যাই হোক, গানের ভেতর ও গান শেষ হওয়ার পরপরই দেখা যায় বেশকিছু প্ল্যাকার্ড। সেখানে লেখা- ‘১১ দফা মানতে হবে’, ‘কৃষক মজদুর এক হও’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ ইত্যাদি। গানের ভেতরেই ভাষা আন্দোলনে শহীদদের নামও দেখিয়ে দেন জহির রায়হান। সকলেই জানেন, এই ছবিটি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে নির্মিত একটি রূপকধর্মী চলচ্চিত্র। যা মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল। এই ছবিটির পর বাংলাদেশের কোনও চলচ্চিত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে এত শক্তিশালী বয়ান কেউ রচনা করতে পারেননি।
জহির রায়হান একটি গানের ভেতরে যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে স্পষ্ট করে তুলেছেন সেটা করা সম্ভব হতো না, যদি না তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা যদি রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকেন তাহলেই এমন প্রতীক ও বক্তব্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রে এমন ঋজু ও তীক্ষ্ণ বক্তব্য খুব একটা উঠে আসেনি, এমনকি পাখির চোখে দেখা গোটা মুক্তিযুদ্ধও অনুপস্থিত আমাদের সিনেমায়। যেমন ধরুন, বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ প্রস্তুতি, পাকিস্তান অংশের নীলনক্সা, ভারতের অংশগ্রহণ, সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান, ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের ভূমিকা ইত্যাদি টানাপোড়েন মিলিয়ে একটি ছবিও নির্মাণ হয়নি এখনও। আর সেখানে একুশের ফেব্রুয়ারি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ তো ব্যবসায়িক লোকসানের সামিল। যেদেশে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ধর্ষণকে পুঁজি করে সিনেমা বানানো হয়, এমনকি পঁয়তাল্লিশ বছর পরও ‘জেনারেল ও নারীরা’ শিরোনামে বই বেরোয়, সেদেশে একুশে ফেব্রুয়ারির মতো একটি দিনকে ঘিরে চলচ্চিত্র হবে- যেখানে নারী নেই, সুরসুরি নেই- এমনটা ভাবাই বোকামি।
সরকার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দিলেও ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক কোনও চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দেয়নি এখনও। দেবে কিভাবে? কাউকে তো ইচ্ছা পোষণ করতে হবে। একটি জাতির ইতিহাসে এত বড় ঘটনা কি করে এখনও বড় পর্দায় অনুপস্থিত থেকে গেল সেটার জবাব চলচ্চিত্রের মোড়লরাই দিতে পারবেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক