X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও তারুণ্যের বাংলাদেশ

বিধান রিবেরু
১৪ আগস্ট ২০২৪, ১৭:২৩আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৪, ১৮:৩৭

যা সিজারের প্রাপ্য তা সিজারকে, আর যা ঈশ্বরের প্রাপ্য তা ঈশ্বরকে দিতে হয়। এটাই দুনিয়ার নিয়ম। ইতিহাসের বইতে সবসময় নিরপেক্ষ অধ্যায় থাকে না, তবে কিছু অধ্যায় থাকে যা অপরিহার্য। তাছাড়া নিরপেক্ষ বলে আদৌ কোনও ব্যাপার হয় কিনা সেটাও তর্কসাপেক্ষ। ১৯৭১ সালের ইতিহাস তাই বাংলাদেশে একরকম, পাকিস্তানে আরেকরকম, ভারতে আবার আরেকটু ভিন্নরকম। এ যেন ‘রসোমন’ সত্য। কিন্তু সত্য কি একসঙ্গে তিন জায়গাতেই বিরাজ করতে পারে? সত্য তো একটাই। যার রক্তমাংসের ওপর দিয়ে সত্য যায়, সে-ই উচ্চারণ করতে পারে সত্যের স্বরূপ। বাকিরা কেবল হতে পারে দ্বিতীয়পক্ষ বা প্রত্যক্ষদর্শী। একাত্তর সালের যে রাষ্ট্রীয় জুলুম ও সামরিক যুদ্ধ পূর্ববাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা তাদের রক্তমাংসের ওপর দিয়ে গেছে। কাজেই তারা জানে ১৯৭১ সালের ইতিহাস কী।

সেই রক্তাক্ত ও গৌরবজনক ইতিহাসে এক বিশাল জায়গাজুড়ে আছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই কন্যা দেড় দশক ক্ষমতায় ছিলেন, এই দেড় দশকে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা নানা জায়গায় ও মাধ্যমে বিধৃত আছে। কখনও কখনও বা একটু বেশি করেই আছে। তাই এখানে আর তাঁর অবদানের কথা নতুন করে বলবো না। এই লেখাটি লিখতে বসা তরুণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। বিশেষ করে যারা এই জুলাই জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও একটি সফল অভ্যুত্থান পরিচালনা করে স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করেছেন।

আমার এই লেখায় দুটি দিক নিয়ে আমি আলাপ করবো।

এক. ইতিহাসে যে ব্যক্তির যা প্রাপ্য তা তাকে দিতে হবে। আর দুই. এমন কোনও কাজ করা ঠিক নয়, যা প্রকারান্তরে ইতিহাসে সংঘটিত কোনও জঘন্য কাজকে সমর্থন করে।

প্রথমটির প্রসঙ্গে আসি। ষাটের দশক থেকে একাত্তর সাল পর্যন্ত একজন মানুষ গণমানুষের রাজনীতি করতে করতে পুরো দেশের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিলেন। যার স্বাধীনতার ডাকে গোটা দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানি উপনিবেশ ও শোষণের বিরুদ্ধে। সেই মাপের একজন নেতাকে যদি কেউ অসম্মান করে, দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে, তাহলে বলতে হয়, তারা ইতিহাসও বোঝে না, রাজনীতিও বোঝে না। ভুলে গেলে চলবে না শেখ মুজিবুর রহমানকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল জিয়াউর রহমান ও হোসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। কিন্তু তিনি প্রবল প্রতাপেই ফিরে এসেছিলেন। যদিও তাঁকে এই ফিরিয়ে আনার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বার্থসিদ্ধির অভিপ্রায় লুকানো ছিল।

কথা হলো এক সূর্যের নিচে কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। বিশেষ করে যখন কেউ রক্তমাংসে গড়া মানুষ এবং তিনি যদি গণমানুষের রাজনীতি করেন। মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে কি কম সমালোচনা আছে? নেলসন ম্যান্ডেলা? অথবা খোদ ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন? সমালোচনা থাকবে। তার মানে এই নয় তাকে অপমান করতে হবে, সভ্যতার সকল মাত্রা ডিঙিয়ে তাঁর বাসভবন—যেটি ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী—পুড়িয়ে ফেলতে হবে। শুধু কি তাই? ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের আশপাশের স্থাপনাগুলোও রেহাই পায়নি এই জুলাই জাগরণে।

যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম আপনারা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম চিরতরে মুছে দিলেন, তো তাঁকে বাদ দিয়ে কি পূর্ণাঙ্গরূপে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা সম্ভব? সম্ভব যে নয় সেটি নাবালকও বোঝে। তাহলে কেন অযথা ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা?

