বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত কি দরিদ্রদেরও সেবা দিতে সক্ষম?

অনেকেই মনে করেন বেসরকারি খাত মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে ব্যাপক মুনাফা করছে। তারা মানুষের বাঁচা-মরা, রোগ-জ্বরা নিয়ে মুনাফার ধারণাকে অনৈতিক জ্ঞান করেন। তাদের কাছে চিকিৎসা সেবার বাণিজ্যকরণ অগ্রহণযোগ্য। অন্য ধারণার মানুষেরা মনে করেন, লাভজনক বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত সর্বনিম্ন খরচে সর্বাধিক ও সেরা স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা এনে দেবে। মুনাফার তাগিদ পদ্ধতিকে দক্ষ, সুশৃঙ্খল ও কার্যকর করে তোলে।

১৯৪৬ সালে ‘ভোর’ কমিটি প্রদত্ত মডেল অনুযায়ী সরকারি অর্থায়নে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় সুস্পষ্টভাবে সরকারি প্রাধান্যে এ অঞ্চলে ত্রিস্তরীয় স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। সময়ের পরিক্রমায় সরকারি হাসপাতালের করুণ দশা। নানা অব্যবস্থা, দীর্ঘ লাইন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া যায় না। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আনতে হয় বাইরের বেসরকারি থেকে। সরকারি হাসপাতাল ব্যবহার করে এ এক লাভজনক বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা!

এখন বাংলাদেশের একটি সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ নানাবিধ ফি বিপুল পরিমাণে আরোপ করা হয়েছে। এ রকম বাস্তবতায় সরকারের অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে বেসরকারি ব্যবস্থা অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে উঠেছে। অপেক্ষা করেনি সরকারের কোনও নীতি ঘোষণার। সরকারও গ্রহণ করেনি কোনও দূরদৃষ্টি পরিকল্পনা। এখন দেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি; বিপরীতে নিবন্ধিত ৫০৫৫টি বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ১৮৩। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বিচিত্র, নানাধর্মী ও অত্যন্ত খণ্ডিত। সেবা মানের ব্যাপক তারতম্য রয়েছে।

কার্ডিয়াক প্রসিডিয়রসহ অনেক চিকিৎসা সেবায় বেসরকারি হাসপাতাল সরকারি হাসপাতালকে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে। দেশে করপোরেট প্রতিষ্ঠান যোগ দিয়েছে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়। তারপরেও বাংলাদেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা এখনও অপরিণত প্রাথমিক অবস্থায় আছে। খণ্ডকালীন সেবা কর্মী, অদক্ষ নার্স ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবের মধ্যে দুর্বল অবকাঠামো নিয়ে আর্থিকভাবে হিমশিম খাচ্ছে। তথাপি পকেট কাটা হবে জেনেও মধ্যবিত্তরা সরকারি হাসপাতাল থেকে মুখ ঘুরিয়ে বেসরকারিমুখী হয়েছে।  মরণাপন্ন রোগীকে দূরদূরান্ত থেকে নগরের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে, ভর্তি হতে না পেরে বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। গরিব মানুষের পকেট থেকে কয়েক লক্ষ টাকা জলের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে সন্তোষজনক চিকিৎসা মিলছে না। তাহলে কি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত রোগীদের অসহায়ত্বকে জিম্মি করে টাকা বানানোর কৌশল? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা স্থগিত রেখে, চলুন দেখি....

১. বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় প্রধান সংকট কোথায়? বাংলাদেশে মাথাপিছু বার্ষিক স্বাস্থ্যব্যয় ৪৬ ডলার; বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির এক শতাংশ। একটু বোঝার সুবিধার জন্য উদাহরণের সাহায্য নিই– যুক্তরাজ্যে এই ব্যয়  ৪৫০০ ডলার, যার প্রায় পুরোটাই সরকার বহন করে; বাজেটে তাদের বরাদ্দ জিডিপির ১০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ১২০০০ ডলার, যা বিভিন্ন বিমা ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিশোধিত হয়; স্বাস্থ্যসেবার অংশ জিডিপির ২০ শতাংশ। জাপান স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু খরচ করে ৪৬০০ ডলার, স্বাস্থ্য ব্যয় জিডিপির প্রায় ১১ শতাংশ। উন্নত দেশের সঙ্গে আমাদের তুলনার সুযোগ নাই। কোন সরকার স্বাস্থ্য খাতে কত ব্যয় করবে তা তার অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।

স্বাস্থ্যসেবায় বাজেট সম্প্রসারণ করতে গিয়ে শিক্ষা, অবকাঠামোসহ আরও জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থের টান পড়বে। বাস্তবে বাংলাদেশ সরকার তার সামর্থ্যের কতটুকু স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করছে? আমরা একটা নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশ খুঁজে বের করি, যেখানে পৌঁছানো, আমরা আপত লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। সেরকম একটা দেশে মাথাপিছু স্বাস্থ্যব্যয় ৩০০ ডলার, তারা বাজেটে বরাদ্দ রাখছে জিডিপির ৩ শতাংশ। তাহলে বাংলাদেশ সরকারের কি সামর্থ্য নাই বাজেটে ২ বা ৩ শতাংশ বরাদ্দ রাখার? অবশ্যই আছে। বাংলাদেশে যে ৪৬ ডলার খরচ হয় তার ৬৭ ভাগ ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে দিতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা পেতে প্রধান অন্তরায় হিসাবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সময়ে ব্যক্তির নিজ পকেট থেকে সরাসরি অর্থব্যয় করতে বাধ্য হওয়াকে চিহ্নিত করছে।

মাথাপিছু স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় এবং এতে সরকারের অংশীদারিত্ব হলো যেকোনও দেশের পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার টেকসই আর্থিক ব্যবস্থাপনার দৃঢ় সূচক। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে অন্য যেকোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বা স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তন আনার চিন্তা অলীক। আগামী দিনের সরকারের অগ্রাধিকারে স্বাস্থ্য খাত থাকবে, তারা বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ পর্যায় ক্রমিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ কৃত স্তরে উন্নীত করবে ধরে নিয়ে আমার আলোচনা অগ্রসর হচ্ছে।

২. দ্বিতীয় যে বিষয়টি সামনে আনতে চাই- বাংলাদেশে কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান হবে? এই লেখাটি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অবতারণা করা হয়েছে। সরকারি খাত একই সাথে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, স্বাস্থ্যসেবার ক্রেতা ও তদারককারী। অপচয়, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় সরকারি স্বাস্থ্য খাত জর্জরিত। আমরা যথাযথ নিরূপণ করার সক্ষমতা রাখি না– তবে এটা প্রতীয়মান, একটি সেবা দিতে বেসরকারি খাতে যে খরচ পড়ছে সেই একই সেবা সরকারি খাতে প্রদানে খরচ বেশি হয়। বেসরকারি খাতকে মুনাফা করতে হলে, টিকে থাকতে হলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে ও সেবার উচ্চমান তৈরি করেই রোগীকে আকৃষ্ট করতে হয়।

আমরা কি উপলব্ধি করতে পারছি– আমাদের বেসরকারি স্বাস্থসেবা ব্যবস্থা দক্ষতার সাথে ও সাশ্রয়ীভাবে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে বা দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে সরকারি খাতকে সংকুচিত করে সেই অর্থে বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতা মূলক করে গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারি। আর এটাও সত্যি সরকারি অবজ্ঞা ও অসহযোগিতার ভেতরেই বেসরকারি খাত তার দাপট জোরালো করে তুলছে। পৃথিবীর অনেক উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশ (জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া) বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কাঠামো গড়ে তুলেছে। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ (চীন, ভিয়েতনাম) তাদের কেন্দ্রীভূত সরকারি ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল কাঠামো থেকে সরে এসে বেসরকারি ব্যবস্থাকে জায়াগা করে দেওয়ার পথে হাঁটছে। তাই উপেক্ষা বা চোখ বন্ধ করে থেকে নয়, বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের বিকাশকে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের ধারায় নিতে নীতি ও আইনগত কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে।

৩. স্বাস্থ্যসেবার প্রকৃত ব্যয় নির্ণয়: বেসরকারি খাত থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে প্রধান বাধা এর ব্যয়। চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের প্রথম ধাক্কাতে বিরাট অঙ্কের টাকা বেরিয়ে যায়।  বেসরকারি খাতের মৌলিক সমস্যা স্বাস্থ্যসেবা পেতে সমতা প্রতিষ্ঠায় বাধা, যারা টাকা দিতে পারবে তাদেরই সেবা দিবে। এমন কি পথ আছে, অল্প অর্থ খরচ করে প্রত্যেকে নিজের পছন্দমত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে পারবে? সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, জনগণের নিজস্ব পকেট থেকে খরচের বড় অংশ (৬৪ শতাংশ)  যায় ওষুধ ক্রয়ে। বাজেটে একটি অতিরিক্ত পয়সা খরচ না করেই, দেশের অসংখ্য দরিদ্র মানুষকে আরও গরিব হওয়া থেকে রক্ষা করা যেতে পারতো। প্রয়োজন শুধু অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের একটি সময়োপযোগী গ্রহণযোগ্য তালিকা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হালনাগাদ করে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ নীতিমালার বাস্তবায়ন। স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় নিম্নমুখী করে আনা যায়। চিকিৎসা সেবার সাথে ওষুধ ও নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে অস্বাভাবিক মুনাফার সম্পর্ক তৈরি হয়।

স্বাস্থ্যসেবায় অনেক অনৈতিক জায়গা তৈরি হয় এখানে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ নীতিমালার মতো অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সামগ্রী এবং অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সেবা নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যা সরকারকে অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সেবার মূল্য নির্ধারণে সুযোগ করে দেবে। এক্ষেত্রে সরকার বেসরকারি হাসপাতালকে বাধ্য না করে প্রণোদনার মাধ্যমে বাস্তবায়নের পন্থা অবলম্বন করতে পারে। যেসব বেসরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসক সেবার উচ্চ মান ধরে রেখে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ, অত্যাবশ্যকীয় সেবার তালিকার ভেতরে থেকে নীতিমালা অনুসরণ করে চিকিৎসা দেবে; দরিদ্র রোগীদের সেবা প্রতি সরকার পুরো বা আংশিক ব্যয় পরিশোধ করতে পারে। এজন্য নতুন আর্থিক নীতিমালা প্রণয়ন, চুক্তি ও অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন হবে। এই প্রক্রিয়ার সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করবে সরকারের আর্থিক সক্ষমতার ওপর।

বিমা ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে গরিব জনগণকে সুরক্ষা দেবে। এইসব বেসরকারি হাসপাতাল ট্যাক্স ছাড় ও আর্থিক সুবিধা পেতে পারে। এই ব্যবস্থা একই সাথে সীমিত ভাবে হলেও মূল্যের লাগাম টেনে ধরবে এবং দরিদ্র জনগণের চিকিৎসা ব্যয়ে সহায়তা দিয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে গরিব জনগণের সাধ্যের মধ্য আনতে পারবে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতও শক্তিশালী হয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে।

তবে স্বাস্থ্যসেবার মূল্য নির্ধারণে প্রশাসনিক ঘোষণা বা রাজনৈতিক সমঝোতার চেয়ে বেশি প্রয়োজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে প্রকৃত ব্যয় নির্ণয়ের কারিগরি সক্ষমতা অর্জন। স্বাস্থ্যসেবার প্রকৃত খরচ নির্ণয় প্রায় অসাধ্য যা সামান্য ভিন্নতায় অনেক তারতম্য তৈরি করে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে প্রকৃত খরচ নিরূপণ করতে না পারলে তার যৌক্তিক মূল্যও প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। যা পরিমাপ করা যায় না তা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নত করার সুযোগও থাকে না।

স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় নির্ধারণের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ শুধুমাত্র স্বাস্থ্যব্যয় নিয়ন্ত্রণ সহজ করবে না, স্বাস্থ্যসেবার বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে। স্বাস্থ্যসেবার প্রকৃত মূল্যের তথ্য স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন প্রক্রিয়া সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর আস্থা বাড়িয়ে দেবে। উদাহরণ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তুলনায় আনতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র জিডিপি’র ২০ শতাংশ খরচ এখনও শতভাগ মানুষকে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনতে পারেনি। উন্নত দেশের ভেতর জাপান কম ব্যয়ের (জিডিপির ১০ শতাংশ) ভেতর থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষকে বিমার আওতায় এনে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা এনেছে। এর পেছনে অনেক কিছুর সাথে জাপানের কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবার মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

