X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

মঞ্চে খালি চেয়ার ও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

মাসুদ কামাল
২৬ অক্টোবর ২০২২, ১৭:১৫আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২২, ১৭:১৫

একটা খালি চেয়ার। তার ওপর তোয়ালে বিছানো। বিশাল জনসমাগম, সামনে সাজানো গোছানো মঞ্চ। সেই মঞ্চের ওপর সারি সারি চেয়ার, নেতারা বসে আছেন। আর এই সারির ঠিক মাঝে সেই খালি চেয়ারটি। এরকম দৃশ্য দেখা গেছে বিএনপির দুটি গণসমাবেশে। ময়মনসিংহে এবং খুলনায়।

রাজনৈতিক দলের সমাবেশ মঞ্চে প্রায়ই জায়গার খুব টানাটানি পড়ে। শীর্ষ নেতা, মাঝারি নেতা, পাতি নেতা—সবাই মঞ্চে উঠতে চান। মঞ্চে ওঠা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি হয়, ধমকাধমকি হয়। ধমক দিয়ে অনেককে নামিয়ে দেওয়া হয়, ধাক্কা সামলাতে না পেরে অনেকে আবার মঞ্চ থেকে নিচে পড়েও যান। এমন দৃশ্য আমি নিজেই বহুবার দেখেছি। এই যে এমন জায়গার সংকট, এরই মধ্যে একটা খালি চেয়ার বসিয়ে রাখাকে তো রীতিমতো বিলাসিতাই বলা যায়। কিন্তু ওই দুই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সঙ্গে, কিংবা বিএনপির যেকোনও পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা কিন্তু বিষয়টিকে অতটা হালকাভাবে নেবেন না। এমনই একজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কদিন আগে এক টেলিভিশন টকশোতে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রসঙ্গটি উঠেছিল। তিনি সেখানে যা বললেন তার মর্মার্থ হচ্ছে—চেয়ারটি রাখা হয়েছিল প্রতীকী অর্থে। বেগম খালেদা জিয়ার জন্য নির্ধারিত ছিল চেয়ারটি। বিএনপির মূলনেতা হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু তিনি অন্তরীণ থাকায় সশরীরে সমাবেশে থাকতে পারছেন না। সে কারণেই ওনার জন্য নির্ধারিত চেয়ারটি মঞ্চে খালি অবস্থায় থাকছে।

ব্যাখ্যাটি শুনতে ভালোই শোনায়। নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর আনুগত্যে ভরপুর। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এই ব্যাখ্যা, কিংবা ব্যাখ্যার পেছনের মানসিকতা- কোনোটিই আমার পছন্দ নয়। কেন পছন্দ নয় সেই আলোচনার আগে বরং আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। ময়মনসিংহে এবং খুলনায় মঞ্চে খালি চেয়ার রাখা হয়েছিল, তাহলে চট্টগ্রামে কেন রাখা হলো না? খালেদা জিয়া তো অনেক দিন ধরেই অন্তরীণ, এই সময়ে বিএনপির অনেক সমাবেশও হয়েছে, সেসব সমাবেশের মঞ্চেও কি খালেদা জিয়ার জন্য খালি চেয়ার রাখা হয়েছিল? বিএনপি এখন কার সিদ্ধান্তে বা দিকনির্দেশনায় চলে, খালেদা জিয়ার নাকি তারেক রহমানের?