তরুণদের বুঝতে হবে ১৯৭১ সালের আগের শেখ মুজিবুর রহমান ও পরের শেখ মুজিবুর রহমান এক নন। যুদ্ধের আগে তিনি মুক্তিকামী জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। আর স্বাধীনতার পর তিনি একটি রাষ্ট্রের প্রধান। জনতার নেতা আর রাষ্ট্রনায়ক তো ভিন্ন দুটি ধারণা। একজন ভালো রাষ্ট্রপ্রধান একজন ভালো জননেতা নাও হতে পারেন। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল নিয়ে অনেক ভালো ভালো লেখাপত্র রয়েছে। সেখানে অনেক বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনাও রয়েছে। সেসব দেখে আওয়ামী লীগ কর্মীদের যেমন ব্যথিত ও উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই, তেমনি বিরোধী শক্তির উল্লসিত ও হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হওয়ারও কারণ দেখি না। একজন মানুষ স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীকে উজ্জীবিত করতে পেরেছে মানে এই নয়, তিনি সব প্রত্যাশা পূরণ করে সুচারুভাবে রাষ্ট্রও পরিচালনা করতে পারবেন। সাফল্য ও ব্যর্থতা মিলিয়েই তো মানুষ। কেউ যদি শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন রাজনৈতিক নেতার সব সাফল্যকে লুকিয়ে ফেলে, তাঁর ব্যর্থতাকেই কেবল বড় করে দেখিয়ে তাঁর সম্মানে নির্মিত ভাস্কর্যকে ভেঙেচুরে, যারপরনাই অসম্মান করে, তাহলে তাদের ‘আত্মঘাতী’ বলা ছাড়া আর কোনও সম্বোধন আছে কি? যে নিজের অতীত ও ইতিহাসকে শেকড় ধরে উপড়ে ফেলতে চায়, তার মতো নির্বোধ আর কে আছে?

এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসি: ১৯৭৫। একজন মানুষকে সাড়ে তিন বছরের ব্যর্থতার জন্য সপরিবারে, নিজ বাসগৃহে নির্মমভাবে হত্যা করাটা কি অমানবিক নয়? পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে যদি শুধু রক্তেরই প্রয়োজন হয়, তাহলে আর আমরা নিজেদের সভ্য বলি কেন? আমাদের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদেরও এই জায়গাটা নিয়ে ভাবতে হবে। যেকোনও মূল্যে, রক্তের বন্যা বয়ে গেলেও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাওয়ার যে সংস্কৃতি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বর্তমান যুগে বরং স্বেচ্ছায় সরে গেলেই লোকে সম্মান করে। রক্তারক্তিও হয় না। সামরিক অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। জনগণের সমর্থনকে ব্যতিরেকে ক্ষমতার প্রতি লোভই আসলে পরিস্থিতিকে সহিংসতা ও রক্তপাতের দিকে নিয়ে যায়। ২০২৪ সালে সেটাই ঘটতে দেখলাম। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নেতা হিসেবে বিরাজ করতে চাইলে শেষ পর্যন্ত শাসককে ট্র্যাজেডি বরণ করতে হয়, নয়তো ইতিহাসে এক প্রহসন হয়ে ঝুলে থাকতে হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ট্র্যাজেডিকে বরণ করেছিলেন, আর তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা তৈরি করলেন প্রহসন।

এখন এই ট্র্যাজেডিকেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মতোই বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। তারপরও যারা এই অমোচনীয় কালিতে লেখা ইতিহাসকে কারপেটের নিচে লুকিয়ে ফেলতে চান, আমি একই কথা পুনরাবৃত্তি করবো, তারা না বোঝে ইতিহাস, না বোঝে রাজনীতি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের উচিত যতদিন তারা ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যে ট্র্যাজেডি ঘটেছে, সেটার প্রতি সমবেদনা দেখানো। আর এর মধ্য দিয়েই আমার মনে হয় উদার গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।

বাংলাদেশকে যদি হিংসা-বিদ্বেষ-সংঘাতের পথ থেকে বের করে সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে হয়, তাহলে ইতিহাসে যার যা প্রাপ্য সেটা স্বীকার করেই এগোতে হবে। মনে রাখা জরুরি, একাত্তরের আগের শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে পরবর্তী সময়ের ব্যক্তি ও দলকে যেমন মেলানো যাবে না, তেমনি ওই দুই কালপর্বের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়কেও তুলনা করা যাবে না। স্থান-কাল-পাত্র ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। যারা ইতিহাস নির্মাণ করতে চান, সেই তরুণদের বলি, হ্রস্বদৃষ্টিতে আক্রান্ত হওয়া চলবে না। বহুদূর যেতে হবে, তাই দৃষ্টিকেও প্রসারিত করতে হবে উদিত সূর্যের দিগন্তরেখা বরাবর।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র শিক্ষক    

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে রাতভর ছাত্র-জনতা ও শিবিরের বিক্ষোভ
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে চট্টগ্রামে রাতভর ছাত্র-জনতা ও শিবিরের বিক্ষোভ
যেসব পুষ্টি উপাদানের অভাবে চুল পড়ে
যেসব পুষ্টি উপাদানের অভাবে চুল পড়ে
আ.লীগ নেত্রীর মেয়ের নাম জুলাইযোদ্ধাদের তালিকায়, প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম
আ.লীগ নেত্রীর মেয়ের নাম জুলাইযোদ্ধাদের তালিকায়, প্রতিবাদ করায় শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম
এনসিপির অবস্থান কর্মসূচিতে একাত্মতা জামায়াতের প্রতিনিধি দলের
এনসিপির অবস্থান কর্মসূচিতে একাত্মতা জামায়াতের প্রতিনিধি দলের
সর্বশেষসর্বাধিক