আরও যেসব পথে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমতে পারে–

৪. স্বাস্থ্য প্রযুক্তি নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া:  ক্রমাগতভাবে স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে চলছে। বাংলাদেশ ও উন্নত দেশেও বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, রোগের ধরনের পরিবর্তন ও চিকিৎসায় উন্নত প্রযুক্তি সংযোগ। অনেক কম প্রয়োজনীয়, ব্যয়বহুল এবং অপরিক্ষীত পদ্ধতি, ওষুধ ও প্রসিডিয়র চিকিৎসা সেবায় ঢুকে পড়েছে। যা স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে, বৈষম্য ও হাহাকার তৈরি করছে এবং দেশের এ মুহূর্তের আর্থ-সামাজিক বিবেচনায় উপযোগী নয়। রাষ্ট্রের একটি স্বাস্থ্য প্রযুক্তি নিরীক্ষণের দক্ষ ও বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া থাকতে হবে। রোগ সম্পর্কীয় ও অর্থনৈতিক ডাটা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নতুন সেবা প্রচলনে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করবে। যা দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বোচ্চ সাশ্রয়ীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।

৫. তথ্য প্রযুক্তি: তথ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিশাল পরিচালনা ব্যয় কমিয়ে আনা যায়। একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় স্বাস্থ্য ডাটাবেজ নির্মাণ করতে হবে যা স্বাস্থ্যসেবায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, তথ্যের ঘাটতি পূরণ ও সাশ্রয়ী করবে। স্বাস্থ্যসেবায় জবাবদিহি তৈরি করতে, সুষ্ঠু তদারকির জন্য, প্রতারণা রোধে প্রয়োজন জাতীয় তথ্য ডাটাবেজ।

৬. জাতীয় স্বাস্থ্য ডাটাবেজের সঙ্গে ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্যসেবা সঞ্চয় ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট: অনন্য শনাক্তকরণ ব্যবহার করে জাতীয় ডাটাবেজের সাথে প্রত্যেকের (বিকাশ, রকেট, নগদ বা উপায়ের মতো) একটি করে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং হিসাবের প্রস্তাব করা হয়েছে লেখকের লেখায় অন্যত্র। যা ব্যক্তির স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়, সঞ্চয় ও ঋণ গ্রহণে ব্যবহৃত হবে। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে ন্যূনতম পরিচালন ব্যয়ে এই ব্যাংকিং সেবা চালু করা ও পরিচালনা করা সম্ভব হবে। মানুষের মাথাপিছু আয়ের বর্তমান স্তর, শ্রমবাজারে স্বনিযুক্ত পেশা ও অ-আনুষ্ঠানিক খাতের প্রাধান্য এবং বিমা ব্যবস্থায় চিকিৎসা ব্যয়ে ঊর্ধ্বমুখীনতা ও পরিচালনার  উচ্চ ব্যয় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিমা প্রচলন ও বাস্তবায়নে সুকঠিন বাধা। বিমা ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে, দেশের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবার ব্যয়ের বোঝা কিছুটা হালকা হবে। এ ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জনগণকে সঞ্চয়ে আগ্রহী করতে কোনও বেগ পেতে হবে না।

৭. প্রাথমিক ও প্রতিরোধ মূলক স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে: প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা  প্রাপ্য সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ীভাবে কার্যকর সেবা প্রদানে সক্ষম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যক্তি ও পরিবারকে আর্থিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তিতে সমতা বৃদ্ধি করে।

৮. বেসরকারি অলাভজনক হাসপাতাল: বারডেম, হার্ট ফাউন্ডেশন, কিডনি ফাউন্ডেশন, আহসানিয়া ক্যানসার হাসপাতাল ইত্যাদি ও এনজিওদের স্বাস্থ্যসেবায় মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এনে কাজের পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে এবং জবাবদিহি তৈরি করতে হবে। এতক্ষণ বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবার মূল্য কীভাবে কমিয়ে রেখে তা দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকারকে সহজ করতে পারে তার পথ খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। আমরা এবার যেখানে আলোচনা স্থগিত রেখে এসেছি, সেখানে ফিরে আসি।

