X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

হিরো আলমের উত্থান এবং আমাদের রুচির দুর্ভিক্ষ

নাসরীন সুলতানা
২৮ মার্চ ২০২৩, ১৮:০৮আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৮:০৮

ইদানীং হিরো আলম আমাদের তথাকথিত এলিট শ্রেণির আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। প্রায়ই হিরো আলম সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন। এখন তো অনেক টকশোতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করছেন। একজন হিরো বটে! আমি আজ হিরো আলমের উত্থান কীভাবে হলো কিংবা তার কন্টেন্টের মান নিয়ে আলোচনা করবো না। কারণ, হিরো আলমের কন্টেন্টের আমি ভক্ত নই। তার নির্মিত কোনও ভিডিও আমার পুরোটা দেখা হয়ে উঠেনি। সেটা একান্তই আমার রুচির ব্যাপার। আমি দেখি না বলে পৃথিবীর সবাই আমার রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে এমনটাও আমি আশা করি না। প্রতিটা মানুষ যেমন আলাদা, তেমনি তার পছন্দও আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে একটা সংবাদে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো। সেখানে লেখা ‘রুচির দুর্ভিক্ষের কারণে সমাজে হিরো আলমের উত্থান বলে মন্তব্য করেছেন বরেণ্য নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ’। এই মন্তব্যের বিপরীতে এই অভিনেতাকে উদ্দেশ করে হিরো আলম বলেছেন, ‘আমাকে তৈরি করে দেখান। আর বারবার যদি হিরো আলমকে নিয়ে আপনাদের রুচিতে বাধে তাহলে হিরো আলমকে মেরে ফেলেন’। (সমকাল অনলাইন, ২৮ মার্চ, ২০২৩)। আমি আমাদের এই রুচির দুর্ভিক্ষ আসলে কোন জায়গায় সেই বিষয়ে কিছু বলতে চাই।

আমার একবার পুতুল নাচ দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেই পুতুল নাচে যে ধরনের অশ্লীল শব্দের ব্যবহার ছিল সেগুলো পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে বসে দেখা যায় না, ছোট বাচ্চা নিয়ে তো নয়-ই। অথচ, পুতুল নাচকে মনে করা হয় আমাদের আবহমান বাংলার সংস্কৃতির ধারক। ছোটবেলায় খুব দেখতাম পুরুষ মানুষ মেয়ে সেজে বাড়িতে বাড়িতে রাজা-রানি সেজে গান গেয়ে টাকা তুলে ভোজের আয়োজন করতো। সেখানে আবার রাজার দুইপাশে একাধিক রানি থাকতো। গানের মধ্যেও বলা হতো তার দুই পাশে দুই রানি। এগুলো আবহমান বাংলার সংস্কৃতির ধারক।

সংস্কৃতি কী আসলে? সংস্কৃতি কি শেওলা পড়া পুকুরের জলের মতো স্থির? নাকি তা নদীর ঘোলা জলের মতো প্রবহমান, যা তার গতিপথের বিভিন্ন পর্যায়ে পলি মাটি সংগ্রহ করে মোহনাকে সমৃদ্ধ করে?

সংস্কৃতি একটা জাতির জীবনযাপন, চিন্তাচেতনা, পোশাক, ধর্মীয় আচার ইত্যাদি অনেক কিছুর সংমিশ্রণ।

আমার কাছে মনে হয়, সংস্কৃতি প্রবহমান। কারণ, তার বিবর্তন হয়, সে এক জায়গায় থেমে থাকে না। ভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা সে অনেক সময় সমৃদ্ধ হয়। এই ২০২৩ সালে কেউ আর বেদে গান দেখে মুগ্ধ হয় না। ছেলেদের মেয়ে সাজে খোলা উঠোনের সেই নাচ এখন আর কারও কাছে উপভোগ্য নয়। সমাজের একটি শ্রেণির কাছে পপ সংগীতের আদলে তৈরি করা দেশীয় সংগীত এখনও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। হিরো আলম সমাজের সেই শ্রেণির হিরো।

