কূটনীতিতে সম্পর্কের সীমানা

প্রচলিত আছে শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়। বৈশ্বিক ব্যবস্থায় এই বিষয়টিকে একচেটিয়া পুঁজি করে এতদিন এগিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু সময়, রাজনীতি, বাণিজ্যিক উত্থান ও শক্তির ভরকেন্দ্র বহুমুখী হওয়ায় সেই প্রচলিত আচরণের বহুমাত্রিক ব্যবহার ও কার্যকারিতা ছড়িয়ে গেছে। বৈশ্বিকভাবে আমেরিকার কূটনীতি যেকোনও অঞ্চলের সম্পদ ও সেখানে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা, সেটাও এখন বিশ্ব ওয়াকিবহাল।

গুরুজনরা বলেন, দুটি বাটি একসঙ্গে রাখলেও তাতে শব্দ হয়। অর্থাৎ খুনসুটি, ছোট বিবাদ হতে পারে। সেখানে আঞ্চলিকভাবে বহু দেশ যখন সীমান্ত ভাগাভাগি করে তখন সেখানে টুকটাক অম্ল-মধুর সম্পর্ক থাকতেই পারে। তাছাড়া সম্পর্কের বিষয়টা এমনই যে তা ওঠানামা করেই। কিন্তু আমেরিকা বরাবরই এই ছোট ছোট আঞ্চলিক সমস্যাগুলোকে দ্বন্দ্বে আকার দেয়। যাতে সংঘর্ষ বাঁধে ও তারা অস্ত্র বিক্রির বাজার তৈরি করতে পারে।

ঠিক এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষে। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর দীর্ঘদিন আমেরিকা একাধিপত্যের বিশ্ব চালিয়েছে। বিগত বিশ বছরে রাশিয়া আবারও শক্তিমত্তার চেয়ারে আসতে শুরু করেছে। রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈশ্বিক বন্ধুত্ব আমেরিকার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছিল। মূলত এজন্যই রাশিয়াকে একটা যুদ্ধমুখী অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন শুরু করেছে ইউক্রেনকে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা সরবরাহ করা। অর্থাৎ আমেরিকা জেনে-বুঝে বিশ্বকে একটা পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক চীন-তাইওয়ানও একই ইস্যু। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উত্থানকে বাধাগ্রস্ত করতে আমেরিকা তাইওয়ানকে উসকানির এমন স্তরে নিয়ে যাচ্ছে যে সেখানে একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বে আমেরিকার একাধিপত্যের জন্য হুমকি রাশিয়া-চীন। কিন্তু দুই দেশের পারমাণবিক অস্ত্রসহ অন্যান্য শক্তির কারণে আমেরিকা কখনোই এদের সরাসরি আক্রমণ করবে না। বরং নিজেদের ও প্রতিবেশীদের মাঝে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে অর্থনৈতিক, বৈশ্বিক সম্পর্কের ক্ষতি করবে। এজন্য জুজুর ভয় হিসেবে দাঁড় করায় ন্যাটোকে। অথচ ভারত-চীন-রাশিয়ার মতো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শক্তিকে বাইরে রেখে ন্যাটো গঠন যে আদতেই একটা প্রতিপক্ষ তৈরির কৌশল ও যুদ্ধ বাঁধিয়ে অস্ত্র ও খবরদারির খেলা, সেটাও এখন বিশ্ব বোঝে।

কিছু দিন আগেও মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকার টার্গেট ছিল। গোটা সময়টার নিরীক্ষণ স্পষ্ট করে, আমেরিকা শুরুতে সেখানকার আঞ্চলিক ঐক্য ভাঙতে স্থানীয় বিভেদকে কাজে লাগায়। সংঘাত সৃষ্টি করতে নিজেদের এজেন্টদের দিয়ে একটা ক্ষেত্রমঞ্চ রচনা করে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার এই ধরনের এজেন্ট সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। যারা নানা বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান-কর্মচারী, মানবাধিকার কর্মী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ছদ্মবেশে বিচরণ করে।