এ অঞ্চলের মানুষ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সরকারি বিনামূল্যের চিকিৎসা সেবা দেখে এসেছে। দেখেছে অনেক অলাভজনক দাতব্য চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র। তারা মনে করে চিকিৎসক-নার্সরা মানুষের ভেতরে ভিন্ন কেউ যারা সকল লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে মানুষের রোগ-শোক, দুঃখ দূর করার জন্য সার্বক্ষণিক নিবেদিত থাকবে। তাই এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ, ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ, চৌকস আমলা, বিদগ্ধ কলামিস্ট, বাঘা সাংবাদিক স্বাস্থ্যসেবার সামাজিক, মানবিক দিক নিয়ে উচ্চকিত। কিন্তু তারা বিন্দুমাত্র সচেতন নন স্বাস্থ্যসেবার অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ে। তবে এই ইস্যুতে সমাজে টেনশন অনেক প্রাচীন। প্লেটোর রিপাবলিকে (বুক-১) সক্রেটিস কঠিন প্রশ্ন রাখছে– ‘ইজ দ্য ফিজিসিয়ান অ্যা হিলার অব দ্য সিক ওর মানি মেকার’।

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের মতো স্বাস্থ্যসেবাও মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা। এ সমস্ত মৌলিক চাহিদা বাজারে পণ্য হিসাবে বিক্রি হয়। স্বাস্থ্যসেবাও একটি পণ্য। কৃষক খাদ্য উৎপাদন করে বিক্রি করলে যদি অন্যায় না থাকে তবে স্বাস্থ্যসেবাও পণ্য হয়ে বিক্রি হতে অন্যায় নেই। বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতার সূত্র ধরে ক্রেতা ও বিক্রেতার মিথস্ক্রিয়ায় একটি পণ্যের সবচাইতে উপযুক্ত মূল্য তৈরি হয়। তবে অন্যান্য পণ্য থেকে স্বাস্থ্যসেবা বিশেষভাবে ভিন্ন, যেখানে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সূত্র অপ্রযোজ্য হতে পারে, যেমন- স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন ও চাহিদা খুবই অনিশ্চিত, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের স্বাস্থ্যসেবা বাজারে প্রবেশে নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয়, স্বাস্থ্যসেবায় চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, চিকিৎসা সেবার ফলাফলের অনিশ্চয়তা, সেবা সম্পর্কে চিকিৎসকদের সাথে রোগীর  জ্ঞানের বিরাট ভারসাম্যহীনতা ও স্বাস্থ্যসেবা মূল্য সম্পর্কে অসচ্ছতা ও অনিশ্চয়তা।

রোগী জানে না কি কিনতে হবে, কত দামে কিনতে হবে, এমনকি জানে না কি তার চাহিদা, যা তার সেবা প্রদানকারী নির্ধারণ করে দেয়। তাই স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বাজার ব্যর্থতা অত্যন্ত পরিচিত। তাই লাভজনক বেসরকারি খাত স্বাস্থ্য ব্যয় কমিয়ে রাখতে সচেষ্ট নয় বরং ক্রমাগত মূল্যস্ফীতিকে উৎসাহিত করে। অনেকে পণ্য হিসাবে স্বাস্থ্যসেবার এই সীমাবদ্ধতার ধারণা অস্বীকার করে, বরং মনে করে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে উদ্ভাবনী পথ ধরে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় কমাতে বাধা তৈরি করছে।

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের অধিকার হিসাবে দাবি করা হয়। তাই বিনামূল্যে তা দিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা কি বিনামূল্যে পাওয়া যায়? লাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগী সরাসরি মূল্য দিয়ে কিনছে আর আপাত সরকারি বিনামূল্যের সেবাটিও সে কিনছে তার দেওয়া রাজস্ব থেকে। 

