে প্রশ্ন করবে তার মুন্ডুপাত করার জন্য খড়গহস্ত হবেন, তখন বুঝতে হবে ওই স্বতঃসিদ্ধ নিয়মটি আপনি আর মানতে চাইছেন না। আপনার নেতাকে আপনি আর সাধারণ একজন মানুষ হিসাবে বিবেচনাই করতে চাইছেন না, বরং ভাবছেন তিনি ‘দেবতা’ কোনও।

আগের কথা বাদ দিন, ১৯৯১ সাল থেকেই যদি ধরি, আমাদের এই দেশটি বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের পরিচালনায় রয়েছে। আরও সোজা করে বললে শেখ হাসিনা অথবা বেগম খালেদা জিয়ার শাসনেই আছে। মাঝে অল্প কিছু সময় হয়তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর হাতে ছিল, কিন্তু সেই সময়টা উপেক্ষা করা যায়। ঘুরেফিরে এই দুই নেত্রীর কথাই বরং বলা যায়।

এখন আওয়ামী লীগের যেকোনও নেতাকে জিজ্ঞাসা করুন তো- ‘এই ৩১ বছরে শেখ হাসিনা কী কী ভুল করেছেন?’ কোনও জবাব পাবেন? বরং এমন প্রশ্ন করাকেই অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। একই জবাব পাবেন বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়ে তার দলের নেতাদের কাছ থেকে। আবার যদি উল্টোটা হয়? যদি বিএনপি নেতার কাছে শেখ হাসিনার ভুল বা অন্যায় সম্পর্কে জানতে চান, এত বিশাল এক ফিরিস্তি দেবেন, যেন তিনি মন্দ মানুষ। ঠিক হুবহু বিপরীত অভিমত পাওয়া যাবে আওয়ামী লীগ নেতার কাছে বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে। তাহলে অর্থটা কী দাঁড়াচ্ছে? নিজ দলের নেতা ‘অনেক ভালো’, আর বিপক্ষ দলের নেতা ‘মন্দ’!

তাহলে কি গত ৩১ বছর আমরা কখনও ভালো, অথবা কখনও মন্দ মানুষ দ্বারা শাসিত হয়েছি? কিন্তু এমনটা তো আমরা চাইনি। আমরা সাধারণ মানুষ চেয়েছি সরকার পরিচালনার জন্য আমাদের একজন মানুষ দরকার, যার মানবিক মূল্যবোধগুলো থাকবে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা কিংবা বেগম খালেদা জিয়াকে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করি। মনে করি ভালো বা মন্দ উভয়ের মধ্যেই রয়েছে। ভুল বা শুদ্ধ উভয়েই করে থাকেন। তাদের ভুলগুলো আমাদের ব্যথিত করে, শুদ্ধগুলো করে আনন্দিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা ভুল করলে দেশের ক্ষতি হয়, শুদ্ধ করলে হয় উন্নতি। এই মনোভাবটা যখন দলের সব স্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে থাকবে, যখন তারা এটা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে পারবে, তখন বলা যাবে যে দলে গণতন্ত্র আছে। আর দলে গণতন্ত্র না থাকলে দেশে কীভাবে থাকবে?

এবার ওই চেয়ার প্রসঙ্গে বলি। মঞ্চে একটা খালি চেয়ার রাখার এই যে মানসিকতা, এটাকে আমার কাছে কিছুটা পৌত্তলিকতা বলে মনে হয়। উনি সভায় নেই তো, নেই। এটা বাস্তবতা। খালি চেয়ার রেখে সেটাকে বোঝাতে হবে? এই যে প্রতীক হিসেবে কোনও কিছু সবার সামনে উপস্থাপন করা, এটাই তো আপত্তিকর। পৌরাণিক কাহিনি রামায়ণের কথা আমরা জানি। রামকে যখন বনবাসে পাঠানো হলো, তার ছোট ভাই ভরত খালি সিংহাসনে রামের খড়ম রাখলো। আর নিজে সিংহাসনের নিচে বসে রাজত্ব চালাতে লাগলো। উনি বোঝাতে চাইলেন- ‘এই সিংহাসন বড় ভাই রামের, আমি সেখানে বসতে পারি না। রামের অনুপস্থিতিতে সেখানে তার খড়ম থাকবে। আর আমি নিচে বসে রাজত্ব চালাবো।’  

আধুনিক এই সময়ে পৌরাণিক ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার পক্ষে আমি নই। এই মানসিকতা আমার কাছে আপত্তিকর বলেই মনে হয়।

আগের ওই লেখায় আমি আশঙ্কা করেছিলাম, আগামীতে হয়তো চেয়ারের সংখ্যা বাড়বে, চেয়ারের শানশওকত বাড়বে। আমার সে আশঙ্কা ফলতে শুরু করেছে। খুলনা, রংপুরের পর বরিশালের গণসমাবেশে দুটি খালি চেয়ার দেখা গেছে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জন্য প্রতীকী দুই চেয়ার। আমি নিশ্চিত এই খালি চেয়ার সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারবো না। নেত্রী বা নেতার অনুপস্থিতি উপলব্ধির জন্য আমাদের এখন থেকে প্রতীকী কিছু একটা দরকার হতেই থাকবে।

ফেসবুকের যেসব পাঠক আমার সমালোচনা করেছেন, আমাকে গালাগাল করেছেন, তাদের সেন্টিমেন্টকে আমি কিন্তু অশ্রদ্ধা করি না। তারা তাদের নেত্রীকে ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে জনসভার মঞ্চে একটা খালি চেয়ার রাখা হয়েছে। সেই চেয়ার রাখাটা যৌক্তিক হয়েছে কী হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন করাটাই তাদের কাছে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তাদের কাছে মনে হয়েছে, এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করার অর্থ নেত্রীকে অপমান করা। সে কারণেই তারা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। আমি তো তাদের নেত্রীর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে আপত্তি করিনি। আমার প্রশ্নটা ছিল ভালোবাসা প্রকাশের পদ্ধতি নিয়ে। আপনি শ্রদ্ধা করুন, ভালোবাসুন, কিন্তু দয়া করে আবেগী হবেন না। আমরা অনেক সময় আবেগের তোড়ে শ্রদ্ধেয় কোনও ব্যক্তিকে ‘পরম পূজনীয়’ বলে অভিহিত করে ফেলি। এই পূজাটা বড় বিপজ্জনক। আর পূজার সঙ্গে যদি একটা প্রতীক যোগ হয়ে যায়, তাহলে তো ভয়ংকর।

যে কথাটা বলে শেষ করতে চাই সেটা হলো রাজনীতি নিয়ে। রাজনীতি শব্দটির মধ্যে একটা ‘নীতি’ আছে। তাই ভালোবাসা বলুন, শ্রদ্ধা বলুন, সমালোচনা বলুন, এমনকি ঘৃণা বলুন- সবই হতে হবে ওই নীতিকে কেন্দ্র করে। নেতার কথাই নীতি হতে পারে না। নীতির ধারকই বরং নেতা হয়ে থাকেন। ‘নীতি’ আর ‘নেতা’কে সমার্থক করে ফেললেই যত বিপদ। আমাদের সরকারি কিংবা বিরোধী দল বোধকরি এখন সেই বিপদের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান পরিদর্শন করে ভুটানের রাজার সন্তোষ প্রকাশ
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
ট্যুর অপারেশনে ব্যাংকে থাকতে হবে ১০ লাখ টাকা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