আমেরিকার চিরস্থায়ী বৈরিতা বা শত্রুতা নেই, আছে চিরস্থায়ী স্বার্থ। এর উল্লেখ্য উদাহরণ, লিবিয়া, ইরাক, ইরান। লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি আফ্রিকার তেল সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ইউনাইটেড আফ্রিকা ও বিশ্বব্যাংকের আদলে নতুন ব্যাংক গড়তে চেয়েছিলেন। যা প্রতিষ্ঠিত হলে বিশ্বব্যাপী বিশ্বব্যাংকের মুখোশে আমেরিকারসহ পশ্চিমা ক্ষমতা খর্ব হতো। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন তেল সম্পদকে রাষ্ট্রীয়করণ ও পেট্রো ডলারের রাজত্ব ভাঙতে তেলের বিনিময় মূল্য আঞ্চলিক মুদ্রাসহ বিকল্প অর্থাবস্থার পথ ধরতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যা আমেরিকার স্বার্থ পরিপন্থি। ফলাফল, বিশ্বব্যবস্থার সামনে দুটি দেশকে আক্রমণ করে, দুই রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে আমেরিকা।

দীর্ঘদিনের এই খেয়াল-খুশি ও খবরদারি মিসমার হয়ে গেছে রাশিয়া-চীন-ভারতের উত্থানে। এজন্য আহত প্রেমিকের মতো মধ্যপ্রাচ্য মিশনের ব্যর্থ জ্বালা নিয়ে অন্য আঞ্চলিক ক্ষেত্রমঞ্চ খুঁজতে মাঠে নেমেছে আমেরিকা। এজন্যই এশিয়ায় এত টানাপোড়ন। এই অঞ্চলের সম্পদ, মার্কেট সাইজ ও ভোক্তার পরিমাণ আকর্ষণীয়। ভারত, বাংলাদেশ, চীন, পাকিস্তানসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশের যে জনসংখ্যা তাতে বিশ্বব্যবস্থায় ২০৪০ সালের মাঝে বিশ্ব জিডিপির ৪৫ শতাংশ হবে। এখানকার কর্মক্ষম তরুণশক্তি বিশ্বের প্রায় ৫৮ শতাংশ। এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনীতিরই দুই-তৃতীয়াংশ হবে। বিশ্বে যে সমুদ্র আছে তার ৬০ শতাংশ এই অঞ্চলে, ভূমি আছে ২৫ শতাংশ। এ কারণে এই অঞ্চলের জন্য আমেরিকা এত উদগ্রীব। এজন্য হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে আইপিএস বা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিকে।

আমেরিকা আইপিএস বা ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ফিলিপাইন, বাংলাদেশসহ এখানকার অন্য দেশগুলোকে রাখলেও চীনকে রাখেনি। অর্থাৎ এখানেও একটা প্রতিপক্ষ দাঁড় করিয়েছে যেন সবাই মিলে প্রতিবেশী চীনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কারণ, আগেই চীনের সঙ্গে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতের সীমান্ত বিরোধ আছে। সেটাকেই কাজে লাগিয়ে এগোতে চাইছে আমেরিকা।

আমেরিকার এই ধরনের নীতির কারণে তারা বৈশ্বিকভাবে অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর বাইরে রেজিম চেঞ্জ বা দেশে দেশে ক্ষমতা বদলের যে কূটকৌশল, তা তো আছেই। গণতন্ত্রের ধোঁয়া তোলা আমেরিকাই এ পর্যন্ত ৭০টির মতো দেশে স্বৈরশাসক বসিয়েছে। তাদের দিয়ে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র কিনিয়েছে। কিছু দিন আগেও তুরস্কে একটা সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানকে পরাজিত করে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে আসীন করতে চেয়েছিল। সেখানেও ব্যর্থ হয়েছে।

