বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নে অনুবাদের কোনও বিকল্প নেই

কয়েক দিন আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক ও চিন্তাবিদদের দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম বৃহৎ মিলন মেলা ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’র দশম আসর শেষ হলো। এই চারদিন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছিল সাহিত্যপ্রেমীদের অন্যতম এক গন্তব্য। তাদের পদচারণায় মুখর ছিল পুরো প্রাঙ্গণ। এই চারদিনে ১৭৫টি সেশনে অংশ নেন শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার পাঁচ মহাদেশের ৫ শতাধিক বক্তা।

আমি সশরীরে সেখানে উপস্থিত থাকতে না পারলেও প্রতি মুহূর্তেই মনে হয়েছে আমি নিজে যেন এই আয়োজনের অংশ। নিজের দেশে এত বড় একটা আয়োজন সত্যিকার অর্থেই অনেক গর্বের, গৌরবের। পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন চোখ রেখেছি কবে কোন আলোচনা হয়েছে সেগুলো জানার জন্য। সারা পৃথিবী থেকে আগত জ্ঞানী গুণী মনীষীদের বিদগ্ধ আলোচনা সামনে থেকে শুনতে না পারলেও কিছুটা তার আস্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করেছি।

লিট ফেস্টের একটি সেশনের শিরোনাম ছিল ‘অনুবাদ: সাহিত্যের ছায়া’। এই আলোচনায় বিদগ্ধ আলোচকগণ সাহিত্য অনুবাদের ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো তুলে ধরেছেন, অনেকে অনুবাদকে একটা আলাদা সাহিত্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। সত্যিকার অর্থেই, আমাদের অনুবাদ সম্ভব কিনা দার্শনিকগণ অনেক দিন ধরেই সেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনুবাদ আক্ষরিক হবে নাকি ভাবানুবাদ হবে সে বিষয়েও রয়েছে এক বড় বিতর্ক। কারণ, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে একজন লেখক যা বলতে চেয়েছেন সেটার মর্মার্থ অনেক সময় পরিবর্তিত হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই লেখকের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ অতি সরলীকরণ কিংবা অতিরঞ্জিত হয়ে যায়, ফলে অনূদিত লেখা নিজেই এক সাহিত্যকর্ম হয়ে ওঠে। সুতরাং, অনূদিত গ্রন্থ এবং মূল গ্রন্থের মধ্যে সাহিত্য মান বিচারে কোনটি এগিয়ে তা নিয়েও তৈরি হয় এক নতুন দ্বন্দ্ব।

অন্যদিকে দেখলাম অনেকেই কিছুটা খেদ প্রকাশ করেছেন এই আয়োজনে কেন ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, আমাদের মাতৃভাষাকে এর মাধ্যমে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ইত্যাদি। আমি মনে করি, ঢাকা লিট ফেস্টের মতো একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আয়োজন ইংরেজি হওয়াই যথার্থ, এবং যত বেশি সংখ্যক সেশন ইংরেজিতে আয়োজন করা যাবে আমাদের জন্য তত বেশি মঙ্গলজনক হবে। আমার মতে, সাহিত্যের নিজস্ব কোনও ভাষা নেই। একজন লেখক যেই ভাষায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সেই ভাষায় তিনি তার গল্প, কবিতা কিংবা তার সাহিত্যকর্ম তুলে ধরেন। কারণ, তাঁর জন্য মনের ভাব, আবেগ, অনুভূতি প্রকাশের জন্য তাঁর নিজস্ব ভাষা সবচেয়ে বেশি সহযোগী। কিন্তু তাই বলে আমি কি চিন্তা করছি সেটা কি কেবল আমার নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে? কখনোই নয়। একজন লেখক যখন লিখেন তিনি আশা করেন তাঁর লেখা সর্বোচ্চ সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে। যত বেশি পাঠকের কাছে নিজের অনুভূতিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, একটি লেখা কোনও এক বিশেষ বিচারে তত বেশি সার্থক। অতএব, বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে অনুবাদের কোনও বিকল্প নেই। কেননা, এখন বিশ্বায়নের যুগ। এই যুগে আমার হাতের মোবাইল ডিভাইস থেকে শুরু করে আমার ব্যবহৃত জুতা স্যান্ডেলের কোনোটিই আর নিজের দেশের সীমানায় সীমাবদ্ধ নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে এক মিথস্ক্রিয়া।

আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি অন্যের দ্বারা, নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারছি কোনও কোনও ক্ষেত্রে। আর এটাই জ্ঞানের সৌন্দর্য। সাহিত্যও জ্ঞানের এক শাখা। তাই সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই মিথস্ক্রিয়া খুব জরুরি। আর এর একমাত্র উপায় হলো ইংরেজি ভাষা রপ্ত করা, ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা এবং ইংরেজিতে সাহিত্যের আলোচনা করা।