খালেদা জিয়াই যদি সিদ্ধান্ত দেবেন, তাহলে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানানোর দরকারটা কি ছিল? বিভিন্ন সময় মিডিয়াতে দেখি, দলের শীর্ষ পর্যায়ের মিটিংগুলোতে তারেক রহমান লন্ডন থেকে স্কাইপে যুক্ত হন। এমনকি ২০১৮ সালের যে সংসদ নির্বাচন হলো, সেখানে যে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, সেটাও তো হয়েছে তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে। দলে যিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন তিনিই তো নেতা- নাকি? তাহলে সভামঞ্চে খালি চেয়ার একটা কেন? দুটি থাকতে পারতো। কিন্তু সেটা হয়নি। চেয়ার একটিই ছিল, এবং যাতে কারও মনে কোনও দ্বিধার সৃষ্টি না হয় সেজন্য সেখানে বেগম খালেদা জিয়ার নামটি বেশ বড় করেই লেখা ছিল। তাহলে কি চেয়ারটি রাখা হয়েছিল যতটা না নেতার জন্য তারচেয়েও বেশি ভক্তি ও ভালোবাসার জন্য? সেটাও যদি হয়, তবু কিন্তু ব্যাখ্যাটা পরিপূর্ণতা লাভ করে না। তখন আবার প্রশ্ন ওঠে—এই দুটি গণসমাবেশের আগে কি খালেদা জিয়ার প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা ছিল না?

এই যে প্রশ্নগুলো, এসবের উত্তর পাওয়া আসলে কঠিন। জবাব যে নেই তা নয়, তবে সেটা প্রকাশ্যে উচ্চারণ যে করবেন তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমি নিশ্চিত, বিএনপিতে এমন অনেক নেতা আছেন যারা এই খালি চেয়ার মঞ্চে বসিয়ে রাখাকে পছন্দ করেননি। কিন্তু তারা সেটা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে পারবেন না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে আমার যতটুকু ধারণা আছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে একথাও বলতে পারি, এই চেয়ার রাখার সিদ্ধান্তটি কেন্দ্রীয়ভাবে আসেনি। হুট করেই কেউ একজন প্রস্তাব করে বসেছেন, তারপরই সেটা বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। আমার এটাও মনে হয়, আগামীতে এই ‘খালি চেয়ার’ সংস্কৃতি চলতে থাকবে। কেবল চলতেই থাকবে না, সেই সঙ্গে চেয়ারের শান-শওকত বাড়তে থাকবে। খুব দামি একটা চেয়ার বসানো হবে, সেটাকে হয়তো সাজানো হবে, তারপর হয়তো চেয়ারটিকে একই সারিতে না রেখে একধাপ এগিয়ে রাখা হবে।

ওই যে বললাম, ‘বিএনপির মধ্যেই অনেক নেতা ছিলেন যারা এই খালি চেয়ার রাখাকে পছন্দ করেননি,’ সেটা শুনে কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন—তাহলে তারা প্রতিবাদ করেননি কেন? এরও দায় সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই। আমাদের দেশে এই ধারাটা এখন প্রবলভাবে চালু হয়ে গেছে। আমরা মনে করি– আমাদের শীর্ষ নেতানেত্রীরা আসলে মানুষই নন কোনও। তারা অনেকটা ‘ফেরেশতা’র মতো। তাদের কোনও দোষ নেই, ভুল নেই। বিএনপির যেকোনও নেতাকে জিজ্ঞাসা করুন, খালেদা জিয়া তো অনেক বছর ধরে দলীয় প্রধান, তিনবার সরকারপ্রধানও ছিলেন, এই দীর্ঘ সময়ে ওনার প্রধান প্রধান ভুলগুলো কী কী? প্রশ্নটি শোনা মাত্র প্রথমে তিনি দাঁতে জিভ কামড় দেবেন, যেন এমন একটি প্রশ্ন শোনাই তার জন্য বিশাল অপরাধ হয়ে গেছে। তারপর বলবেন, ওনার কোনোই দোষ বা ভুল নেই। একই অবস্থা কিন্তু বিপরীত দিকেও। আওয়ামী লীগের কোনও নেতা বা কর্মীকে বলুন, তিনিও শেখ হাসিনার কোনও দোষ বা ভুল খুঁজে পাবেন না।

