সালটা তখন ২০০৩, আমি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে চাকরি খুঁজছি। চাকরির জন্য মৌখিক পরীক্ষা দিলাম আজকের কাগজে। সেই সময়ের জনপ্রিয় দৈনিক। মৌখিক পরীক্ষায় বাঘা বাঘা সাংবাদিক জিজ্ঞেস করছেন হাইব্রিড, জিওমো, অর্গানিক কৃষি এবং পরিবেশ রক্ষায় আধুনিক কৃষি ভাবনা নিয়ে। তাত্ত্বিক পড়াশোনা, অধিক জনসংখ্যার দেশে জমি হ্রাসের বিষয়সহ নানাবিধ কারণে মতভেদ হলো।
কর্তৃপক্ষ আমার মতামত মানছেন আবার মানছেন না। তারপরও তাঁরা আমাকে দায়িত্ব দিলো জীবনসূত্র নামে অর্ধপাতার। ভাবনার মোড় ঘুরছে তখন থেকে। নতুন কৃষি শিক্ষার জগতে প্রবেশ। শিক্ষক কাজী শাহেদ আহমেদ।
সেই সময় সপ্তাহে তিন দিন অর্ধপাতায় বের হতো অর্গানিক কৃষির ভাবনা ও আধুনিক কৃষি চিন্তার জীবনসূত্র। রাসায়নিক কৃষির সঙ্গে জৈব কৃষির তুলনামূলক ভাবনা। পরিবেশ রক্ষা, কৃষি রক্ষা এবং সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য। প্রতিদিন আমার অ্যাসাইনমেন্ট আসতো আড়াল থেকে। কাজ করতাম এখনকার ইউল্যাবের বিল্ডিংয়ের চারতলায়। ছোট কেন্টিন, লালচালের ভাত, সবজি, ডাল এসবই ছিল দুপুরের খাবার। কাজের দুই মাসের মাথায় সুযোগ পেলাম প্রতিদিন দুপুর ১২টার প্ল্যানারি সভায় অংশগ্রহণের। এখানে প্রথম দেখলাম সেই কাজী শাহেদ আহমেদকে। সেখানেই লালচালের মহত্ত্ব বোঝা গেলো।
আধুনিক উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধানের সঙ্গে পার্থক্য। আমাদের স্থানীয় যেসব জাত, বিশেষ করে বিরুই, লালটেপা, শাইল, গোবিন্দভোগ, বালামসহ হাজারো জাতের ধানের গুণাগুণ রয়েছে অজস্র। তার ধারণা, আধুনিক ধানের, বিশেষ করে হাইব্রিড ধান চাষে রাসায়নিক সার, বালাইনাশকসহ সেচের পানিতে যে পরিমাণ খরচ হয় তাতে ফলন বাড়ে কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় লাভজনক না। কাজী শাহেদ আহমেদের ধারণা, হাইব্রিড ধানের ভাতে পুষ্টিমান কম, অধিক পরিমাণে খেতে হয়, শরীরে অল্প সময় থাকে। অথচ স্থানীয় লালচালসহ অন্যান্য জাতের ধানের পুষ্টিমান বেশি, পরিমাণে কম খেতে হয় এবং দীর্ঘসময় শরীরে থাকে, অথচ উৎপাদন খরচ কম। মানে এসব ধান উৎপাদনে রাসায়নিক সার, বালাইনাশক, সেচের পরিমাণ কম লাগে, পরিবেশ রক্ষা করে, সামগ্রিক বিবেচনায় লাভজনক।
তাঁর ধারণায় স্থানীয় জাতের চাল কম পরিমাণে ভক্ষণ করতে হয়, উৎপাদন খরচ কম, এটিই লাভজনক। প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করতেন স্থানীয় জাতের ফসলের বীজ এবং সেগুলো লালন করতেন। স্থানীয় জাতের সবজি, শাক এবং ভেষজ উৎপাদনে ছিল তাঁর বিশেষ ভাবনা।
শুধু ধানের ক্ষেত্রেই না, দেশের প্রথম অর্গানিক চা বাগান তৈরি করেছেন পঞ্চগড়ে। পঞ্চগড়ে কৃষির যে পরিবর্তন সেই পরিবর্তনটি হয়েছে তার ভাবনা থেকেই। বালুর মধ্যে তিনি চা বাগান করেছেন। বালুমাটিকে অর্গানিক সার দিয়ে করেছেন উর্বর। চা বাগানের ছায়াদানকারী গাছ হিসেবে লাগিয়েছিলেন ভেষজ। চা বাগানের ছায়াদানকারী আমলকী গাছের ফল থেকে আমলকী সংগ্রহ করে তৈরি করতেন ভেষজ প্রসাধনী। বালুমাটিকে ঊর্বর করার জন্য বিশাল আয়তনের ডেইরি খামার। ডেইরি খামারের গোবর ব্যবহার করতেন চা বাগানে আর দুধ ব্যবহার করতেন অর্গানিক মিষ্টি জাতীয় পণ্য তৈরিতে। তখনকার সময় মীনা বাজারে বিক্রি হতো, এখনও হয়। দেশের মানুষের পরিবেশসম্মত অর্গানিক সবজি উৎপাদনের জন্য গড়ে তুলেছিলেন কৃষি খামার। তাঁর দেখানো পথেই আজকে পঞ্চগড়ে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অনেক চা বাগান।
তেঁতুলিয়া চা বাগানটি ছিল অনেকটা লার্নি সেন্টার। ইউল্যাব তখনকার সময় সবে চালু হয়েছে। উনার নিজস্ব উদ্যোগে অর্গানিক কৃষি শেখাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাঠাতেন সেখানে। আমি নিজেও তাদের গাইড হিসেবে গেছি। তখনকার সময় প্রায় প্রতিমাসেই তিনি আমাকে পাঠাতেন তেঁতুলিয়ায়, নিজের সফরসঙ্গীও করেছেন দুইবার, এবং সেখান থেকে নতুন কী দেখে এলাম তা জানতে চাইতেন।
সুস্থ পরিবেশ ও অর্গানিক কৃষি অন্তঃপ্রাণ এই মহাপুরুষ ভেষজ উন্নয়ন, মসলা সম্প্রসারণসহ কৃষি উন্নয়নে যে অবদান রেখেছেন তা অনেকটাই নীরবে। মীনা বাজারে একটা কর্নার করে দিয়েছিলেন। আমি ওনার সান্নিধ্যে মাত্র ১২-১৩ মাস ছিলাম, কিন্তু দেখেছি বিশাল হৃদয়। সেই সময়কারই কাজগুলোর কিছু অংশ দিলাম। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে আমি আজকের কাগজ ত্যাগ করি। কিন্তু তার ভাবনাগুলো আমাকে আজও ভাবায়। তাঁর শান্তি কামনা করি। পরপারে তিনি ভালো থাকবেন।
লেখক: প্রকল্প পরিচালক, রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।