পাশ্চাত্য দর্শনের সূচনা গ্রিসে হলেও জার্মান দার্শনিকগণ দর্শনের এক বিশাল জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করে আছে। উইলহেল্ম ফ্রেড্রিক হেগেল, ইমানুয়েল কান্ট কিংবা গটলব ফ্রেগের দর্শন সমগ্র পৃথিবীতেই পড়া হয়। জার্মানদের নিজস্ব ভাষা ইংরেজি না হওয়া সত্ত্বেও তারা কীভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করে আছে? কারণ, তারা জাতি হিসেবে খুবই আধুনিক। কানাডার প্রথম সারির দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনা করার সুযোগ হয়েছে। আমি দেখেছি এখানে জার্মানরা কেবল শিক্ষক হিসেবেই নয়, বরং ছাত্র হিসেবেও অন্যদের থেকে এগিয়ে। এর মূল কারণ তারা ইংরেজি ভাষায় ভালো। প্রথম দিকে জার্মানরা নিজেরা হেগেল কিংবা কান্টের দর্শন অনুবাদ করেছেন। ইউরোপ আমেরিকার অন্যান্য দেশ যখন এর আস্বাদ পেয়েছে তখন তারা আরও বেশি করে জার্মান দার্শনিকদের দর্শন জানতে চেয়েছে। কিছু দিন আগে একজন কানাডিয়ান অধ্যাপকের ক্লাস করছিলাম। তিনি বললেন, কান্টের একটি বই অনুবাদ করার জন্য তিনি জার্মান ভাষা শিখেছেন। অর্থাৎ, একটি জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে কতটা সমৃদ্ধ সেটা বোঝানোর জন্য অনুবাদ এক শক্তিশালী মাধ্যম। এবং জ্ঞানের যেকোনও শাখায় নেতৃত্ব দিতে হলে প্রথমে নিজের সেই জ্ঞানকে অন্যের কাছে তুলে ধরতে হবে।

বাংলা ভাষাকে ইউনেস্কো সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। বাংলা সাহিত্য মান বিচারে অনেক সমৃদ্ধ। সমৃদ্ধ হয়েও বাংলাদেশ এখনও বুকার পুরস্কার ঘরে আনতে পারেনি, আমাদের ঝুলিতে আসেনি সাহিত্যের নোবেল। আমরা প্রতি বছর অপেক্ষা করি কোন দেশের লেখক সাহিত্যে নোবেল পেলো সেটা দেখার জন্য। দক্ষিণ এশিয়ায় এই পুরস্কার এলে আমরা শান্তির ঢেঁকুর তুলি। ঠিক যেন আমাদের সক্ষমতা নেই, তাই প্রতিবেশীর সুখেই নিজের সুখ।

আমাদের আসলেই কি সক্ষমতা নেই? নাকি আমরা আমাদের সক্ষমতাকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছি?  

আমির খান অভিনীত ‘লাগান’ চলচ্চিত্রের একটা দৃশ্য খুব মনে পড়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক অফিসার গ্রামের সাধারণ কৃষকদের এক শর্ত দেন, যদি তারা ক্রিকেট খেলায় অফিসারদের হারাতে পারে তবে লাগান বা খাজনা মওকুফ হয়ে যাবে। আর যদি না হারাতে পারে তবে তিনগুণ খাজনা দিতে হবে। কৃষকরা রাজার কাছে আসেন এই শর্ত শিথিল করা যায় কিনা সেই আর্জি নিয়ে। রাজা তাদের খুব দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘উনকো খেল শিখো’। অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কৃষকেরা ক্রিকেট খেলা শিখে এবং খেলায় জয়লাভ করে। ক্রিকেট কিংবা ফুটবল এই ভারতবর্ষের খেলা নয়। তথাপি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশ্ব ক্রিকেটের বড় জায়গা দখল করে আছে। আমাদের নারী ফুটবল টিমের জন্য বাংলাদেশ আজ সেরা। ক্রিকেট এবং ফুটবলে আমরা কীভাবে সাফল্য অর্জন করেছি? আমরা আগে কৌশল শিখেছি, খেলা শিখেছি। তারপর চেষ্টা এবং একাগ্রতা দ্বারা সেই লক্ষ্যে পৌঁছেছি। আমরা এখন বিশ্বকাপ জয় করার স্বপ্ন দেখছি।  

বড়দের কাছে একটা গল্প প্রায়ই শুনি। সেটি হলো ব্রিটিশরা প্রথম দিকে বিনামূল্যে চা খাইয়ে ভারতবর্ষে চা উৎপাদন এবং তাঁর বহুল প্রসার ঘটিয়েছে। এখন আমরা চা কিনে খাই, বাঙালির নিত্যদিনের আয়োজনে চা এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। একইভাবে, আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এরকম একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা দরকার। দরকার একটা পরিকল্পনা; স্বল্পমেয়াদি নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। আগামী ৫ বা ১০ বছরের মধ্যে সব ভালো সাহিত্যকর্ম ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা হবে, সেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় শহর থেকে প্রকাশ করা হবে।

লিট ফেস্টের মতো সাহিত্যে সম্মেলন আয়োজনের পাশাপাশি আমাদের লেখকদের অন্যান্য দেশে আয়োজিত এই ধরনের আসরে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় অর্থমূল্য জোগানের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে আমাদের লেখকদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রকৃতি এবং জীবন-জীবিকা সম্পর্কে সম্যক ধারণা তৈরি হবে, তাদের লেখনীর মাধ্যমে সেগুলো উঠে আসবে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকেরা সেগুলো পড়ে নিজেদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করবেন।

মূল কথা হলো, আপনি যদি কোনও পরিবর্তন আনতে চান তবে আপনাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। নেতৃত্ব এমনি এমনি আসে না। কোনও বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়, ধাপে ধাপে সেই চূড়ায় পৌঁছাতে হয়। তাই বিশ্ব সাহিত্যে নেতৃত্ব দিতে হলে দরকার আমাদের সাহিত্যকে বোতলবন্দি না করে বরং তার ঢাকনাটা খুলে উন্মুক্ত করে দেওয়া, যাতে তা প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে বাংলা সাহিত্যের পরাগরেণু ছড়িয়ে দিতে পারে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা, এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা।

ইমেইল: nsultana00ju@juniv.edu