X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

সমাবর্তনে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের বিষয়টি কেন বিবেচনা করা হয় না?

নাসরীন সুলতানা
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:২৮আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২১:১৪

বলতে গেলে এখন দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাবর্তনের মৌসুম চলছে। পর পর কয়েক দিনের ব্যবধানে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে অনুষ্ঠিত হলো গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষাজীবনের পরিশ্রমের ফসল সনদ প্রাপ্তির অনুষ্ঠান সমাবর্তন। ২৫ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ষষ্ঠ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সমাবর্তন প্রাপ্তি যেমন একজন গ্র্যাজুয়েটের অধিকার তেমনই সমাবর্তন আয়োজনের মধ্য দিয়ে গ্র্যাজুয়েটদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারাটাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য গৌরবের। শিক্ষাজীবন শেষে প্রতিটি গ্র্যাজুয়েট এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে। গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে সমাবর্তন নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে সমাবর্তন নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ এবং উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে।

সমাবর্তনে অংশগ্রহণের অন্যতম এক আকর্ষণ হলো গ্র্যাজুয়েটদের জন্য বরাদ্দকৃত গাউন এবং ট্যাসেল সংবলিত হ্যাট। এই গাউন এবং হ্যাট পরা গ্র্যাজুয়েটদের প্রতিটি অনুষদের ডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির সামনে উপস্থাপন করবেন। গ্র্যাজুয়েটগণ একই পোশাকে দাঁড়িয়ে নিজেরা সনদের জন্য উপস্থাপিত হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাদের ডিগ্রি প্রদান করবেন। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি প্রাপ্তি তথা সমাবর্তনে অংশগ্রহণের অন্যতম নিয়ামক হলো এই গাউন এবং হ্যাট। বলতে গেলে একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবনের ৪-৫ বছর অপেক্ষা করে এই একটি কালো রঙের পোশাক পরিধান করার জন্য। রাতের পর রাত নির্ঘুম রাতযাপন কিংবা সকালের নাশতা উপেক্ষা করে ক্লাস ধরা, দুপুরের খাবার বর্জন করে পরীক্ষা দেওয়ার মতো ত্যাগ স্বীকার করে এই বিশেষ পোশাক গায়ে জড়ানোর জন্য। কিন্তু তার দীর্ঘ ৫-৬ বছরের অপেক্ষা যদি হতাশায় রূপ নেয় তবে সেটা যেমন গ্র্যাজুয়েটের জন্য অসম্মানের, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও লজ্জাকর বৈকি।

এত কিছু থাকতে হঠাৎ কেন গাউন নিয়ে কথা বলছি সে বিষয়টি খুলে বলি। হঠাৎ কাল আমার ফেসবুকের নিউজফিডে চোখে পড়লো আমাদের এক প্রাক্তন ছাত্রের স্ট্যাটাস। সে দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস করেছে। সে একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী। সমাবর্তনে আর সবার মতো সে নিজেও রেজিস্ট্রেশন করেছে। নিয়ম মতো গাউন এবং হ্যাট সংগ্রহ করেছে। কিন্তু যখন সেই গাউনের প্যাকেট খুলেছে তখন দেখা যায় সেটি তার শরীরের জন্য একেবারে বেমানান। সে আক্ষেপ করে লিখেছে- “সেই গাউনে তার মতো ৩-৪ জনকে ঢোকানো যাবে”। কিন্তু সে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও তার মনে কোনও প্রতিবন্ধিত্ব নেই। সেও আর দশ জন গ্র্যাজুয়েটের মতোই কষ্ট করে রাত জেগে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। তারও পূর্ণ অধিকার আছে গায়ে কালো কাপড়ের গাউন এবং মাথায় হ্যাট পরে অনুষদের ডিনের আদেশক্রমে চ্যান্সেলর এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির সামনে ডিগ্রির জন্য নিজেকে উপস্থাপন করার। তার মনেও অনেক দিন ধরে এই পোশাকের জন্য স্বপ্ন লালিত হয়েছে।

আমি গর্ববোধ করি এই গ্র্যাজুয়েটকে ক্লাসরুমে শিক্ষা দিয়েছি বলে। এমন একজন সাহসী শিক্ষার্থী দর্শন বিভাগ তৈরি করেছে বলে আমার গর্ব হচ্ছে। আমাদের এই প্রাক্তন ছাত্র নিজ উদ্যোগে নীলক্ষেত থেকে একটি কালো কাপড়ের গাউন তৈরি করে নিয়েছে স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য। কিন্তু এমন কি হওয়ার কথা ছিল? নিয়ম অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশনের বিনিময়ে তার গাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরবরাহ করার কথা ছিল। তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মের বরখেলাপ করেছে? বিশ্ববিদ্যালয় সেই দায় কেন নেবে? কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় তাকে একটি গাউন সরবরাহ করেছে, যদিও সেই গাউন তার শরীরের জন্য মাপসই হয়নি। তাহলে মূল সমস্যাটি কোথায়?