এই যে একরৈখিক চিন্তা এটা কিন্তু দলের নেতাকর্মীরা জন্মগতভাবেই প্রাপ্ত হয়নি। ক্রমাগত আনুগত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে এটা তাদের অর্জন করতে হয়েছে। বাড়তে বাড়তে এটা এখন মারাত্মক একটা পর্যায়ে চলে গেছে। এতটাই বিপজ্জনক পর্যায়ে যে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে এর কারণে যৌক্তিক চিন্তাগুলো পর্যন্ত মার খেয়ে যাচ্ছে, প্রকাশিত হতে পারছে না। এর একটা উদাহরণ এরইমধ্যে দেওয়া হয়েছে। ওই যে চেয়ারটি মঞ্চে বসানো হলো, হয়তো অনেকে বিষয়টিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে মুখ ফুটে বলতে পারেননি। কারণ, আপত্তির কথাটি উচ্চারণ করা মাত্রই, এমন আশঙ্কা রয়েছে কেউ না কেউ বলে বসবেন- তাহলে কি আপনি খালেদা জিয়াকে নেতা মানেন না? অথবা বলবেন—আমাদের নেত্রীর প্রতি আপনার কোনোই মায়া মমতা বা ভালোবাসা নেই? তারপর হয়তো এই কথাগুলো বিবর্তিত হতে হতে অনেকটা বিকৃত হয়ে একপর্যায়ে শীর্ষ নেতৃত্বের কানে পৌঁছাবে। আর যেহেতু শীর্ষ নেতৃত্বের হাতেই সকল ক্ষমতা, কোনও কাজেই তাকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয় না, তাই মুহূর্তেই তিনি দল থেকে ‘নাই’ হয়ে যেতে পারেন।

আর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে বিপরীত দিক থেকে, অর্থাৎ সরকারি দল থেকে। আমরা প্রায়ই শুনি ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ার কারণে বিভিন্নজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ধরনের খবর দেখলে আমরা আমজনতারা সাধারণত প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাই। এ নিয়ে ডিটেইলে কথা বলতে চাই না। অথচ, আমাদের মনে কি এমন প্রশ্ন একেবারেই জাগে না, কী এমন অবমাননাকর কথা লেখা হয়েছিল সেই পোস্টে? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনেকের মনেই প্রশ্নটি আসে। কিন্তু উটকো ঝামেলা এড়াতে আমরা সেটাকে এড়িয়ে যাই।

আচ্ছা, এই উটকো ঝামেলার কথাটি আসছে কেন? আসছে আসলে ভীতি থেকে, অথবা অপর পক্ষের মাত্রাতিরিক্ত ভক্তি থেকে। অনেকে এটাকে আবার নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির উপকরণ হিসাবেও ব্যবহার করছে। রাজবাড়ির সেই মহিলা সমাজকর্মী সোনিয়া আক্তার স্মৃতির কথাই ধরা যাক। তিনি নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনও একটি বক্তব্যের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। এতে নাকি প্রধানমন্ত্রীর ‘সুনাম ক্ষুণ্ণ ও মানহানি হয়েছে’। তাই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এই মামলার বাদী কে? রাজবাড়ি সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সামসুল আরেফিন চৌধুরী প্রথমে এ বিষয়ে থানায় একটি অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগটিকে পুলিশ মামলা হিসাবে গ্রহণ করেন, সোনিয়া আক্তার স্মৃতিকে গ্রেফতার করেন। এখানে লক্ষণীয়, যার ‘সুনাম ক্ষুণ্ণ ও মানহানি’ হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে তিনি কিন্তু মামলা করেননি। তাঁর দলের কেন্দ্রীয়, জেলা বা উপজেলা পর্যায় থেকেও আপত্তি ওঠেনি। আপত্তি তুলেছেন ইউনিয়ন পর্যায়ের একজন মাঝারি সারির নেতা। সেটাও আবার সোনিয়া আক্তার স্মৃতির পোস্ট দেওয়ার মাসাধিককাল পরে। এতদিন কারই চোখে পড়েনি, একমাস পর ওনার চোখে পড়ার পর উনি অভিযোগ করেছেন। অর্থাৎ পোস্টটি সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার একমাস পর ইউনিয়ন পর্যায়ের ওই লোকটির মনে হয়েছে, আরে এটা তো নেত্রীর জন্য বিরাট অপমানজনক! আর তাতেই স্মৃতির অবস্থা কাহিল। তাকে জেলের ভাত খেতে হচ্ছে।