এশিয়ায় এখন তাদের টার্গেট বাংলাদেশ। কারণ, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান এমন একটি জায়গায়, যেখানে তাকে বাগে আনতে পারলে প্রতিবেশী ভারত-চীনকে অস্থিতিশীল করা যাবে। কারণ, বাংলাদেশের তিনদিকে ভারতের সীমানা রয়েছে। এখানে সীমানাকেন্দ্রিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারলে উন্নয়ন, অগ্রযাত্রার বাংলাদেশ ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভারতকে দুর্বল করা যাবে। তাছাড়া বাংলাদেশের পাশ থেকে মিয়ানমার পরবর্তী চীনের ওপরও নজরদারি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করা যাবে। এর আগে বিএনপি বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করা অবস্থায় ভারতের সীমান্তবর্তী উত্তর অংশের অবস্থা তার সাক্ষ্য বহন করে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টায়ও আমেরিকা সরাসরি বিরোধিতা করেছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডে নিজেদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ আটকে রাখতে পারেনি। এজন্য সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদীদের সঙ্গে এত মহব্বত। বিএনপির প্রতিষ্ঠা স্বৈরশাসনের আবহে। এ কারণে তারাও বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে আমেরিকাকে বন্ধু মনে করে। স্বার্থের দিক বিবেচনায়ও ঠিক তাই। যা আওয়ামী লীগের বেলায় পাবার সুযোগ নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে হওয়া ডিজিটাল বিপ্লবের কারণে মানুষের হাতে হাতে ইন্টারনেট ও তথ্য। তাই বাংলার জনগণও আজ জানে আমেরিকার বন্ধুত্বে শুধুই তাদের স্বার্থ লুকানো। এজন্যই আমেরিকা আজ যা করতে চায়, হয়ে যায় উল্টো। তুরস্কের এরদোয়ান তার প্রমাণ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই সেটাই হবে। কারণ, দেশের জনগণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে নিবেদন, যে উন্নয়ন-অর্জন তা অনন্য। যদিও সে অনুযায়ী তার প্রচার, প্রচারণা ও কৌশলসম্পন্ন জোয়ার কম।

আমেরিকা এখনও বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর একটি। কিন্তু তারপরও যতদিন না তারা রেজিম চেঞ্জ বা দেশে দেশে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করবে, তারা আর মূলধারায় ফিরতে পারবে না। যার উদাহরণ, নিজেদের সর্বগ্রাসী স্বার্থের কারণে খোদ ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতেও তারা এখন অজনপ্রিয়। বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও চিলির খনিগুলোতে যথাক্রমে মজুত থাকা লিথিয়ামের পরিমাণ প্রায় ২১ মিলিয়ন টন, ১৯.৩ মিলিয়ন টন ও ৯.৬ মিলিয়ন টন। এই দেশগুলো এখন সরাসরি লিথিয়াম রফতানি করতে চায় না। বরং তারা এ দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে রফতানি করতে চায়। চীন এতেই বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু আমেরিকা সরাসরি লিথিয়াম চায়। এভাবেই একেবারে অতিরিক্ত মুনাফা, খবরদারি ও একক স্বার্থের নেশা আমেরিকাকে একা করছে।

ভারত-চীন-রাশিয়া ‘ভাষাগত’ অসুবিধায় খানিক পিছিয়ে পড়লেও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে বৈশ্বিক যোগাযোগের সমস্যাকে জয় করেছে। সঙ্গে রাষ্ট্রগুলোর সরকার ব্যবস্থা ছাড়া সেখানে রাজনৈতিকভাবে অযাচিত হস্তক্ষেপ না করায় আরও নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠছে। আগামীর বিশ্ববন্ধুত্ব এমন সমঝদারদের সঙ্গেই হবে, এটাই বৈশ্বিক বিশ্বাস।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা

haiderjitu.du@gmail.com