আমি গুণী অভিনেতা এবং নাট্যজন মামুনুর রশীদকে বিনীতভাবে প্রশ্ন করতে চাই, ‘আপনাদের এত রুচিবোধ, তো সমাজের সেই মানুষগুলোর কাছে কেন পৌঁছাতে পারছেন না?’
ছোটবেলায় বিটিভিতে যখন মামুনুর রশীদের নাটক দেখতাম, তখন নিঃসন্দেহে সেগুলো ভালো লাগতো। কিন্তু সেই যুগেও মামুনুর রশীদরা বেদে নাচ দেখে মুগ্ধ দর্শকের হিরো ছিলেন না। সেই শ্রেণি গাজীর গান দেখে মুগ্ধ হতো, তারা ভাসান গান শুনে কেঁদে বুক ভাসাতো। শীতের রাতে সারা রাত জেগে আজিজ বিড়ির ধোঁয়ায় পরিবেশ গরম করে যাত্রাপালার অশ্লীল নাচ দেখে মুগ্ধ হতো। শিঠি বাঁজাতে বাঁজাতে চারদিকে শোরগোল তুলতো। সমাজ থেকে সেই শ্রেণি উঠে যায়নি। শুধু তাদের বিবর্তন হয়েছে। এখন খোলা উঠোন, যাত্রাপালার মঞ্চ কিংবা গাজীর গানের আসরের জায়গা ইউটিউব দখল করে নিয়েছে। হিরো আলম সেই শ্রেণির হিরো। এই শ্রেণিকে কন্টেন্ট করে নির্মিত চলচ্চিত্র বিভিন্ন উৎসবে স্থান পায়, জাতীয় পুরস্কার পায়। তাদের রুচি যদি উচ্চমার্গে পৌঁছে সেক্ষেত্রে অনেক লেখক কিংবা নির্মাতা তাঁদের গল্পের প্লট থেকে বঞ্চিত হবে।

তাহলে, বিনোদন কি আপনার আমার কেবল এলিট শ্রেণির জন্যই? সমাজের দুর্বল এবং খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত দিনমজুর, যে কারিনা কাপুরকে ভেবে ভেবে বিনিদ্র রাতযাপন করার সাহস করে না, আমার আপনার বাসায় রান্নার দায়িত্বে থাকা যে নারী সুপার স্টার শাকিব খানের সঙ্গে রোমান্স করার স্বপ্নে বিভোর হয় না, তার জন্য আপনারা কী করেছেন?

রুচির দৈন্য শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে ইদানীং বেশি। কারণ, তাঁদের কাছে বেদে গান, গাজীর গান আবহমান বাংলার সংস্কৃতির ধারক, কারণ তারা কোনোদিন অর্থবিত্তের অধিকারী হয়নি, বিত্তবৈভবে গা ভাসাতে পারেনি। তাদের বাহবা দেওয়া যায়, অতি সহজে তাদের ডমিনেট করা যায়। একইভাবে, তারা হিরো আলমকে কল্পনা করেছে আজীবনের দুই মুঠো ভাতের জন্য সংগ্রামী এক যুবক হিসেবে। মনে করেছিল হিরো আলম সারা জীবন গরিব এবং দুঃখী শ্রেণিকে রিপ্রেজেন্ট করবে। কিন্তু তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে হিরো আলম এখন কোটিপতি, সংসদ সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

এত বছর টিভি নাটক লেখা এবং অভিনয় করা তথাকথিত এলিট দর্শক নন্দিত অভিনেতা এবং নাট্যকাররা যা করতে পারেননি, হিরো আলম মাত্র কয়েক বছরে সেটা করে দেখিয়েছেন। এটা কার ভালো লাগে?

নন্দনতত্ত্বের অন্যতম একটি আলোচ্য বিষয় হলো একটি শিল্প কখন নান্দনিক হয়ে ওঠে। নান্দনিকতা কি শিল্পের নিজস্ব গুণ, নাকি একজন দর্শক বা প্রত্যক্ষকারী তাকে নান্দনিক করে তোলে। কান্টের মতে, নান্দনিকতা ব্যক্তির নিজস্ব বিচার থেকে শুরু হয় যা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা দাবি করে। সেই বিচারে কেউই বোধ করি দাবি করতে পারে না তার রুচিই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। কারণ, রুচির শ্রেষ্ঠত্বের কোনও মাপকাঠি নেই, নেই কোনও সক্ষম বিচারক। তাই রুচির দুর্ভিক্ষ কোনকালে চলেছে এবং সেটা কোনকালে সমৃদ্ধ ছিল সেই বিচারের জন্য সমাজের শ্রেণি বিন্যাস আত্মস্থ করা জরুরি। যে দেশে মানুষ এখনও দুই বেলা আমিষের জন্য সংগ্রাম করে সেই দেশের মানুষ, সব শ্রেণির মানুষ অস্কারজয়ী সিনেমা দেখে মুগ্ধ হবে এমনটা ভাবা বোধ করি বাহুল্য। একটি দেশের মানুষের রুচি তখনই সমৃদ্ধ মনে করা হবে যখন সমাজের প্রতিটি মানুষ তার স্বাধীনতার চর্চা করতে পারবে, নিজের রুচি অনুযায়ী বিনোদন গ্রহণ করতে পারবে। অন্যের রুচি তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না।  

আমি শুরুতেই বলেছি হিরো আলমের কোনও গান পুরোটা দেখিনি। আমি তার ভক্ত নই। হিরো আলম কাদের কাছে হিরো সেটি নিয়েও আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। তবে তার সাহসকে আমি স্যালুট করি। মুখের ওপরে এমন জবাব দেওয়ার সাহস যার আছে সে সত্যিকার অর্থেই হিরো বটে। আপনি আমি না মানতেই পারি, তাতে তার কি যায় আসে?

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