মূল সমস্যাটি হলো আমরা এখনও শিক্ষার্থীবান্ধব হয়ে উঠতে পারিনি। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের কথা বিবেচনা করে কর্মপরিকল্পনা করা হয় না, ভবন নির্মাণ করা হয় না। অথচ, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সুবিধা শিক্ষার্থীদের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার সহায়ক হিসেবে তৈরি করার কথা ছিল।

কানাডার দুটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার আমার সুযোগ হয়েছে। সুযোগ হয়েছে বিশ্বের কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সবার চলাফেরার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। এরমধ্যে রয়েছে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য এক বিশেষ ধরনের বাথরুম, হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য অনায়াসে বহুতল ভবনের সব ফ্লোরে চলাচলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। লিফট বন্ধ থাকলেও তারা যাতে নির্বিঘ্নে একা এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে চলাচল করতে পারে, আছে সেই ব্যবস্থাও। অথচ, আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী কোটা থাকলেও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা কোনও বাথরুমের ব্যবস্থা নেই। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য বহুতল ভবনের ওপরের ফ্লোরগুলোতে ওঠানামার জন্য বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেই। এখন যদিও কোনও কোনও ভবনে লিফট দেওয়া হয়েছে, কিন্তু লিফট বন্ধ থাকলে তাদের জন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা করা আছে বলে আমার জানা নেই। একটি চারতলা ভবনে যদি কোনও কারণে আগুন লাগে, একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য সেখান থেকে বেরিয়ে আসা বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব। ছাত্রাবস্থায় আমি নিজের চোখে দেখেছি একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে তার সহপাঠীরা কোলে করে নিচতলা থেকে দোতলা কিংবা তিনতলায় পৌঁছে দিচ্ছে। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষার্থীদের মতো একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্যও সরকারের সমান বরাদ্দ থাকে। অন্যান্য শিক্ষার্থীর মতো সেও একই রকম শর্ত পূরণ করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়।

আপাত দৃষ্টিতে তার জন্য শর্ত সমান হলেও তার যুদ্ধটা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। কারণ, শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে সে আর দশ জনের মতো স্বাভাবিক সুবিধা ভোগ করতে পারে না, সে চাইলেই এক দৌড়ে বাস ধরতে পারে না, চাইলেই রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম উপেক্ষা করে হনহনিয়ে এসে ক্লাস কিংবা পরীক্ষায় ঠিক সময়ে উপস্থিত হতে পারে না। যথাসময়ে উপস্থিত হতে হলে তাকে এই ধরনের প্রতিবন্ধকতার বিষয়গুলো বিবেচনা করে বাসা থেকে বের হতে হয়। সুতরাং, প্রকৃতি যেখানে তাদের লড়াইটা অন্যদের চেয়ে কঠিন করে দিয়েছে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সহায়ক না হয়ে বরং তাদের অধিকার বরাবর অবহেলা করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধরনের আচরণ খুবই দুঃখজনক বৈকি।

এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে আমি বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু বিষয় বিবেচনা করার প্রস্তাব করছি।

১। প্রতিটি ভবনে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য আলাদা রাস্তার ব্যবস্থা করা, যাতে লিফট বন্ধ থাকলেও অন্যদের মতো একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী অনায়াসে এই রাস্তা ব্যবহার করে বিভিন্ন ফ্লোরে যাতায়াত করতে পারে।

২। প্রতিটি ফ্লোরে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য কমোড সংবলিত একটি বাথরুমের ব্যবস্থা করা, যাতে ব্যবহারকারী অনায়াসে তার হুইলচেয়ার নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করতে পারে।

৩। প্রতিটি ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা থাকলে বাঁহাতি শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে অন্তত ৫% চেয়ার বাঁ-হাত ব্যবহারকারীদের জন্য তৈরি করা।

৪। সমাবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে রেজিস্ট্রেশনের সময় গ্র্যাজুয়েটের গাউনের বিষয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাজনিত কারণে কোনও বিশেষ ধরনের চাহিদা আছে কিনা সে বিষয়ে একটি বিশেষ মন্তব্যের ঘর রাখা এবং রেজিস্ট্রেশনের পর যথেষ্ট সময় হাতে রেখে সমাবর্তন আয়োজন করা, যাতে শিক্ষার্থীর চাহিদা অনুযায়ী গাউন তৈরি করে দেওয়া সম্ভব হয়।

৫। সমাবর্তনে যাতে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী অংশগ্রহণ করতে পারে সে জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা। সেই জন্য সমাবর্তনের রেজিস্ট্রেশন ফরমে কোনও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলে সেটা উল্লেখ করার জন্য একটি বিশেষ ঘর রাখা।

৬। যেকোনও ধরনের আয়োজনে প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেওয়া, যাতে তারা অবহেলা বোধ না করে।

আমার কাছে মনে হয়, এটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একক কোনও সমস্যা নয়। বরং, এটি সমগ্র বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা। আমি আশা করি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন ফরমে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে একটি আলাদা ঘর রাখা হবে, যাতে  শারীরিক প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। পরিশেষে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমাবর্তন সফলভাবে সম্পন্ন হোক, সেই প্রত্যাশা করি। সমাবর্তন আয়োজক প্রতিষ্ঠান এবং গ্র্যাজুয়েটদের জন্য রইলো অনেক শুভকামনা এবং অগ্রিম অভিনন্দন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব রক্ষায় ভারতে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে সরকার
টাঙ্গাইল শাড়ির স্বত্ব রক্ষায় ভারতে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে সরকার
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ভারতেরই অংশ: এস জয়শঙ্কর
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ভারতেরই অংশ: এস জয়শঙ্কর
প্রথম ধাপে ৭ শতাংশ কোটিপতি প্রার্থী
উপজেলা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ৭ শতাংশ কোটিপতি প্রার্থী
আপাতত মেনশন নয়, আপিল বিভাগে সিরিয়াল অনুযায়ী চলবে মামলার শুনানি
আপাতত মেনশন নয়, আপিল বিভাগে সিরিয়াল অনুযায়ী চলবে মামলার শুনানি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