কাকতালীয়ভাবে ওই পোস্টটি আমার চোখে পড়েছে। আমিও দু-তিন জনকে দেখিয়েছি। তারা কেউ আমাকে নিশ্চিত করতে পারেননি মানহানিটা হলো কোথায়? তাহলে অভিযোগের পরপরই এত দ্রুত অ্যাকশনের কারণটাই বা কী? কারণ একটাই, ওই যে শুরুতে বলেছিলাম- পলিটিক্যাল কালচার। আমাদের কালচারটাই এমন হয়ে গেছে, কেউ যদি একবার উচ্চারণ করে বসেন- এতে আমার নেত্রীর অপমান হয়েছে, তখন বাকিদের আপত্তি করার কোনও উপায় থাকে না। বরং তখন সবচেয়ে নিরাপদ পথ হচ্ছে- ওই হুজুগের সঙ্গে তাল মেলানো। ভাবুন তো একবার, সামসুল আরেফিন চৌধুরী যখন অভিযোগটি নিয়ে থানায় গেলেন, পুলিশ কি জানতে চাইতে পারতেন না, এখানে মানহানি কীভাবে হলো? সেটা পুলিশ পারেনি এ কারণে যে তখন এমন হুজুগ ওঠার আশঙ্কা ছিল যে, ‘প্রধানমন্ত্রীর মানহানি হয়েছে, কিন্তু পুলিশ সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি!’ আর তারপর খোঁজ পড়তো- এই পুলিশ কবে ছাত্রদল করতো, কিংবা তার পরিবারের কে কে বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত—সে সবের।

এই যে ঘটনাগুলো ঘটে, এত বদনাম হয় কার? যার নামে এসব কাজ করা হয়, তিনি হয়তো কিছুই জানেন না, কিন্তু বদনামটা তারই হয়। ময়মনসিংহে ও খুলনায় মঞ্চে খালি চেয়ার রাখতে কি খালেদা জিয়া বলেছিলেন? নাকি তারেক রহমান বলেছেন? কিন্তু সমালোচকরা ঠিকই বলবেন, মা-ছেলে তাদের নেতৃত্ব নিয়ে এতটাই আতঙ্কে থাকেন যে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে মঞ্চে খালি চেয়ার রাখতে বাধ্য করেন! অথবা ওই মানহানির মামলা নিয়ে বলা হবে, প্রধানমন্ত্রী মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও আসলে এতটাই অসহিষ্ণু যে সামান্য সমালোচনাও সহ্য করতে পারেন না!

অতিভক্তির এই সংস্কৃতিটা মনে হয় পাল্টানো দরকার। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? আমাদের রাজনীতিটা এখন হয়ে গেছে নেতা বা নেত্রী কেন্দ্রিক, নীতিনির্ভর নয়। নীতিনির্ভর হলে কিন্তু যেকোনও বিষয়ে নির্ভয়ে প্রশ্ন করার, সমালোচনা করার প্র্যাকটিসটা থাকতে পারতো। সেই প্র্যাকটিসটা চালু না করতে পারলে দেশটাকে গণতান্ত্রিকই বা বলা যাবে কীভাবে?  

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কুড়িগ্রামে এক বছরে আইনি সহায়তা পেয়েছেন ২২০ জন, অধিকাংশই নারী
কুড়িগ্রামে এক বছরে আইনি সহায়তা পেয়েছেন ২২০ জন, অধিকাংশই নারী
আইপি টিভি চালু করতে চায় ডিএমপি!
আইপি টিভি চালু করতে চায় ডিএমপি!
কাটাখালী পৌরসভায় উপনির্বাচনে মেয়র হলেন মিতু
কাটাখালী পৌরসভায় উপনির্বাচনে মেয়র হলেন মিতু
ঢাকায় পা রেখে চট্টগ্রামে উড়াল দিলো জিম্বাবুয়ে
ঢাকায় পা রেখে চট্টগ্রামে উড়াল দিলো জিম্বাবুয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