প্রকৃতপক্ষে উভয়ক্ষেত্রেই রোগীর পকেট থেকেই যাচ্ছে। কোথাও বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে না। বিনা মূল্যে দিতে হলে কীভাবে সবার স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় পরিশোধ হবে? স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা অফুরন্ত; সরবরাহ সীমিত। এখানেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- সীমিত সম্পদের ভেতরে কোন পথে সর্বনিম্ন মূল্যে  সর্বাধিক মান সম্মত সেবা ও একই সাথে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের চাহিদা মেটানো যাবে? আমরা স্বাস্থ্যসেবার বিশাল চাহিদা পূরণে বেসরকারি খাতের উপর কতটুকু নির্ভর করতে পারবো?

শুধুই সরকারি ব্যবস্থা বা শুধুই বেসরকারি ব্যবস্থা চালু রাখার প্রস্তাব একটা চরমপন্থি ধারণা। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের মিশ্র ব্যবস্থাই বাস্তবতা। যেখানে লাভজনক বাণিজ্যিক স্বাস্থ্যসেবার ইতিবাচক শক্তির পাশাপাশি বিনামূল্যে বা কম খরচে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সহঅবস্থান থাকবে। এই প্রেক্ষাপটে সরকারি হাসপাতালকে চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী ভূমিকাকে  সংকুচিত করে আনতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর ভূমিকায় না থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্য-শিক্ষা, গবেষণা, জনশক্তি তৈরি, বেসরকারি ও সরকারি খাতের মান তৈরি, মান উন্নয়ন, নীতি গবেষণা, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে খরচ নিরূপণ ও নিয়ন্ত্রণ গবেষণা এবং তদারকিতে। স্বাস্থ্য খাতে নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব দূর করতে সরকারি চিকিৎসকদের দ্বৈত প্র্যাকটিসের অবসান ঘটানোর সময় এসেছে। এটা সরকারি নির্দেশে নিষিদ্ধ ঘোষণার মতো বিষয় না, পরিস্থিতিকে সেই মাত্রায় উন্নীত করে পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকদের আয় কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ  হবে তা নিয়ে নীতি নির্ধারক ও চিকিৎসকদের উদ্ভাবনী পথ বের করতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রকে প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।

যে দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী সাধারণত তার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তত শক্তিশালী আশা করা যায়। অমর্ত্য সেন বলছেন, শক্তিশালী অর্থনীতি গড়তে প্রয়োজন শিক্ষিত ও সুস্থ জনশক্তি; এ জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি  গুরুত্ব দিচ্ছেন সুযোগ ও সক্ষমতা তৈরিকে।

শেষ কথা: হাসপাতাল, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা রোগীদের উচ্চমানের সেবা প্রদানের দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে একটি উপযুক্ত উপার্জন পাবেন তা নিয়ে দ্বিমত নেই। উন্নত সেবা প্রাপ্তি প্রত্যাশা করলে সেবা প্রদানকারীদের যৌক্তিক উপার্জন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকতে হবে। একজন চিকিৎসক কোনও মহান মানবিক কাজ করে না। সে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেই তার দক্ষতা বিক্রি করে। এডাম স্মিথের একজন কসাই, রুটিওয়ালা বা মদ প্রস্তুতকারকের সাথে চিকিৎসকের বস্তুত কোনও ভিন্নতা নেই। স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে কোটি কোটি মানুষের দরিদ্র হওয়া ঠেকানোই এ মুহূর্তের প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা। স্বাস্থ্য খাতের বর্তমান খণ্ডিত অবস্থায় ও অর্থনীতির সক্ষমতার বর্তমান স্তরে দাঁড়িয়ে আমরা কতটুকু বাজার অর্থনীতির হাতে স্বাস্থ্যসেবা ছেড়ে দিয়ে তা অর্জন করতে পারবো তা একেবারেই অনিশ্চিত। তাই বেসরকারি খাতের অনিবার্য বিকাশকে স্বাস্থ্য খাতের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে তোলার উদ্ভাবনী পথ নির্ণয় ও বাস্তবায়নই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। কনসালটেন্ট ল্যাবরেটরি মেডিসিন, এভার কেয়ার হাসপাতাল। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিষয়ক কলামিস্ট।